শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিতে পানি সাশ্রয়ী চাষাবাদ প্রযুক্তি

নতুনধারা
  ২৬ মে ২০১৯, ০০:০০

খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম

দেশের উত্তরাঞ্চলসহ কোথাও কোথাও আবাদি মৌসুমে খরা সৃষ্টি হয়। সে সময়ে ফসল চাষে সেচের প্রয়োজন হয়। কৃষকরা বিভিন্ন উৎস থেকে সেচের পানি সংগ্রহ করেন। এতে ভূ-নিম্নস্থ পানির উৎসই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফসল আবাদে যে উৎস থেকেই পানি ব্যবহার করা হোক না কেন যদি সঠিক পরিমাণ পানি ফসলের জন্য সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন পানির সাশ্রয় করা সম্ভব হবে তেমনি অর্থের অপচয়ও কম হবে। এজন্য কৃষি কাজে বা ফসল চাষে প্রচলিত ও অপ্রচলিত সেচ ব্যবস্থাগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেচের পানি সাশ্রয়ে বেশকিছু সেচ পদ্ধতি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- ড্রিপ পদ্ধতি, ভূ-নিম্নস্থ সেচ নালা পদ্ধতি, ফিতা পাইপ ব্যবহার ও পাকা সেচ নালা ইত্যাদি।

ড্রিপ সেচ

ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে গাছের মূলের কাছাকাছি সরাসরি পানি পৌঁছে দেয়া হয়। এতে পানির বাষ্পায়ন কমে পানির অপচয় কম হয়। ড্রিপ পদ্ধতিতে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে যদি ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরা নির্দিষ্ট সময় পরপর সেট করে দেয়, তাহলে পানির অপচয় কম হয়। যেমন-সকালে যখন ঠান্ডা পরিবেশ থাকে তখন ফোঁটার সংখ্যা কম এবং দুপুরে রোদ থাকলে ফোঁটার সংখ্যা বাড়ানো অথবা রাতে বন্ধ করে রাখা। যদি সঠিকভাবে ড্রিপ সেচ পদ্ধতিটি স্থাপন ও পানি সেচ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে প্রথাগত সেচ পদ্ধতির চেয়ে ৮০% পর্যন্ত পানির সাশ্রয় করা সম্ভব হতে পারে।

ভূ-নিম্নস্থ সেচ নালা

এই পদ্ধতিতে পানি সেচ দিলে ভূ-উপরিস্থ পানির বাষ্পায়ন কম হয় ও ফসলের শিকড়ের কাছাকাছি সেচের পানি পৌঁছানো সম্ভব হওয়ায় সেচের পানির সাশ্রয় হয়। এ ছাড়া মাটি ও পুষ্টি উপাদানের অপচয় হয় না, মূলের কাছাকাছি পুষ্টি উপাদান প্রয়োগ করা যায়, আগাছা কম জন্মায়, ফসলে রোগ কম হয়, ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমিক ও সেচ খরচ কম লাগে। এ পদ্ধতির অসুবিধা হলো প্রাথমিকভাবে স্থাপন খরচ বেশি লাগে, কাদায় পাইপের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা পাইপ ছিদ্র হতে পারে। এ জন্য কিছুদিন পরপর পাইপের মধ্যে পানিপ্রবাহ দিয়ে পরীক্ষা করতে হয়।

ফিতা পাইপ

এটি দিয়ে সাধারণত অগভীর নলকূপের পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হয়। ফিতা পাইপের সুবিধা হলো, সেচ নালা না থাকলেও এটি ব্যবহার করে জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়। খরাপ্রবণ এলাকায় ফিতাপাইপ ব্যবহার করে সেচ প্রদান করলে উৎস থেকে দূরবর্তী নির্দিষ্ট স্থানে অপচয় ছাড়াই সেচের পানি পৌঁছানো যায়। পাকা সেচ নালা দিয়ে পানির অপচয় হয় না বললেই চলে। তবে পাকা সেচ নালা স্থায়ী হলেও নির্মাণ ব্যয় বেশি এবং জমিও নষ্ট হয়।

সেচের জন্য পানি সংরক্ষণ

অনেক কৃষকই ফসল উৎপাদনে সেচের পানির জন্য অগভীর বা গভীর নলকূপের পানির ওপর নির্ভরশীল। স্বল্পসংখ্যক কৃষক পুকুর বা খাল-বিলের পানি ব্যবহার করে থাকে, যা মূলত বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির পানি। যদি এসব পুকুরও খাল-বিল সংস্কার করে দীর্ঘ সময় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার উপযোগী করে তোলা যায়, তাহলে শুকনো মৌসুমে এই পানি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে সেচবাবদ খরচ কমবে। বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট ছোট নদী এবং খাল খনন করা হচ্ছে অনেক স্থানের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য অথবা সেচের পানি সরবরাহ করার জন্য। দেশের উত্তরাঞ্চলে এসব খনন করা ছোট ছোট নদী ও খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন সহজ হলেও খরার মৌসুমে অর্থাৎ কখনো কখনো বর্ষার শেষ ভাগে ও শীতের সময়ে এসব ছোট নদীতে ও খালে পানি না থাকায় শীতকালীন বা রবি মৌসুমের ফসল চাষে কৃষকদের সেচের পানি প্রাপ্তিতে বিশেষ সুবিধা হয় না। যদি এসব ছোট নদী ও খালে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে রবি মৌসুমে বোরো ধান, ভুট্টা, গম, শাক-সবজি এবং ফল বাগানে প্রয়োজনীয় পানি সেচ প্রদান করা যেতে পারে।

স্মার্ট সেচ ব্যবস্থাপনা

বর্তমানে স্মার্ট কথাটি খুব বেশি ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে। সেচের কাজেও 'স্মার্ট সেচ ব্যবস্থাপনা' প্রয়োগ করা যায়। তবে এটি এমন নয় যে, কেমন করে সেচ প্রদান করা হবে, বরং কখন, কীভাবে ও কি পরিমাণে ঠিক কোথায় কোন প্রয়োজনে সেচ প্রদান করা হবে সেটিরই ধারণা দেয়। ফসলে প্রয়োজনের চেয়ে কম বা বেশি পানি সেচ দিতে কৃষক আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে সঠিকভাবে অনুসরণ করবে, সে সঙ্গে মাটির রসের অবস্থা বা জো অবস্থা বিবেচনা করে এবং গাছের বয়স ও বৃদ্ধির ধরন অনুযায়ী বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পানির চাহিদা বুঝে সেচের পানির পরিমাণ নির্ধারণ করবে। ফল বাগানে রাতের বেলায় যদি সেচ দেয়া যায় তাহলে পানির বাষ্পায়ন কম হবে এবং এবং পানি মাটির নিচে চুইয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বেশি হবে। অর্থাৎ মাটির জো অবস্থা তৈরি সহজ হবে। এতে মাটিতে প্রয়োগ করা সার সহজে গাছের গ্রহণ উপযোগী অবস্থায় আসবে।

খরাসহিষ্ণু ফসল আবাদ

কোনো একটি অঞ্চলে যেসব ফসল চাষ হয়, সেসব ফসলের সব বা কোনো কোনোটি ওই অঞ্চলের উপযোগী কিংবা কৃষকরা সেসব ফসল থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলন বা কাঙ্ক্ষিত মোট উৎপাদন পায় কিনা, তা হিসাব করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ফসল চাষে বিভিন্ন উপকরণ ব্যয়ের পাশাপাশি সেচের জন্য ব্যয় কত তা বের করা প্রয়োজন। খরাসহিষ্ণু ফসল হিসেবে বাংলাদেশে আউশ ধান, ভুট্টা, গম, তিল ফসলের চাষ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে জো অবস্থায় থাকা জমি কর্ষণের সময় একই সঙ্গে বীজও বুনে দেয়া হয়। এতে শ্রমিক ব্যয় কমানোর পাশাপাশি জমি তৈরিতে পানি সেচের ব্যবহার এড়িয়ে পানির সাশ্রয় করা হচ্ছে। যেসব ফসলে পানি কম লাগে (যেমন- গম, তিল) সেসব ফসল চাষে এ পদ্ধতি কার্যকর।

বিনা চাষে ফসল উৎপাদন

বর্ষার পর যেসব এলাকায় জমির জো অবস্থা আসতে দেরি হয় অর্থাৎ জমিতে চাষ দেয়া সম্ভব হয় না, সেসব জমিতে বিনা চাষেই রসুন, আলু, ছিটিয়ে বোনা ধান সহজেই চাষ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে, ফসলের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিকভাবে সেচের পানির খুব একটা প্রয়োজন হয় না। ফসল বেড়ে উঠলে যখন মাটির আর্দ্রতা বা মাটির রসের পরিমাণ কমতে থাকে তখন প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হয়।

কম্পোস্ট এবং মালচিং

কম্পোস্ট বা পচানো জৈব পদার্থ যা মাটিতে সার হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে, সেগুলো প্রচুর পরিমাণে মাটিতে প্রয়োগ করে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। মালচ বা জাবড়া মাটির ওপর ছড়িয়ে দিলে তা সেচের পানি বা মাটির রসকে মাটিতেই ধরে রাখতে সাহায্য করে থাকে। জাবড়া হিসেবে শুকনো খড়, পাতা বা কাঠের গুঁড়া ব্যবহার করা যেতে পারে, যেগুলো পরে পচে গিয়ে কম্পোস্টে পরিণত হয় ও মাটির গুণাগুণ উন্নত করতে সাহায্য করে। কম্পোস্ট ও জাবড়া মাটির সব ধরনের অণুজীবের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যদি কালো পলিথিন মালচ বা জাবড়া হিসেবে মাটি ঢেকে দেয়ার কাজে ব্যবহার করা যায়, তাহলে পানির বাষ্পায়ন হার কমানোর পাশাপাশি জমিতে আগাছা জন্মাতেও বাঁধা সৃষ্টি করে। ফলে সেচের পানির সাশ্রয় হয়।

আচ্ছাদন ফসল চাষ

মাটিকে ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষার জন্য যে কোনো ধরনের গাছ বা ফসল লাগাতে হয়, তা'না হলে উন্মুক্ত মাটি বিভিন্নভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এজন্য আচ্ছাদন ফসল চাষ করলে আগাছা কম জন্মানোর পাশাপাশি মাটির উর্বরতা শক্তিও বৃদ্ধি পায়। আচ্ছাদন ফসলের শিকড় মাটির ক্ষয়রোধ করে ও মাটিকে দৃঢ়তা প্রদান করে। এ অবস্থায় মাটিতে সেচ দিলে পানি সহজেই মাটিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। একটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, খরাপ্রবণ অঞ্চলে প্রথাগতভাবে জমিতে সেচ দিলে যে পানি লাগে আচ্ছাদন ফসল চাষ করার পর সেচের পরিমাণ তার চেয়ে ১১-১৪ ভাগ পর্যন্ত কম লাগে। ফল বাগানে আচ্ছাদন ফসল চাষ করলে সহজেই সেচের পানির সাশ্রয় করা যায়।

সংরক্ষিত চাষ

১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচন্ড খরা ও বায়ুদূষণের পর মাঠের বহুবর্ষজীবী ঘাস কমানোর জন্য গভীর চাষের একটি নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন হয়। সংরক্ষিত চাষ একটি বিশেষ চাষপদ্ধতি, যাতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং কম পক্ষে ৩০% শস্যের অবশিষ্টাংশ রেখে জমি চাষ করা হয়। আচ্ছাদন শস্যের চাষ করা হয়, যাতে মাটির পানি বাষ্পীকরণ, মাটি ক্ষয় ও মাটির দৃঢ়তা কমে এবং মাটির রস ধারণক্ষমতা বাড়ে। মাটিতে প্রচুর জৈব সার ও প্রয়োজনে মালচিং দ্রব্যও ব্যবহার করা হয়।

লেখক : কৃষিবিদ ও উদ্যান বিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<51126 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1