বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ-২০১৯

কোনো জাল ফেলব না জাটকা ইলিশ ধরব না

কৃষিবিদ মো. সামছুল আলম
  ১০ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

জাতীয় মাছ ইলিশ আমাদের দেশের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। অনাদিকাল থেকেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আমিষজাতীয় খাদ্য সরবরাহে এ মাছ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বাঙালির দেশপ্রেম যতখানি, ইলিশপ্রেম তার চেয়ে কম নয়। তাই তো সম্প্রতি দেশের কয়েকটি জেলার নাম ব্র্যান্ডিং হয়েছে ইলিশের নামের সংশ্লিষ্টতায়। এ বাংলায় বাঙালির বর্ষবরণ থেকে শুরু করে ঘরোয়া অনুষ্ঠান যেমন ইলিশ ছাড়া হয় না, তেমনি ওপার বাংলায়ও জামাইষষ্ঠীতে ইলিশ লাগে। তা ছাড়া সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ বাঙালিও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ইলিশ খেতে ভোলে না। কিন্তু এত স্বাদের মাছটি দিন দিন হয়ে যাচ্ছে দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য। আর দুষ্প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্যতাকে জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য করতে সরকার দেশব্যাপী নানান কর্মসূচির আয়োজন করে আসছে। এসব কর্মসূচির আওতায় এবারও ১৬ মার্চ থেকে ২২ মার্চ ২০১৯ মেয়াদে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপিত হবে। জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'কোনো জাল ফেলবো না- জাটকা ইলিশ ধরবো না'। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাটকা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়াই এ সপ্তাহের মূল উদ্দেশ্য।

ইলিশের ডিম পরস্ফুটনের মাধ্যমে ইলিশের বাচ্চা 'জাটকা' তৈরি হয়। ইলিশের পোনাকে (১০ ইঞ্চি/ ২৫সেন্টিমিটারের নিচে) জাটকা বলা হয়। আজকের জাটকাই আগামী দিনের ইলিশ। জাটকা নির্বিচারে ধরা হলে ইলিশের উৎপাদন কমে যায়। জাটকা নদ-নদীতে বিচরণ করে। তখন জেলেরা নির্বিচারে জাটকা আহরণ করতে চায়। নির্বিচারে জাটকা ধরা হলে ইলিশ উৎপাদন ও আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা জাটকা মাছ ইলিশ মাছের নতুন প্রজন্মের প্রবেশন স্তর।

ইলিশের জীবনচক্র বেশ বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। একটি ইলিশ তিন থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারের পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে গমন করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশমাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে। ইলিশমাছ সারা বছরই কম-বেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এ জন্য আশ্বিনের বড় পূণির্মার আগের চারদিন, পূর্ণিমার দিন এবং পরের ১৭ দিন (৪+১+১৭) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তাই এ লক্ষ্যে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম অর্থাৎ গত বছরও ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন প্রজননক্ষেত্রের ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ এবং ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার।

২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারের এমন উদ্যোগে বিগত ৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ- যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। গত ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন বাংলাদেশের।

ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের জন্য চিহ্নিত এলাকাগুলো হচ্ছে বরিশাল জেলার সদর ও হিজলা উপজেলার কালাবদর নদীর ১৩.১৪ বর্গকিলোমিটার, মেহেদিগঞ্জ ও হিজলা উপজেলার গজারিয়া ও মেঘনা নদীর যথাক্রমে ৩০ এবং ২৭৪.৮৬ বর্গকিলোমিটার। প্রস্তাবিত ষষ্ঠ অভয়াশ্রম এলাকার নদীগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৮২ কিলোমিটার এবং আয়তন ৩১৮ বর্গকিলোমিটার। প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে এ এলাকায়ও মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশমাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে।

ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বর্তমান সরকারের নানান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে। এসব কর্মসূচির আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জাটকাসমৃদ্ধ ১৭ জেলার ৮৫টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৪টি জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৪ মাসের জন্য মোট ৩৯ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন চাল প্রদান করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময় ছাড়াও বিগত দুই অর্থবছরে মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন ২২ দিনের জন্য পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে মোট ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬২টি পরিবারকে মোট ১৪ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং গবেষণা প্রকল্পের আওতায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩২ হাজার ৫০৯ জন সুফলভোগীকে জাটকা ও পরিপক্ব ইলিশ সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, ভ্যান/ রিকশা চালানো, সেলাই মেশিন, ইলিশ ধরার জাল প্রদান, খাঁচাই মাছচাষ ইত্যাদি আয়মূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। তা ছাড়া প্রকৃত মৎস্যজীবী ও জেলেদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে ১৬ লাখ ২০ হাজার মৎস্যজীবী ও জেলেদের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে এবং ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলের মাঝে পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশে মোট মাছ উৎপাদনেও বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টন, ইলিশ উৎপাদন ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। দেশে মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান ১২%। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ হাজার কোটি টাকারও ঊর্ধ্বে। জিডিপিতে ইলিশমাছের অবদান বর্তমানে ১%। দেশের মোট উৎপাদনে মৎস্যচাষের অবদান ৫৬ দশমিক ২৪ শতাংশ।

গত ১০ বছরে মৎস্যখাতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এভাবে উৎপাদন হলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে মাছে বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বর অবস্থানে যাবে বলে জানিয়েছেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক ড. কৃষ্ণা গায়েন। তাছাড়া সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে উঠে এসেছে, মৎস্যখাতে ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এ খাতে গত ১০ বছরে গড়ে বর্াষিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ মানুষের। তজিডিপিতে মৎস্যখাতের অবদান ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে এ খাতের অবদান ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।

বিগত বছরে ইলিশ উৎপাদনের সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পারছে, জাটকা ও মা ইলিশ সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিতহারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এজন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা করছে। ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে এটি একটি ইতিবাচক দিক।

লেখক: গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও

প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্যভবন, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<40212 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1