শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরিষা ফুলের মধু যাচ্ছে বিদেশে

বাংলাদেশে বতর্মানে মৌচাষির সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। সারাদেশে ৩ থেকে ৫ হাজার টন মধু উৎপাদন হয়ে থাকে। এর কিছু অংশ রপ্তানি হলেও অনেক চাষিই সঠিকভাবে মধু সংগ্রহ না করায় চাহিদা থাকলেও রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া ফসলে কীটনাশক ব্যবহার করায় মৌমাছির মধু উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে বলে জানান মৌ-চাষ সংশ্লিষ্টরা...
মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে মৌচাষ শুরু হলেও দেশব্যাপী মৌচাষের সম্প্রসারণ ঘটে ১৯৮০ সাল থেকে। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বতর্মানে দেশে দেড় থেকে ২ হাজার দক্ষ অদক্ষ মৌচাষি এ পেশায় জড়িত রয়েছেন। সময়ের ব্যবধানে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে মৌচাষ। এক সময় বাংলাদেশে মধু বলতে সুন্দরবনের মধুকেই বোঝানো হতো। মৌয়ালদের সংগ্রহ করা ওই মধুর বিপণন দেশের গÐিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে পা রেখেছে বাংলাদেশের মধু। আর তা করতে গিয়ে মধু বা মৌ-চাষকেও সুন্দরবনের সীমানা থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে যেতে হয়েছে জেলায় জেলায়। টাঙ্গাইলও এর ব্যতিক্রম নয়।

টাঙ্গাইলের প্রায় সব জায়গায় এবার সরিষার আবাদ হয়েছে। সরিষা ক্ষেতের চারপাশে সারিবদ্ধভাবে মৌ-বাক্স বসানো হয়েছে। এসব বাক্সে পালিত মৌমাছি সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌ-বাক্সে জমা করছে। ওই মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা। টাঙ্গাইল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরিষার আবাদের জেলা হিসেবে পরিচিত। মৌচাষে চাষিরা একদিকে যেমন আথির্কভাবে লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে দূর হচ্ছে বেকারত্ব। ইদানিং অনেক শিক্ষাথীর্ই লেখাপড়ার পাশাপাশি লাভবান হওয়ার জন্য মৌচাষ করছে। মৌচাষিদের এই মধু এখন দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তবে চাষিদের দাবি সরকারের সহযোগিতা পেলে তারা এ মধুচাষের পরিধি আরও বাড়িয়ে অধিক লাভবান হতে পারেন।

সরিষা ফুলের মধু যেমন খঁাটি তেমনি সুস্বাদু। মধু উচ্চমাত্রার প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক হওয়ায় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ও ক্রেতাদের কাছে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সরেজমিনে টাঙ্গাইল শহর এবং ১২টি উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, সরিষা ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে মৌ-বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। আর মৌমাছিরা সরিষা থেকে মধু আহরণ করে বাক্সে জমা করছে। ওই বাক্স থেকে চাষিরা মধু সংগ্রহ করছেন। মৌ-বাক্সের চারদিকে মৌমাছি ভন্ ভন্- ভেঁা ভেঁা শব্দে ঘোরাঘুরি করছে। ওই স্থানে মৌমাছিদের মিলনমেলা তৈরি হয়েছে।

টাঙ্গাইল পৌর এলাকার সন্তোষ ঘোষপাড়ার আমিনুর রহমান বিগত ১০ বছর ধরে মৌচাষ করেন। তিনি এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তিনি বলেন, এ বছর আমি সরিষা ক্ষেতে শতাধিক মৌ-বাক্স স্থাপন করেছি। এখন পযর্ন্ত আমি (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি ১ সপ্তাহ) প্রায় দেড় টন মধু সংগ্রহ করতে পেরেছি। সরিষা ক্ষেতে বছরে ৪ মাস মধু আহরণ করে থাকেন। অন্য ৬ মাস কৃত্তিম পদ্ধতিতে চিনি খাইয়ে মৌমাছিদের রাখা হয়। এবার তার প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। তিনি আশা করছেন, তার প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন তাদের কাছ থেকে মধু কিনে নিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, সরিষা ক্ষেত থেকে মূলত ডিসেম্বর থেকে মধু আহরণের উপযুক্ত সময়। তখন জেলার বিভিন্ন স্থানে ভালো সরিষা ফুল ফোটে। আকার ভেদে একটি বাক্সে ২ থেকে ৪০ কেজি পযর্ন্ত মধু পাওয়া যায়। আর প্রতিটি বাক্সে খরচ হয় ২ থেকে ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া আমি লিচু থেকেও মধু সংগ্রহ করে থাকি।

আমিনুর রহমান বলেন, তার সংসারের যাবতীয় খরচের ওপর নিভর্রশীল। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমরা মৌ-চাষের পরিধি আরও বাড়িয়ে বেশি লাভবান হতে পারব। কিন্তু আমি বিগত সময়ে জেলা প্রশাসকের কাযার্লয় ও কৃষি অফিসে গিয়ে কোনো সহযোগিতা পাইনি।

অন্য মৌচাষি শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি এ পেশায় নিয়োজিত। এতে আমরা বেশ লাভবান হচ্ছি। আমাদের অনুকরণ করে অনেকেই সরিষা থেকে মৌ-বাক্সে মধু আহরণে আগ্রহী হচ্ছেন। সরিষা থেকে মধু আহরণে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হয়, অন্যদিকে অল্প সময়ের মধ্যে লাভবান হওয়া যায়। তিনি বলেন, অনেকেই প্রথমে সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ-বাক্স স্থাপনে বাধা দিলেও এখন কৃষকরা বাধা দেন না, তারা অনেক বেশি সচেতন। কারণ এর ফলে সরিষার ফলন বেড়ে যায়।

গোপালপুর উপজেলার সুন্দর গ্রামের মাছুম মিয়া, বাসাইলের আয়নাল হক, কালিহাতীর মিয়া চানসহ অনেক কৃষক বলেন, মৌ-বাক্স স্থাপনে সরিষার ফলন ভালো হচ্ছে। মৌচাষিদের ক্ষেতে মৌ-বাক্স স্থাপনে কোনো বাধা দেয়া হচ্ছে না। আগে বোঝার ভুলে কোনো কোনো কৃষক বাধা দিতেন, এখন সময় পাল্টেছে।

মৌচাষি ইয়াকুব আলী বলেন, আমাদের মৌমাছি কিনে আনতে হয়। আমি প্রথমে ৫টি মৌ-বাক্স নিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার মৌ-বাক্স ৫০টিরও বেশি। এই কয়েক মাসের উপাজর্ন দিয়ে সারা বছর চলে যায়। মধু সংগ্রহে লাভবান হওয়ার কারণে অনেকেই এই পেশায় চলে আসছে।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলায় এ বছর সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার হেক্টর জমি। কিন্তু প্রায় ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এতে প্রায় ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এ বছর জেলায় ৭ হাজার ২০০টি মৌ-বাক্স বসানোর টাগের্ট ছিল। কিন্তু সরিষা ক্ষেতের পাশে প্রায় ১০ হাজারের মতো বাক্স বসানো হয়েছে। যা টাগেের্টর চেয়ে বেশি। ডিসেম্বর পযর্ন্ত মধু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কেজি। আধুনিক প্রযুক্তি তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মধু আহরণ করা হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ বছর জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সরিষা আবাদ এবং মৌ-বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এখন পযর্ন্ত প্রায় ৮০ হাজার কেজি মধু উৎপাদন হয়েছে। সামনে আরও মধু উৎপাদন হবে। তিনি বলেন, বিস্তীণর্ এলাকার সরিষা ক্ষেতে মৌ-বাক্স স্থাপন করেছে মৌচাষিরা। এতে একদিকে মৌচাষিরা কাক্সিক্ষত পরিমাণে মধু সংগ্রহ করে লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে স্থানীয় কৃষিজমিতে সরিষার ফলনও অন্য বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও জানান, মধু ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এখানকার মধু দেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও বিদেশেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই দেশীয় এ খঁাটি মধু বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌচাষ করলে সরিষার পরাগায়ণের ফলে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ফলন বৃদ্ধি পায়। কয়েক বছর আগেও সরিষাচাষিরা তাদের জমিতে মৌ-বাক্স স্থাপনে বাধা দিত। তাদের ধারণা ছিল মৌমাছির কারণে সরিষার ফলন কম হবে। তবে কৃষি কমর্কতার্রা বোঝাতে সক্ষম হন মৌচাষের কারণে সরিষার ফলন কম তো নয়ই বরং ফলন ভালো হয়। এরপর চাষিরা তাদের জমির পাশে মৌ-বাক্স স্থাপনে সহায়তা করে আসছেন।

বতর্মানে দেশের চাহিদার ৭০ শতাংশ মধু আমদানি করতে হয়। কিন্তু মধু উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতের দক্ষতা বাড়ালে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মধু রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করছেন প্রিজম বাংলাদেশের মৌ-চাষ প্রকল্পের সিনিয়র এক্সপাটর্ মাতেজা ডামেস্টিয়া। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বতর্মানে মৌচাষির সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। সারা দেশে ৩ থেকে ৫ হাজার টন মধু উৎপাদন হয়ে থাকে। এর কিছু অংশ রপ্তানি হলেও অনেক চাষিই সঠিকভাবে মধু সংগ্রহ না করায় চাহিদা থাকলেও রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া ফসলে কীটনাশক ব্যবহার করায় মৌমাছির মধু উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31799 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1