শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ সমকালীন সমাজ রাজনীতি

মিল্টন বিশ্বাস
  ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

রাশিদ আসকারী প্রধানত লেখক। যদিও তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। তবে পাঠকের কাছে ইংরেজি ভাষার প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি পরিচিত। অবশ্য একজন গল্পকার ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। অর্থাৎ সৃজনশীল ও মননশীল উভয় রাজ্যের লেখনিতে রাশিদ আসকারী সিদ্ধহস্ত। ২০১৯ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশ সমকালীন সমাজ রাজনীতি' গ্রন্থের ৪২টি বাংলা প্রবন্ধে রাশিদ আসকারী বাংলাদেশের অদম্য উন্নয়নের বিবরণ থেকে শুরু করে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সামাজিক অপরাধ, এমনকি রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে নিজস্ব বক্তব্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের অনন্য রূপকল্পগুলোর সূত্র ধরে লেখক একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন। মিলিয়েছেন নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রম্নতিসমূহ। 'বাংলাদেশ : উন্নয়নের পথে অদম্য', 'বাংলাদেশের নারী : অগ্রযাত্রায় অমসৃণ পথে', 'বাংলাদেশের অর্থনীতি : প্রাচ্যের বিস্ময়', 'উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা' প্রভৃতি এ বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ রচনা। অন্যদিকে রাজনীতি নিয়ে তার রয়েছে একাধিক প্রবন্ধ- 'সুষ্ঠু রাজনীতি বনাম ভ্রষ্ট রাজনীতি', 'রক্তাক্ত মার্চ আর চাই না', 'এক যুদ্ধহীন পৃথিবীর প্রত্যাশায়', 'রাজনীতির জন্য রাজনীতি, না মানুষের জন্য রাজনীতি', 'রাজনীতির ভাষা ও জনগণের ভাষা', 'রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির যন্ত্রণা', 'আমাদের রাজনৈতিক প্রত্যাশা', 'বিশ্বশান্তি ও বাংলাদেশ', 'হতাশা ও বিভ্রান্তির বিরোধী রাজনীতি', 'আগস্ট ট্র্যাজেডি' উলেস্নখযোগ্য। ব্যক্তিগত প্রবন্ধ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে 'বাবার মৃতু্য, হেপাটাইটিস সি ও জোট সরকার'। গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে লেখকের স্বতন্ত্র অভিমত প্রকাশিত হয়েছে এসব প্রবন্ধে- 'গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ', 'নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা', 'নির্বাচনে বৈষম্যমূলক প্রতীক বর্জনীয়' ও 'বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নের চ্যালেঞ্জ'। 'বাংলাদেশ সমকালীন সমাজ রাজনীতি' গ্রন্থে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক রাশিদ আসকারী ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে লিখেছেন একাধিক প্রবন্ধ। 'নোবেল সাহিত্যে নতুন ধারা', 'ভাষা মাসের ভাষা ভাবনা', 'সাহিত্যে সওদাগরবৃত্তি ও জিম্মি পাঠকরুচি' ব্যতিক্রমী রচনা। এ ছাড়া তার এই কলাম সংকলন গ্রন্থে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সচেতনতা, উচ্চশিক্ষা বিস্তারে একুশ শতকের বাস্তবতা, প্রশ্নফাঁস রোধ প্রসঙ্গ, মানবপাচার, ধর্ষণ, কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও সার্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। নারী জাতি কিংবা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অথবা হরিজন সম্পর্কে রাশিদ আসকারী মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসাধারণ কিছু কথা বলেছেন। এ ছাড়া বৈশাখ নিয়ে যেমন তার প্রবন্ধ রয়েছে তেমনি আছে 'মহাকাশে লাল-সবুজের পতাকা' অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে সপ্রশংসা বিশ্লেষণ। রাশিদ আসকারী রাজনীতি সচেতন ও প্রগতিমনস্ক। তার লেখনিতে রয়েছে বিশ্ব মানবতাবাদের ঐতিহ্য। এই একবিংশ শতাব্দীর বদলে যাওয়া পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তিনি তার কলামে যে পর্যালোচনা ব্যঞ্জিত করেছেন তা প্রাতিস্বিক হয়েও সমাজসংলগ্ন। কারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্র, সরকার ও শাসকের আচরণ নিয়ে ভেবেছেন তিনি, লিখেছেন ইতিবাচক ও মঙ্গলময় অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা। তার প্রবন্ধে আছে শাণিত বাগভঙ্গি, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের চিন্তা, ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণ যা একইসঙ্গে স্বাদেশিক ও আন্তর্জাতিক। একান্ত বাস্তব জীবনের চিত্রণের অনুপুঙ্খতায়, উৎপীড়িতের প্রতি গভীর সহমর্মিতা ও তাদের জন্য আশার সঞ্চয়ে সত্যিই এ লেখকের লেখনি সমৃদ্ধ। \হলেখকের মতে, প্রকৃত রাজনীতি, সুশাসন ও গণতন্ত্রে একটি দেশ সুখসমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে। তিনি নিজের দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসেন বলেই দেশের ভেতর জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করতে চান। সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রতি তার রয়েছে তীব্র ঘৃণা। তিনি রাজনীতিতে হানাহানির পরিবর্তে জাতীয় সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রত্যাশা করেন। স্বপ্ন দেখেন সুখী সমৃদ্ধময় বাংলাদেশের। লেখনিতে তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে উৎসুক হয়েছেন। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি তার অনুধ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বারবার মানবাধিকারের কথা বলেছেন। কারণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে 'মানবাধিকার' রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত। এ জন্য মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিশ্চিতকরণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাশিদ আসকারী 'হরিজন'দের অধিকার নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, 'শুধু সংবিধানে থাকলেই চলবে না। যথাযথভাবে প্রযুক্ত না হলে তা গ্রন্থগত বিদ্যা কিংবা পরহস্তের ধনের মতোই নিষ্ফলা থেকে যাবে।'(পৃ ১২৬) রাজনীতিতে ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে শাসককেই। মানবাধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করার উদ্দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ জাতীয় সংস্থাগুলোকেও ভালভাবে কাজ করানো দরকার। মানবাধিকার সুদৃঢ় করার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সংবিধান ও গণতন্ত্র সুরক্ষাসহ রাষ্ট্রবিরোধী সব অপতৎপরতা রোধে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারের প্রতিটি সংস্থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবয়ব হচ্ছে সময়োপযোগী, আধুনিক, জনবান্ধব ও সেবাধর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জীবনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানের অধিকার রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের। কারণ লেখকের মতে, 'রাজনীতি মানুষের জন্য। মানুষ রাজনীতির শিকার হয়ে চিরদিন থাকতে পারে না।'(পৃ ১১৫) রাষ্ট্র, সরকার, আইন-আদালত ও দেশের সব প্রতিষ্ঠানের কার্যধারা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা রাখেন রাশিদ আসকারী। এ জন্য তিনি প্রশাসনিক মঞ্জুরি, আর্থিক বরাদ্দ, আইন প্রণয়ন নিয়েও প্রবন্ধ লিখেছেন। সামাজিক সংকট নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন নানা মাত্রায়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এই প্রাবন্ধিক বারবারই সোচ্চার হয়েছেন শাণিত বাক্য বিন্যাসের মধ্য দিয়ে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ সভ্য আচরণ আশা করে। তারা পরাধীনতার মানসিকতা পরিত্যাগ করে স্বাধীনতার পরিচয় দেবে এটাই লেখকের প্রত্যাশা। সুখ শান্তি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ন্যায়বিচার, মৌলিক মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সংহতি, সত্য আর সুন্দরের পূজা করা। এ জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকার কথাও বারবার তিনি উচ্চারণ করেছেন 'আগস্ট ট্র্যাজেডি' এবং 'বাংলাদেশ ঘিরে ষড়যন্ত্র' শীর্ষক প্রবন্ধদ্বয়ে। আসলে প্রবন্ধগুলো নিবিড়ভাবে পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই লেখক রাশিদ আসকারী জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য চেয়েছেন, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে বিশ্বাসী তিনি। রাজনীতিতে হরতাল- ধর্মঘটের কালচার পরিহার করতে বলেছেন। সবক্ষেত্রে দেশের স্বার্থের কথা ভেবেছেন। তবে তিনি সাধারণ মানুষের কথা বলতে বেশি উৎসুক। দুর্বল ও সাধারণ মানুষের প্রতি লেখকের গভীর মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে অনেক প্রবন্ধে। তাঁর মতে, 'সব মিলে একটি পরমতসহিষ্ণু, সংবেদনশীল সরকারি দল এবং একটি গঠনমূলক অহিংস বিরোধী রাজনৈতিক ধারার সম্মিলন বর্তমানের সবচাইতে বড়ো রাজনৈতিক বাস্তবতা। হতাশা ও বিভ্রান্তির বিরোধী রাজনীতিকে না বলতে হবে।'(পৃ ১২২) মূলত রাশিদ আসকারী রচিত 'বাংলাদেশ সমকালীন সমাজ রাজনীতি' গ্রন্থটির প্রবন্ধগুলো সুখপাঠ্য এবং গভীর তাৎপর্যে অভিষিক্ত। লেখকের প্রাতিস্বিক স্বর ও অকাট্য যুক্তিবিন্যাস সত্যিই অভিনব। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য। 'বাংলাদেশ সমকালীন সমাজ রাজনীতি', রাশিদ আসকারী, প্রচ্ছদ : সোমা সুরভী জান্নাত, আগামী প্রকাশনী, ২০১৯, মূল্য : ৪০০ টাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে