বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হরমোনের বিকল্প ভেষজ পস্ন্যানটেইন

কৃষি ও সম্ভাবনা ডেস্ক
  ১২ মে ২০১৯, ০০:০০

দেশি জাতের মুরগির উচ্চমূল্য ও উৎপাদন স্বল্পতার কারণে প্রাণিজ আমিষের বড় একটি অংশ পূরণ হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি দিয়ে। অল্প সময়ে অধিক মাংস উৎপাদনে ব্রয়লার মুরগিতে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা গ্রোথ প্রোমোটর (বৃদ্ধিবর্ধক পদার্থ) ব্যবহার করেন বহু খামারি। ফলে এই মাংস থেকে মানবদেহে ভারী ধাতু ও ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশের আশঙ্কায় ব্রয়লার মুরগি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু ক্ষতিকর কোনো হরমোন ব্যবহার না করে পস্ন্যানটেইন নামের এক প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করেই কম সময়ে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। চার বছর ধরে এ সংক্রান্ত গবেষণা করে সফল হয়েছেন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ আল-মামুন। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল পশুপুষ্টি গবেষণাগারে প্যানেল টেস্টের মাধ্যমে গবেষণায় সফলতার কথা জানালেন তিনি। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত মাংসের পুষ্টিগুণ তুলনামূলক বেশি বলে দাবি করেছেন পশুপালন অনুষদের পশুপুষ্টি বিভাগের এই অধ্যাপক।

গবেষক আল-মামুন বলেন, 'ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা হরমোন উৎপাদন বৃদ্ধি করলেও প্রাণিদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। এ থেকে উৎপাদিত পশুপণ্য অর্থাৎ মাংস, দুধ কিংবা ডিম গ্রহণের ফলে মানুষের শরীরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অটিজমসহ বিভিন্ন ভয়াবহ রোগ দেখা দিতে পারে। উন্নত দেশে এসব হরমোন নিষিদ্ধ হলেও আমাদের দেশে ব্যবহার হয়ে আসছে। ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ২০০৪ সালে জাপানে সর্বপ্রথম পস্ন্যানটেইন উদ্ভিদের ওপর গবেষণা শুরু করি।'

আল-মামুন আরও বলেন, দীর্ঘ গবেষণায় এর আগে গবাদিপশু (গরু ও ভেড়া) মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর গ্রোথ হরমোনের বিকল্প হিসেবে পস্ন্যানটেইন ঘাস ব্যবহারে সফল হই। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম ও সহজলভ্য ব্রয়লার মুরগির মাংস গ্রহণে মানুষের অনীহা সৃষ্টির বিষয়টি অনুধাবন করে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করি। মজার ব্যাপার হলো- পস্ন্যানটেইন ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রয়লার মাংসের পুষ্টিগুণও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মাংসের চেয়ে এতে মানবদেহের উপকারী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে ওমেগা ৩-এর পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। ওমেগা ৩ একটি ফ্যাটি এসিড, যা মানবদেহে ক্ষতিকর চর্বির পরিমাণ কমিয়ে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, চোখের ছানি, স্মৃতিভ্রম এবং অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেয়।

আল-মামুন বলেন, পস্ন্যানটেইন চষধহঃধমড় ষধহপবড়ষধঃধ একটি বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় বিরুৎ উদ্ভিদ। ২০১১ সালে বাংলাদেশে পস্ন্যানটেইন নিয়ে গবেষণা শুরুর ৩ বছর পর এই উদ্ভিদকে অভিযোজিত ও চাষ-উপযোগী করতে সক্ষম হই। ২০১৭ সালে থেকে আমার নিজ জেলা মানিকগঞ্জে কৃষকপর্যায়ে পস্ন্যানটেইন ঘাস উৎপাদন ও খামারিপর্যায়ে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতি একর জমিতে ১২ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়, যা দিয়ে ৪ লাখ ২০ হাজার ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন সম্ভব।

উৎপাদন খরচ সম্পর্কে গবেষক বলেন, ব্রয়লার মুরগিকে সতেজ ও শুকনো পাতা এবং পাতার পাউডার খাওয়ানো যায়। ২৮ দিন বয়সের একটি ব্রয়লার মুরগিতে অ্যান্টিবায়োটিক বা হরমোনবাবদ যেখানে ৫ টাকা খরচ হয়, সেখানে গবেষণায় পস্ন্যানটেইন খাওয়ানো প্রতি মুরগিতে খরচ মাত্র ২ টাকা ২১ পয়সা, যা মাথাপিছু মুরগি উৎপাদন খরচ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। গবেষণায় পস্ন্যানটেইন খাওয়ানো মুরগিতে মৃতু্যহার অনেক কম পাওয়া গেছে। মাংসে ক্ষতিকর চর্বির পরিমাণ কম, মাংসের স্বাদ ও লালচে রং তুলনামূলক বেশি এবং মাংস ও হাড় সাধারণ ব্রয়লারের অপেক্ষা শক্ত প্রকৃতির।

গবেষক আল-মামুন জাপানের ইউয়াতে ইউনিভার্সিটি থেকে গবেষণায় সাফল্যের জন্য প্রেসিডেন্ট ও ডিন অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। ২০০৯ সালে জাপানে এবং ২০১৩ সালে চীনে তিনি সেরা তরুণ গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। পস্ন্যানটেইন নিয়ে গবেষণা বিভিন্ন ধাপ ১২টি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপন করেছেন। ইতোমধ্যে সাতটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে বাউ-পস্ন্যানটিভ প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষকের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকের দাবি, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ মাংস উৎপাদন করলে প্রাণিজ আমিষ হিসেবে ব্রয়লার মুরগির মাংসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।

পশুপুষ্টি বিভাগের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য মো. জসিমউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে 'প্যানেল টেস্ট অব ফাংশনাল ব্রয়লার মিট' অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য মো. আলী আকবর। উপাচার্য বলেন, প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করতে ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার বিকল্প নেই। খামারিরা এ প্রক্রিয়ায় ব্রয়লার উৎপাদন করলে সচেতন মানুষ নির্দ্বিধায় মাংস খেতে পারবেন। সরকার বাণিজ্যিকভাবে পস্ন্যানটেইন চাষের উদ্যোগ নিলে খামারিরা নিরাপদ মাংস উৎপাদনে উৎসাহী হবেন।

প্যানেল টেস্টে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স, এসিআই ও আফতাব বহুমুখী ফার্ম লিমিটেডের কর্মকর্তা, উদ্যোক্তা এবং পোল্ট্রি খামারিরা অংশ নেন। পরে তারা গবেষণা পোল্ট্রি খামার পরিদর্শন করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<48959 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1