বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবতর্নশীল কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তথ্যপ্রযুক্তি

মো. আব্দুল মানিক
  ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

আমাদের কৃষ্টি কৃষি; কালচার এগ্রিকালচার। বাংলাদেশ একটি অমিত সম্ভাবনাময় কৃষি প্রধান দেশ। মোট জনসংখ্যার ৬৬% লোক এখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত এবং জাতীয় আয়ের প্রায় ২০% আসে কৃষি খাত থেকে। স্বাধীনতার সময় আমাদের লোকসংখ্যা ছিল ৭.৫ কোটি, খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোট মেট্রিক টন। বতর্মানে লোকসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। মানুষ বেড়েছে দুই গুণ কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। এখন খাদ্য উৎপাদন হয় প্রায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ টন। কৃষি, মৎস্য, পোল্ট্রি, ডেইরি ক্ষেত্রেও আমাদের অজর্ন ঈষর্ণীয়। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আমরা খাদ্যে ঝুড়ি উপচিয়ে পড়া দেশে; প্রায় স্বয়ংসম্পূণের্র দ্বারপ্রান্তে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে উন্নত ফসলের জাত, এগ-অগাির্নজম, সেচ ব্যবস্থা, আবহাওয়া, সবই কৃষি উৎপাদনের মূল ফ্যাক্টর। সারা পৃথিবীতে জলবায়ুজনিত পরিবতের্নর সঙ্গে কৃষি উৎপাদনের অন্য ফ্যাক্টরগুলোও পরিবতর্নশীল; মানুষের জন্য হুমকি। তাপমাত্রার পরিবতের্ন শস্যের জীবনকাল বা বৃদ্ধিকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তাই অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন, পানির অভাব, নতুন/পরিবতর্নীয় পোকামাকড়-রোগবালাইয়ের কারণে শস্য উৎপাদন অনেকাংশে কমে যাবে। ফলে বিশ্বব্যাপী দেখা দেবে খাদ্যাভাব। জলবায়ু এ পরিবতের্ন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকায় খরার প্রকোপ আরও বাড়বে। শুধু তাই নয়, আমাদের গবর্ সুন্দরবনও সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকিপূণর্। পরিবতির্ত এ পরিস্থিতিতে গরমকালে প্রচÐ তাপদাহ, আবার শীতের প্রকোপ এবং শীতকালে শীতের তীব্রতা এবং কোনো কোনো সময় অনাকাক্সিক্ষত গরম পড়া, শীতকালে মুষলধারে বৃষ্টি পড়া, বৃষ্টির দিনে কম বৃষ্টি, অকাল বন্যা, বন্যার দীঘর্স্থায়ী অবস্থান, শিলাবৃষ্টি এ দেশের আবহমান আবহাওয়ার পরিবতের্নর ইঙ্গিত বহন করছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের সবর্ উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে ১০-১২ বছর ধরে অস্বাভাবিক শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ধানে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। শ্রীমঙ্গল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অতীতে এ দেশে প্রায় আট হাজার প্রজাতির ধান উৎপাদিত হতো। এখন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে এসব জাত। আগামী ৫০ বছরে ধানের উৎপাদন এক-দশমাংশ কমার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এভাবে বিলুপ্ত হতে পারে আলুর বিভিন্ন প্রজাতির এক-চতুথার্ংশ। এছাড়া ২০ শতাংশের বেশি মাছের প্রজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে ১৭টি নদী। বিশ্ব জলবায়ুসংক্রান্ত ঝুঁকি-২০০৬-এর মূল্যায়নে যে ১০টি দেশকে সবাির্ধক ঝুঁকিপূণর্ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশ সে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে এবং হন্ডুরাস রয়েছে প্রথম স্থানে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আইনুন নিশাতের মতে জলবায়ু পরিবতের্নর লক্ষণগুলো হলোÑ বষার্য় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়া, সঠিক সময়ে শীত শুরু না হওয়া, শীতের প্রকোপ কমে যাওয়া, শীতকালের দৈঘর্্য কমে যাওয়া, প্রতিবছর তাপমাত্রা অল্প করে বৃদ্ধি পাওয়া, আগাম পানি আসা, পানির চাপ বাড়া ইত্যাদি।

জলবায়ু গবেষকদের মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের জলবায়ুর যে অবস্থা দঁাড়াবে তাতে গরমকালে গড় তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে এবং শীতকালে ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমবে। গরমকালে গড় বৃষ্টিপাত বাড়বে শতকরা ১১ ভাগ কিন্তু শীতকালে কমবে শতকরা ৩ ভাগ। গরমকালে গড় বাষ্পীভবন বাড়বে শতকরা ১৮.৮ ভাগ এবং শীতকালে বাড়বে শতকরা ০.৯ ভাগ। জলবায়ু পরিবতের্নর কারণে দেশে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে রয়েছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে বীজ গজানো, পরাগায়ণ, ফুল ও ফল ধরা, পরিপক্বতা হতে সুনিদির্ষ্ট তাপমাত্রা, আদ্রর্তা, বৃষ্টিপাত ও সূযাের্লাক প্রয়োজন। জলবায়ুর এ উপাদানগুলো পরিবধির্ত হয়েছে কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবতর্ন সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষি মৌসুমের সঙ্গে ফসল চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে গম, ছোলা, মসুর, মুগডালসহ কিছু কিছু ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকরাও এসব চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। গমের বীজ গজানোর তাপমাত্রা হলো ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কম বেশি হলে বীজ গজাবে না। বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর প্রকাশিত টাস্কফোসর্ রিপোটর্ থেকে জানা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল পযর্ন্ত এক মিটার বাড়তে পারে। এর প্রভাবে তিন হাজার মিলিয়ন হেক্টর উবর্র জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যাবে, ২০০ মিলিয়ন টন ধান, গম, আখ, পাট, মটরসহ রবিশস্য উৎপাদন কমে যাবে।

বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা প্রকৃতিনিভর্র। ৭০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নিভর্রশীল। দেশে মোট উৎপাদনের প্রায় ২৪% আসে কৃষি থেকে। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ৪%। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সবুজ বিপ্লবের ফলে তথা নানারকম ফসলের জাত উন্নয়নে গত ৫০ বছরে দানাশস্যের ফলন বেড়েছে কয়েকগুণ। উচ্চফলনশীল ধান ও গমের জাতের সূচনার ফলে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। প্রযুক্তি প্রয়োগে কৃষির অন্যান্য শাখা তথা পোল্ট্রি, গবাদিপশু ও মৎস্য চাষেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নে কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিশাল এবং গুরুত্বপূণর্ প্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্র। বতর্মান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতিতে পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়নে কৃষি গবেষণা কাযর্ক্রমকে জোরদার করার ওপর যথাথর্ গুরুত্বারোপ করেছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

কৃষি গবেষণায় উদ্ভাবিত নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে প্রান্তিক চাষিদের কাছে পৌঁছানোর ওপর কৃষি উন্নয়ন অনেকাংশে নিভর্রশীল। আমাদের দেশের গবেষণাগারে উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তির অধিকাংশই কৃষকের মাঠে প্রয়োগের আগে বা অব্যবহিত পরই জীবনকাল হারায়। উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তিকে প্রকৃত ব্যবহার করতে হবে। কৃষকের খামারে। মাঠে দ্রæত পৌঁছাতে বতর্মান কৃষি সম্প্রসারণ কৌশল এবং মোবাইল ফোন সংযোজনের মাধ্যমে ইলেকবট্রনিক্স এগ্রিকালচার তথা ই-কৃষির প্রচলন প্রয়োজন।

কৃষি বাংলাদেশের অথৈর্নতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। আর কৃষির উন্নয়ন বহুলাংশে নিভর্র করে তথ্য ও প্রযুক্তির সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবহারের ওপর। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়ন তো বটেই, পরিবতর্নশীল কৃষি উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্। কেননা বিশ্ব এখন তথ্য প্রযুক্তির ওপর নিভর্রশীল। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন কৃষিজ প্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে এসব প্রতিষ্ঠানের ভ‚মিকা সম্পকের্ আলোচনা করা যাক।

আশার কথা এই যে, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল বা ই-কৃষি উদ্যোগের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও কাজে লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে। যেমন-রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ্ তার নিজ গ্রাম নওগঁার মান্দা উপজেলার কালিগ্রামে ২০০৮ সালে িি.িশৎরংযরষরনৎধৎু.পড়স নামক ওয়েবসাইট ও কৃষকদের জন্য গ্রন্থাগার চালু করেছেন, এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কৃষক তার প্রয়োজনীয় যে কোনো ধরনের তথ্য পাচ্ছেন।

পরিবতর্নশীল কৃষি উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বিত ব্যবহারে বাংলাদেশের কৃষিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রণী ভ‚মিকা রাখছে। তবে এর সুফল কৃষকপযাের্য় নিবিড়ভাবে অদ্যাবধি পৌঁছায়নি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কাজ করতে হবে নিজেদেরই স্বাথের্, ভবিষ্যতের প্রশ্নেও উন্নয়নের স্বাথের্ই। এ লক্ষ্যে সবাইকে কোমর বেঁধে কাজ করতে হবে।

লেখক-ব্যবস্থাপক, সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনবার্সন কেন্দ্র, বারপুর, বগুড়া

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<32911 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1