বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র গুপ্ত : এক স্বপ্নবাদী কবি

কবি সমুদ্র গুপ্ত তার কবিতাকে তথাকথিত আধুনিক বাংলা কবিতার যে দুর্বোধ্যতা তা অতিক্রমের মধ্যদিয়ে 'সহজ ও আপন সুর অন্বেষণ' দ্বারা বর্তমান কালের জন্য অতীব উপযোগী করে তুলেছেন এবং তা অধিক বিবেচিতও বটে। আমরা তাই দেখতে পাই, তিনি সর্বদা শিল্পের দায়বদ্ধতা থেকে তার কবিতা নির্মাণ করেছেন; কবিতার বিশাল শরীর এঁকেছেন ভালোবাসা, বিশ্বাস আর বোধের বৈচিত্র্যময় নানা রঙে।
সাইফুদ্দিন সাইফুল
  ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

প্রলম্বিত গোঁফ আর শুভ্রকেশের ঋষিতুল্যরূপ অধিকারী একঝাঁক সম্পূর্ণ কাশফুলের মতো সফেদ বাউল চুলের সমারোহ এবং কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে সদা প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ 'রোদ ঝলসানো মুখ'র কবি সমুদ্র গুপ্ত। 'শেকড়ের খোঁজে'র একজন কবির নাম সমুদ্র গুপ্ত। বাংলা শিল্প-সাহিত্যের সাংস্কৃতিক জগতে একনিষ্ঠ ত্যাগী কর্মী শত সহস্র লাখো মানুষের প্রিয় কাছের কবি চেতনার কবি বাংলা শব্দের অন্যতম শক্তিমান কবি সমুদ্র গুপ্ত। বাংলা কাব্যের জনপ্রিয় কবি সমুদ্র গুপ্ত ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবিতা গল্প সমালোচনা প্রবন্ধ নিবন্ধ সাহিত্যবিষয়ক বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল রচনা লেখালেখি শুরু করেন। সেই সময়ে তিনি নিজেকে সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল কবি নক্ষত্র হিসেবে স্থান করে নেন। এবং চারিদিকে তার কবি নাম প্রচার হতে থাকে। কবি সমুদ্র গুপ্ত মূলত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রোদ ঝলসানো মুখ' ১৯৭৭- এ প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কবি খ্যাতি লাভ করেন। এবং তার একমাত্র পরিচয় তিনি কবি, শুধুই কবি ছাড়া তিনি আর কিছু নন। কেননা, কবি হিসেবেই তিনি তার সমসাময়িক সময়ে অন্যতম শক্তিমান কবি হিসেবে পাঠক-লেখক মহলে পরিচিত লাভ করেন। আমাদের প্রিয় কবি আত্মার আত্মীয় প্রাণের বান্ধব সমুদ্র গুপ্ত সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার পাখি ডাকা ছায়াঘেরা হাসিল গ্রামে বিগত ১৯৪৬ সালের ২৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে দেয়া কবির আসল নাম আব্দুল মান্নান। অবশ্য বাল্যকালে তিনি বাদশা নামেও পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে সাহিত্যচর্চা করতে এসে এবং কমিউনিজম চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নষ্ট-ভ্রষ্ট ঘুনেধরা পচে যাওয়া এই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, মিথ্যে রাজনীতির কবল থেকে গণমানুষের মুক্তি, মানুষের অর্থনৈতিক সার্বিক পরিবর্তন; কৃষক শ্রমিকের দুর্ভাগ্য হতাশাপূর্ণ জীবন চাকাকে একটা মানদন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আকাশসম স্বপ্ন ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবতায় আস্থাশীল সাম্যে বিশ্বাসী কবি সমুদ্র গুপ্ত এক সময় বাম-রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং সে সময়ে দেশে নষ্টভ্রষ্ট মিথ্যে পুঁজিবাদী রাজনীতির অবসানকল্পে কবি আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন বেছে নেন। আর তখন থেকেই সমুদ্র গুপ্ত এই ছদ্মনাম ধারণ করেন। আর পরে এই ছদ্মনামেই তিনি সাহিত্যাঙ্গনে অধিক পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। এখন পাঠক সাহিত্যপ্রেমীরা তাকে কবি সমুদ্র গুপ্ত হিসেবেই অধিক চেনে ও জানে। এক কথায় কবি সমুদ্র গুপ্ত তার সৃজনশীল খুরধার লেখনীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যভান্ডারকে অনেক গতিশীল সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন। তার কবিতার বড় কারিশমা এই যে, তিনি কবিতাকে কোনো কঠিন কিংবা জটিলতার চাদরে আবৃত করেননি। তিনি কবিতাকে সরল সাবলীল ও সহজপাঠ করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। যেহেতু চলমান যান্ত্রিক সভ্যতার গেঁড়াকলে পড়ে মানুষ এক কঠিন যান্ত্রিকজীবে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে, সেখানে একজন সমুদ্র গুপ্ত মানুষের সত্তাকে বোধকে চিন্তাকে ভাবনাকে ধারণ করে শিল্প সাহিত্য কবিতা নিরলসভাবে উর্বর জমিতে কৃষকের মতো চাষ করে নিজেকে কবিতার দক্ষ চাষি হিসেবে তৈরি করেছিলেন। আর এখানেই একজন মানুষ এবং কবির মধ্যে দিব্য ঢের পার্থক্য চমৎকারভাবে বিদ্যমান এবং তা ফুটে উঠেছে। কবি সমুদ্র গুপ্তকে পাঠ করতে গিয়ে যতটুকু জানা যায় যে, সমাজ-সংসারে প্রচলিত আচার বিধিবিধান নিয়মের দ্বারা বেষ্টিত ধর্মকর্মের প্রতি তার তেমন একটা আগ্রহ না থাকলেও জীবনে তিনি সততা আদর্শ নির্ভীকতা ন্যায়নিষ্ঠা উদারতা মানবিক মূল্যবোধে নিবেদিত একজন সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। কবি সমুদ্র গুপ্ত একদিকে যেমন মাটি প্রকৃতি বৃক্ষ নদী ও পাখির কবি ছিলেন আবার তিনি গণমানুষের কবিও ছিলেন। গণমানুষের কথা ভাবনা ইচ্ছা চেতনার কথা তিনি তার কবিতায় সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। কবিতাকে তিনি গণমানুষের কণ্ঠ করে তুলেছিলেন। আর এই জন্য তিনি তরুণ লেখকদের কাছে সাধারণ মানুষের কাছে অতিব জনপ্রিয় একজন কবি ও সদাহাস্য সাদাসিদে নিরেট ভালো মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এখানেই তার কবি জীবনের স্বার্থকতা। কবি সমুদ্র গুপ্ত তিনি জীবন স্মৃতিকে আটপৌরে শক্ত দড়িতে বেঁধেছেন। এই ক্ষণজীবনের স্মৃতিকে একজন সচেতন কবি তার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে শব্দচয়নে ভাবে ভাবনায় শিল্পের নানা রঙে জীবন্ত করে তুলেছেন। কবি তার 'বিভ্রম' কবিতায় এভাবে উচ্চারণ করেছেন- 'ছেলেবেলায় একবার এক সম্পন্ন আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে কারুকার্যময় আলমারির ভেতরে রাখা সুন্দর পুতুল দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে আলমারির কাচ ভেঙে ফেলেছিলাম...। ' অনেক দারিদ্র্যের মধ্যে কবি সমুদ্র গুপ্তের জীবন কেটেছে। আর এই জীবনকালে তিনি বিভিন্ন পেশার মধ্য দিয়ে কবি জীবন পার করেছেন। যেমন- তিনি তার বর্ণাঢ্য কবি জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে বেঁচে থাকার তাগিদে কর্মময় জীবন কখনো প্রেসের কর্মচারী, করাতকলের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন আবার কখনো ওষুধ ও চিকিৎসার ব্যবসা করেছেন। তিনি এসবের পাশাপাশি আবার কখনো কখনো উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী, জুটমিলের বদলি শ্রমিক, প্রম্নফ রিডার হিসেবেও কাজ করেছেন। এ ছাড়া সাংবাদিকতা, একজন কবি এবং একজন পেশাদার লেখক হিসেবেও জীবনের চাকা ঘুরিয়েছেন। ফলে কবি সমুদ্র গুপ্তকে জীবন চলার পথে পেশাগত বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। আর তাই একান্তে আশাবাদী বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও এই কবি নিরন্তর কাব্যচর্চায় একাগ্রচিত্তে নিজেকে অনেকটা মনোনিবেশ করে উঠতে পারেননি। তার পরেও তিনি সাহিত্যচর্চা থেকে এতটুকু পিছপা হননি। বলা যেতে পারে, জীবনের শেষকাল পর্যন্তও তিনি কাব্যচর্চায় নিজেকে নিরেট দক্ষ শ্রমিকের মতো নিয়োজিত রেখেছিলেন। আর্থিক দারিদ্র্যের কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। জীবন চলার পথে কঠিন বাস্তবতাকে হাসি মনে মেনে নিয়ে মাথা উঁচু করে কবিতাকে সৃষ্টি করেছেন। মোটকথা, কবি সমুদ্র গুপ্ত তিনি তার হৃদয় দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে বিশ্বাসের অবস্থান থেকে কবিতা নির্মাণ করেছেন। কবিতাকে করে তুলেছেন তার জীবনের একমাত্র সাধনার বস্তু। এখানেই কবি একজন এবং অনন্য হয়ে পাঠককুলে মহাকায়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে গোটা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিল। আর এ থেকে একজন স্বাধীনতাপ্রিয় কবি সাহিত্যিক লেখকও পিছিয়ে ছিল না। কবি সমুদ্র গুপ্ত মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার কবিরা সেদিন তাদের কবিতাকে স্বাধীনতার রঙে রাঙিয়ে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয় মানসপটে প্রেরণা জুগিয়েছিল। সেসময় কবিতা হয়ে উঠেছিল এক একটা বারুদের মতো। কবি সমুদ্র গুপ্ত দেশকে খুব ভালোবাসতেন, দেশের মাটিকে জননী-তুল্য ভাবতেন। এই জন্য তিনি দেশের তরে মহান একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও দ্বিধাবোধ করেনি। আমাদের প্রিয় এই বাংলার মাটিকে অনেক অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে। তিনি এই বাংলার মাটিকে রক্তে ভেজা মাটির চোখে দেখেছেন। তিনি তার 'এই বাংলার মাটি' কবিতায় লিখেছেন- 'আদর্শ বর্গ আয়তনে/ সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র পরিমাপের একখন্ড মাটি নিয়ে হাতে তুলতেই সন্দেহ হলো/ লাল নাকি! মাটির মতো লোহাও লবণ! মাটি মাটিতে রাখলে মাটি/ হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায়...। ' কবি সমুদ্র গুপ্ত তার কবিতাকে তথাকথিত আধুনিক বাংলা কবিতার যে দুর্বোধ্যতা তা অতিক্রমের মধ্যদিয়ে 'সহজ ও আপন সুর অন্বেষণ' দ্বারা বর্তমান কালের জন্য অতীব উপযোগী করে তুলেছেন এবং তা অধিক বিবেচিতও বটে। আমরা তাই দেখতে পাই, তিনি সর্বদা শিল্পের দায়বদ্ধতা থেকে তার কবিতা নির্মাণ করেছেন; কবিতার বিশাল শরীর এঁকেছেন ভালোবাসা বিশ্বাস আর বোধের বৈচিত্র্যময় নানা রঙে। তিনি তার 'পাথরসন্দেহ' শিরোনাম কবিতায় লিখেছেন- 'অবিশ্বাস সন্দেহ আর ঘৃণার নড়বড়ে পাথরে পা রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি ঐ বৃক্ষ পত্রপুষ্প চাঁদের ঘোলা আলো তার ওপারে অগুণিত পাখিদের ঘুম আমাকে আটকে রাখে কেন সন্দেহ দানা বাঁধে আমি কি পাখি নই আমার দাঁড়ানোটাও কি পাথরের উপরের নয়...। ' কবি সমুদ্র গুপ্ত নিজেকে আপাদমস্তক একজন সত্যিকার কবিরূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এই কারণেই তিনি তার সৃষ্টিশীল শিল্প সাহিত্যকর্মে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে যেমন- (১) হুমায়ুন কবীর স্মৃতি সাহিত্য পদক, (২) লেখক শিবির সাহিত্য পদক, (৩) যশোর সাহিত্য পরিষদ পদকসহ দেশের বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন। এমনকি তিনি তার কবি প্রতিভাকে সম্মান হিসেবে দেশের বাইরেও অন্যান্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। ভারতের কবি বিষ্ণু দে সাহিত্য এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকার প্রদত্ত ভাষা দিবস পুরস্কারও অর্জন করেছন। এসব পুরস্কার যা আমাদের সাহিত্যে দেশের সম্মান বয়ে এনেছে। মূলত বাংলা কাব্যে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন এই পুরস্কার মূলত তার কাব্যপ্রতিভারই স্বীকৃতি স্বাক্ষর রেখেছে। যদিও তিনি বিগত ৪ দশক ধরে কাব্যচর্চা করে চলেছেন। একমনে একধ্যানে নিরলসভাবে কবিতা লিখেছেন। এই মহান কবিকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জাতীয় কোনো পুরস্কারে (একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক) মনোনীত করা হয়নি। এমনকি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পর্যন্তও তাকে দেয়া হয়নি। কিন্তু কেন এমনটা তার বেলাতে করা হলো আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার না। হঁ্যা! এটা ঠিক যে কোনো পুরস্কারের লোভে কবিরা কবিতা লেখে না, কিন্তু ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো সম্মাননা দিলে দোষটা কোথায়। অথচ যারা জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাখে না দেখা গেছে যে, তাদেরই এসব পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আর এর জন্য দুষ্ট পতিত নষ্ট রাজনীতির হঠকারিতায় দায়ী। কোনো গুণী ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান দিলে কদর করলে সমাজের জন্য দেশের জন্য মানুষের জন্য ভালোই হয়। এখানে একটি কথা বলে রাখি, আমি রাষ্ট্র-সরকারের পক্ষে নই। আমি সব সময় দেশের, দেশের মানুষের আর সমাজের মঙ্গলের পক্ষে। কেননা, রাষ্ট্র-সরকার কখনো ভালো কাজের স্বীকৃতি তেমন দেয় না বললেই চলে। সৎ, যোগ্য, জ্ঞানী-গুণী ভালো মানুষের সমাদর করে না। এখানে শক্তিমান কবি শামসুর রাহমান দুষ্টদের দ্বারা আক্রান্ত হয়; কিন্তু তার প্রতি আক্রমনকারীদের কোনো বিচার হয় না। কবি হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদ দানবেরা চাপাতি দিয়ে আঘাত করে কিন্তু সেসব অসভ্য মানুষের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় না। প্রতিবাদী লেখক তসলিমা নাসরীনের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অজুহাত তুলে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার মতো জঘন্য কাজ করা হয়; কিন্তু ভন্ড প্রতারক রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার থাকে চুপ শুধু ভোটের রাজনীতির কারণে। ফলে রাষ্ট্র ভিন্ন ভিন্ন কালে মানুষকে ভয় দেখায়, স্বাধীনভাবে কথা বলতে নিষেধ করে, লেখকের গলা টিপে ধরে। কখনো কখনো পুলিশের লাঠি লেখকের পিঠে আছড়ে পড়ে। কলমের কালিকে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে বেঁধে দেয়ার মতো হীন হুকুম জারিও করে। বাংলাদেশ প্রধানত কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং দেশকে কৃষিকাজের মাধ্যমে এক উন্নত সমৃদ্ধ হিসেবে দেশকে আগামীর দিকে নিয়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করি, কৃষিকাজের মধ্যেই মূলত এ দেশের মানুষের প্রাণশক্তি নিহিত আছে এবং কৃষিকাজ ও কৃষকরাই দেশের চালিকাশক্তি। আর তাই বাংলাদেশের একান্তে পরিচয় প্রকাশ পায় বাংলাদেশের কৃষক, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। অবশ্য একথা কবি সমুদ্র গুপ্ত ব্যক্তিজীবনে তা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন এবং সেটা কবিতার পঙ্‌তিতে তুলেও ধরেছেন। 'বাংলার কৃষক' শীর্ষক কবিতায় কবি তার অনুভূতি এভাবেই প্রকাশ করেছেন- 'এইতো এখনো আছি মৃত্তিকার সঙ্গে ভালোবাসা মাটির নাড়ির সাথে জীবনের সরাসরি যোগ দুর্যোগ দুর্ভিক্ষে কিংবা বানে ও পস্নাবণে মাটির মমতা আমার প্রাণ ক্ষুধা ও খাদ্যেরই মতো মৃত্তিকাও আমাদের জীবনের অবিচ্ছিন্ন গান...।' কবি তার প্রিয়তমাকে এতটুকু সুন্দর বলবে না। এমনকি কোনো সুন্দরের সঙ্গে তাকে তুলনাও করবে না। কেননা, কবি তার প্রিয়ার সব সুন্দরকে অন্তর দিয়ে দেখেন। ত্রি-নয়ন দিয়ে উপভোগ করেন একান্তে ভালোবাসার মানুষের অস্তিত্বকে, যত সুন্দরকে সৃজনশীল আবেগময় প্রকাশকে। চারদিকে অনেক কিছু সুন্দর বিদ্যমান, আর এত সুন্দরের ভিড়ে শুধু প্রিয়তমাকে একাকী সুন্দর বলার ঝুঁকি কবি স্বার্থপরতার মতো কেন নিতে যাবে। কাজেই মুখে প্রশংসার সুন্দর কথাটি বলে কি লাভ হবে। কবির প্রেয়সী যে তার নিকট অনেক বেশি চেনা এবং তাকে গভীরতর পরশে জানে। ব্যক্তিগতভাবে কবি সমুদ্র গুপ্তকে তিনবার দেখেছি। প্রথমত ২০০৬ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট মন্ডলে কোনো এক শুক্রবার ম্যাজিক লণ্ঠনের সাপ্তাহিক সাহিত্য আসরে। প্রথম পরিচয়ে তিনি আমাকে আমার নাম-ধাম কোথায় বাড়ি আর কি বিষয় লেখালেখি করি ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। অনেকেই জানে যে, প্রথম দেখাতে যে কাউকে তিনি আপন কাছের করে নিতে পারত। শুভ্রকেশের ঋষিরূপের এই মানুষটি সেদিন বলেছিল অনেকদিন আগে ঝিকরগাছাতে তিনি একবার এসেছিলেন তার বন্ধুবর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক হোসেন উদ্দীন হোসেনের বাড়িতে। তারপরে কবির সঙ্গে দ্বিতীয় দেখা হয় ২০০৭ সালে কুষ্টিয়ায় বাউল সম্রাট ফকির মহাত্মা লালন শাহের ছেউড়িয়ার আখড়ায়। সেবার লালন শাহের তিরোধান দিবসে তার সঙ্গে লালন, ভাবতত্ত্ব ও গুরুবাদী বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা হয়েছিল। তার সঙ্গে কথা বলে সেদিন জানতে পেরেছিলাম, তিনি কতটা লালন ভক্ত মানুষ। আর সবশেষে কবি সমুদ্র গুপ্তের সঙ্গে দেখা হয় একুশের (২০০৮) বই মেলা ঢাকায়। এবং নতুন বই প্রকাশ ও কবিতা নিয়ে অনেক কথা হয়। কবি সমুদ্র গুপ্তের সারা জীবনে সর্বমোট ১৩টি কাব্যগ্রন্থ, ১টি গদ্য, একাধিক সম্পাদিত ও অনুবাদগ্রন্থ ছাড়াও অনেক সৃজনশীল লেখা প্রাকাশ হয়েছে। এমনকি তার কবিতা বাংলা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, ফারসি, হিন্দি, হিংহলি, উর্দু, জাপানি, চীনা, অসমীয়া ও নেপালি ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। কবি সমুদ্র গুপ্তের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- 'রোদ ঝলসানো মুখ (১৯৭৭)' 'স্বপ্নমঙ্গল কাব্য (১৯৮৭)' 'এখনো উত্থান আছে (১৯৯০)' 'চোখে চোখ রাখে (১৯৯১)' 'একাকী রোদ্রের দিকে (১৯৯২)' 'শেকড়ের শোকে (১৯৯৩)' 'ঘাসপাতার ছুরি (১৯৯৮)' 'খালি হয়ে গেছে মাথা শুধু ওড়ে' 'তাহলে উঠে দাঁড়াবো না কেন' 'চলো এবার গাছে উঠি' 'সাত সমুদ্র নদীও বাড়িতে ফেরে' 'হাতে হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায়' এবং 'ছড়িয়ে ছিনিয়ে সেই পথ' ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রবন্ধ নিবন্ধ সমালোচনা গদ্য সাহিত্য ও সম্পাদনা গ্রন্থ সবমিলে বেশকিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উলেস্নখ্য, বাংলা ভাষা বাংলা কাব্য এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান বোদ্ধা কবি সমুদ্র গুপ্ত গত ১০ মে ২০০৮ তারিখে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এবং এখানেই তার চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু সেখানে কবির রোগের চিকিৎসার কোনো উন্নতি না হওয়ায় আবার তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেও তার শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যথাযথ চিকিৎসা দিয়েও তেমন কোনো অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তখন ঢাকা 'জাতীয় কবিতা পরিষদ'-এর সহযোগিতায় ব্যবস্থাপনায় কবি সমুদ্র গুপ্তকে ৩ জুলাই ২০০৮ ভারতের ব্যাঙ্গালোর নারায়ণী হৃদয়লয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! একটানা সেখানে একমাস দশদিন চিকিৎসা চলাকালে মৃতু্যর সঙ্গে লড়তে লড়তে শেষ পর্যন্ত ১৯ জুলাই ২০০৮ শনিবার বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টায় বাংলা কাব্যে 'রোদ ঝলসানো মুখ'র কবি সমুদ্র গুপ্ত মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন। একজন কবিকেও সত্যি শেষ পর্যন্ত ভয়ানক মরণব্যাধি ক্যান্সার নামক এক জীবনহরণকারী হিংস্র দানবের কাছে হেরে যেতে হলো। নন্দিত জনপ্রিয় মননশীল সৃজনশীল প্রতিভাবান এই কবির মাত্র ৬২ বছরে তার মৃতু্যতে বাংলাদেশে কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি ও মঙ্গল কামনা করি। এটা ঠিক যে, কবি সমুদ্র গুপ্ত আজ আমাদের মাঝে নেই, একেবারে না ফেরার দেশে চলে গেছেন; কিন্তু তিনি তার সৃজনশীল বৈচিত্র্যময় সাহিত্যকর্মের জন্য বাঙালি পাঠক সমাজে মানুষের কাছে এবং কাব্যাকাশে যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। জয় হোক 'রোদ ঝলসানো মুখ'র কবি সমুদ্র গুপ্তের। বাঙালির জাতীয় জীবনে হৃদয়ের মাঝে 'একাকী রোদ্রের দিকে' হেঁটে যাওয়া প্রিয় কবি সমুদ্র গুপ্ত বাংলা কাব্যে বাংলা শব্দে বাংলা ছন্দে বাংলা ভাষাতে সতত জেগে থাকুক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে