শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন 'দ্য ওয়ার্ক অব ক্রিয়েশন'

আতা সরকার
  ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

সৃজনশীলতার মন সবসময় সরলরৈখিক নয়। এমন মন সবসময় সোজাসাপ্টাভাবে পাঠ করাও যায় না। ভাব, বলয় ও কল্পলোক জটিল রেখার আঁকিবুঁকিতে রঙের বহুমাত্রিক আবর্ত রচনা করে- ঢুকে পড়ে গভীর রহস্যময়তায়। শিল্পীর মন সৃষ্টির আনন্দ-বেদনায়, উলস্নাসে, উন্মাদনায় পূর্ণতায় হাহাকারে পরিপাটি ক্যানভাসে রং ও রংহীনতার বিশাল জগৎ সৃষ্টি করে ফেলেন যা বহুমাত্রিক ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে কিংবা ব্যাখ্যাহীনতাও। এ এক বিচিত্র উদ্ভাস। শিল্পবিপস্নবের কয়েক মাত্রা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রম্নত ধাবমান অভূতপূর্ব বিকাশ শিল্পীর মনকে যেমন আরও রহস্যকাতর করে তুলেছে, একইভাবে শিল্পকর্মকেও নান্দনিকতার উচ্চমাত্রায় তুলে নিয়ে জটিল মনোভাষ্যে রূপান্তরিত করেছে। তার ঢেউ আমাদের দেশের শিল্পজগৎ ও শিল্পমানসে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে- ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে। এখন তা শিল্পীর মন ও মননের সঙ্গে একীভূত হয়ে রয়েছে। এমন শিল্পকর্মের ধারায় শিল্প মূর্ত হয়ে উঠেছে বিমূর্ত ভাষ্যে। এ দেশে এখনকার সময়ে এমনধারার একজন অগ্রগণ্য শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন। তারই সৃষ্টির প্রদর্শনী চলছে বেঙ্গল শিল্পালয়ে 'দ্য ওয়ার্ক অব ক্রিয়েশন' শিরোনামে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমেই নতুনভাবে বিন্যস্ত বেঙ্গল শিল্পালয়ের যাত্রা শুরু। শিল্পে নিবেদিত দুই শিল্পীর নামে- মহান শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান এবং কর্মযোগী শিল্পী সুবীর চৌধুরীর স্মৃতিনামাঙ্কিত- এই দুই প্রদর্শনশালাতেই বিন্যস্ত হয়েছে চিত্রকর্মগুলো। যেভাবেই বিমূর্ত শিল্পধারার উত্থান ও বিকাশ হোক না কেন, তা এখন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পধারা। ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, এমনকি আফ্রিকার কোনো কোনো এলাকায় লেখক, কবি ও শিল্পীদের মনোভাব প্রকাশের শাণিত এই অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল গণভাষ্য ও মনোভঙ্গিকে উচ্চকিত করতে। কলাকবল্যবাদীরা একে আরেক মাত্রায় অধিষ্ঠিত করে। আর সমতালে আধুনিক মনস্ক শিল্পী তার তুলিতে এর বহুমাত্রিকতার সংযোজন ঘটায়। উত্তর-আধুনিকতার সীমানা পেরিয়ে গেলেও শিল্পকর্মে বিমূর্ত ধারা আরও গভীর ও ব্যঞ্জনাময় স্রোতের ধারায় বিকশিত হয়ে চলেছে। ভারতীয় শিল্পে বিমূর্ত ধারায় কাজ করে অনেকেই খ্যাতিমান হয়েছেন। বিশেষ করে বাসুদেব গাইটোন্ডে, সৈয়দ হায়দার রাজা, কৃষ্ণা রেড্ডি, নাসরীন মহম্মদী, স্বামী নাথন, জেরাম প্যাটেন। বাংলাদেশে এর চর্চা ষাটের দশকে শুরু হয়। কিন্তু বিমূর্ত ধারাকে আত্মস্থ ও তাৎপর্যমন্ডিত করে তোলেন শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। তারই ধারানুগমন করেন পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা। শিল্পী নিসার হোসেন এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে বলেন : "কিবরিয়া-পরবর্তী যে শিল্পীর চিত্রপটে 'আমরা সত্যের চেয়ে সৌন্দর্য, জ্ঞানের চেয়ে আনন্দ বেশি স্বর্গীয় বলে বোধ করি'- তিনি কাজী গিয়াস। তার চিত্রপটে অসীম-অজ্ঞাতলোক থেকে ক্রমাগত আত্মপ্রকাশ করতে থাকা অগণিত রূপসংকেতের এক মহাজাগতিক অভিযাত্রা অবলোকন করে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হই।" কাজী গিয়াসউদ্দিন (জন্ম: ১৯৫১/মাদারীপুর)। একজন কৃতী সফল শিল্পী হিসেবে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজের ও তার শিল্পকর্র্মের অবস্থান দৃঢ় করেছেন। শিল্পকলার উপর ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পরও তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যিনি টোকিও ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিক থেকে ফাইন আর্টসে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশের জন্যও তিনি আন্তর্জাতিক সম্মান বয়ে আনেন। জাপানের সম্রাট কর্তৃক গতবছরই তিনি 'অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান' সম্মাননায় ভূষিত হন। তরুণ বয়সেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে এককাতারে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে লেখা পটুয়া কামরুল হাসানের এক চিঠি থেকে জানা যায়, 'এর মধ্যে আমরা বাংলাদেশের শিল্পীরা চধরহঃরহম ঊীযরনরঃরড়হ করেছিলাম। নিতুন, দেবদাস, স্বপন চৌধুরী, মুস্তফা মনোয়ার, কাজী গিয়াস এবং আরও অনেকে- প্রায় কুড়িজন কলকাতায় আছে।' (সৈয়দ আজিজুল হক/কামরুল হাসান জীবন ও কর্ম: পৃ. ২২৬) কাজী গিয়াসউদ্দিন প্রকৃতির ভেতর সৃজনশীলতা অন্বেষণ করেছেন। তার গভীর নিবিষ্টতার প্রমাণ তার চিত্রকর্ম। নিঃসর্গের গভীরে প্রবিষ্ট হয়ে তিনি তার রূপ, রং, সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করেছেন। চৈতন্যবোধে ধারণ করেছেন। পরম সমতায় আহরণ করেছেন প্রকৃতির একেকটি উপকরণ। ক্যানভাসে তুলে এনেছেন মনোজগতের কল্পনা ভাষা বোধের মিশেল দিয়ে। তার চিত্রকের্ম রঙের ব্যবহার প্রকৃতির মতোই সাবলীল এবং পরিমিত। এতে ক্যানভাস নিঃসর্গের গাম্ভীর্যও ধারণ করে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধনকালে যথার্থই বলেছেন : 'অসাধারণ সূক্ষ্ণতা, রঙের সঙ্গত ব্যবহারের মধ্যদিয়ে তিনি নিজস্বতা তৈরি করেছেন। তার অনেক ছবিকে দূর থেকে অনেকটা গুহাচিত্রের মতো মনে হবে। কাছে এলে সূক্ষ্ণ কাজের সামগ্রিকতা উপলব্ধি করা যাবে।' কাজী গিয়াসউদ্দিনের দীর্ঘ নিষ্ঠার পরিচয় ধারণ করে প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে 'নিসর্গ-১' চিত্রটি। এ ছবিটি আঁকতে সময় নিয়েছেন বিশ বছর। এর মধ্যে আরও আরও ক্যানভাসে নিসর্গের সঙ্গে কথা হয়েছে অনেক। রং চড়িয়েছেন। আর এই ক্যানভাসটি বাঙ্ময় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। এর উপর রংতুলির শেষ আঁচড় পড়ে ২০১৭ সালে। শিল্পী নিসার হোসেনের মূল্যায়ন : 'গিয়াস যেন খুঁজে পান প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত, স্বয়ম্ভু ও স্বচারী বৈশিষ্ট্যগুলোকে এবং সৃষ্টির রহস্যভেদী বৃত্তান্তকে যেন আপনা থেকেই বর্ণিত হতে দেখেন চিত্রতলে রঞ্জক ও তরলের মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যে। এ দুইয়ের অন্তঃস্থিত চৌম্বক ক্ষেত্রের টানাপড়েনে, আকর্ষণ-বিকর্ষণে প্রায় আপনা থেকে হয়ে উঠতে থাকা রূপ সংকেতগুলোকে তিনি স্ব-উদ্ভাবিত এমন এক সূক্ষ্ণ-নিপুণ-সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ার চিত্রতলে স্থিতি দেন, যা পরম নিষ্ঠা, গভীর মনঃসংযোগ আর সুদীর্ঘ সাধনা ছাড়া আয়ত্ত করা যায় না।' শিল্পকলায় আধুনিক অভিযাত্রায় বাস্তবতা, মনোজগৎ, ক্যানভাস পটভূমি, রংতুলি প্রকরণ কাঠামো একীভূত হয়ে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও শক্তিকে উদ্ঘাটিত করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে