শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীতে আমের বাণিজ্য জমজমাট

রাজশাহীকে বাংলাদেশের আমের রাজধানী বলা হয়। এখানকার উর্বর দোআঁশ মাটি আম চাষের জন্য উপযোগী। এখানকার কানসাট বাজার আম বিপণনের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, আলীনগর এমনকি রাজশাহীর বানেশ্বরেও আমের বড় বাজার বসে। এসব বাজার থেকে আম কিনে ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এনে বাণিজ্য করছেন।
এস এম মুকুল
  ১৪ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

রাজশাহীকে বাংলাদেশের আমের রাজধানী বলা হয়। এখানকার উর্বর দোআঁশ মাটি আম চাষের জন্য উপযোগী। এখানকার কানসাট বাজার আম বিপণনের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, আলীনগর এমনকি রাজশাহীর বানেশ্বরেও আমের বড় বাজার বসে। এসব বাজার থেকে আম কিনে ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এনে বাণিজ্য করছেন। আম উৎপাদনে দেশে দ্বিতীয় অবস্থানে সাতক্ষীরা। এখানকার আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারেও ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছে। তা ছাড়া ভৌগোলিক অবস্থার কারণে এখানকার আম সবার আগে পাকে। রাজশাহীর আমে নির্ভর করে এখানকার অর্থনীতির একটি বড় অংশ। পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর বাজারেই কেবল বছরে এই আমের বেচাকেনা হয় অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অর্থনীতিই আমকে ঘিরে। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। বছরে কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জেই বিক্রি হচ্ছে প্রায় ছয় কোটি টাকার দুই লাখ আমের চারা। আমকেন্দ্রিক রাজশাহীতে গড়ে ওঠে পরিবহন ব্যবসা থেকে শুরু করে, আমের ঝুড়ি, ধানের খড়, পুরনো পত্রিকা, পস্নাস্টিকের ক্যারেট, চিকন দড়ি এবং কুরিয়ার ব্যবসা। এসব ব্যবসাও কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। একমাত্র কুরিয়ার ব্যবসায় গড়ে দুই কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের দুটি বড় আমের মোকাম- রাজশাহীর বানেশ্বর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার মিলে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় অন্তত দুই কোটি টাকার আম। আমের কারবার নিয়ে রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থানও হয়ে ওঠে।

প্রাণ সংগ্রহ করবে ৬০ হাজার টন আম

ম্যাংগো ড্রিংক, জুস, ম্যাংগো বারসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী তৈরি করতে প্রতি বছরের মতো এবারও আম সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু করেছে দেশের সর্ববৃহৎ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ। চলতি বছর ৬০ হাজার টন আম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রাণ গ্রম্নপ। রাজশাহীর গোদাগাড়ি বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও নাটোরের একডালায় প্রাণ এগ্রো লিমিটেডের কারখানায় এই আম সংগ্রহ ও পাল্পিং করা হবে। এ প্রসঙ্গে প্রাণ-আরএফএল গ্রম্নপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল এক বিবৃতিতে বলেন, 'প্রতি বছরের মতো চলতি মৌসুমেও নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, মেহেরপুর এবং সাতক্ষীরা থেকে আম সংগ্রহ করছে প্রাণ। সংগ্রহের পর এসব আম পাল্পিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে রাজশাহী ও নাটোরের কারখানায়। এই পাল্প থেকেই পুরো বছর তৈরি হচ্ছে ম্যাংগো ড্রিংক, জুস, ম্যাংগো বারসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী। ক্রেতারা যেন উৎকৃষ্টমানের পাল্পের ফরুট ড্রিংক কিংবা জুস খেতে পারে সে জন্য আমরা পণ্যের কাঁচামালকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। আমের জন্য বিখ্যাত অঞ্চলে আমাদের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছি। পাশাপাশি কারখানা আধুনিকায়নের ফলে ক্রেতারা আরও মানসম্মত পণ্য পাবে বলে আশা করছি।'

জিআই পণ্যে খিরসাপাত আম

দেশের তৃতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে জিআই নিবন্ধন সনদ পেল চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম। খিরসাপাত আম আকারে মাঝারি, গড়নে ডিম্বাকৃতির, প্রতিটি আমের ওজন ১৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত। কাঁচা অবস্থায় রঙ হালকা সবুজ, পাকলে সবুজাভ হলুদ রঙ ধরে। খোসা মসৃণ ও আঁটি পাতলা। আঁশবিহীন হওয়ায় এবং মিষ্টি স্বাদ ও গন্ধের জন্য ল্যাংড়ার পর এ আমের কদরই সবচেয়ে বেশি। জানা যায়, ২০১৬ সালে জিআই পণ্য হিসেবে প্রথম জামদানিকে স্বীকৃতি দেয় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর। পরের বছর জাতীয় মাছ ইলিশ জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পায়। এরপরই স্বীকৃতি পেল খিরসাপাত আম। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় এ আমে আলাদা ট্যাগ বা স্টিকার ব্যবহার করা যাবে। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদন করে সব গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে বাজারজাত করা যাবে। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের 'ল্যাংড়া' এবং 'আশ্বিনা' আমের অনুকূলেও জিআই সনদ প্রদানের জন্য পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী।

হাঁড়িভাঙা আমে রংপুরের অর্থনীতি

ভাঙা হাঁড়িতে পত্তন হয়েছিল বলেই নাম হয়েছে 'হাঁড়িভাঙা'। এই হাঁড়িভাঙা আমের প্রাণজুড়ানো ঘ্রাণ এখন রংপুরের বাজারে। সুমিষ্ট হাঁড়িভাঙা আম কিনতে প্রতিদিনই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সৌখিন মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন রংপুরের বাজারে বাজারে। রংপুরে এখন হাঁড়িভাঙা আম চাষে বিপস্নব চলছে। যা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে আমের রাজধানী রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রংপুরের গ্রামগঞ্জের কৃষকরা হাঁড়িভাঙা আম উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় হাড়িভাঙা আম বাগানের পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টর। বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা বলছেন, হাঁড়িভাঙা আমের এই সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে অবিলম্বে এখানে আম গবেষণা কেন্দ্র, হিমাগার স্থাপন ও চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে বছরে সাত হাজার কোটি টাকার আম উৎপাদন সম্ভব। হাঁড়িভাঙা আম জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পাওয়া যায়। রাজশাহী অঞ্চলের আম বাগানিরা রংপুর থেকে হাঁড়িভাঙা আমের চারা নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ওই এলাকায় হাঁড়িভাঙা আমের চাষের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আফতাব হোসেন জানান, সুমিষ্ট হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা এখন দেশব্যাপী। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই আমের চাষও বেড়ে গেছে। এতে করে লাভবান হচ্ছে চাষিরা। তিনি জানান, হাঁড়িভাঙা আমে রোগবালাই কম হয়। চারা লাগানোর বছর পরই গাছে মুকুল আসে। আর ৫/৬ বছর বয়সে গাছে পুরোদমে আম আসতে শুরু করে।

আমচুর : কোটি টাকার অর্থনীতি

কানসাটের আড়তে এই আমচুরের ব্যবসাটা সাইড বিজনেস। কানসাটের আড়তগুলোতে দেখা যায় আমচুরের গাদা। প্রায় একশ' মণ আমচুর টাল দিয়ে রাখা হয়েছে আড়তের এক পাশে। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে এসব আমচুর আসে। একদল ব্যবসায়ী রয়েছে যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে আমচুর সংগ্রহ করে। আর তা আড়তে এনে বিক্রি করে। গ্রামে এই আমচুরের মূল কারিগর গৃহের নারীরা। বাগানের ঝরা আম লম্বা টুকরো করে কেটে কেটে শুকিয়ে আমচুর বানান। যা ২০-২১ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এগুলো যারা গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন তারাই নিয়ে আসেন কানসাটের আড়তে। আড়তদার তা কিনে রাখেন ২৩ থেকে ২৪ টাকা দরে। আর সেখান থেকে কেনে ফড়িয়া ব্যবসায়ী। তারা নিয়ে যায় ২৫ থেকে ২৬ টাকা দরে। এই এক দুই টাকা কেজি প্রতি মুনাফা দিয়েই মওসুমে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়।

আম বাণিজ্যে জমজমাট কুরিয়ার সার্ভিস

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাট। জেলার সবচে বড় আমের হাট। মে থেকে জুলাই এই তিনমাস ক্রেতা-বিক্রেতা আড়তদারের দর কষাকষিতে মুখরিত থাকে সারাদিন। সড়কের দুপাশে রয়েছে অন্তত দেড়শো আমের আড়ত। এ মৌসুমে এখানকার প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ গাছ থেকে নামানো, বাজারে তোলা থেকে শুরু করে প্রতিদিন চাহিদা অনুযায়ী আম ক্যারেটে সাজিয়ে বা টুকরি করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আমের ভরা মৌসুম হওয়ায় কুরিয়ার সার্ভিসগুলো সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে বুকিং নিচ্ছেন। প্রতি কেজি আম ঢাকায় ১২ টাকা আর রাজধানীর বাইরে পাঠাতে খরচ হচ্ছে ১৬ টাকা।

আমের বাজার সাপাহার

\হনওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলায় বিভিন্ন জাতের আমের কেনা-বেচায় প্রায় ২ শতাধিক আমের সর্বোচ্চ আড়তে গড়ে ওঠেছে সর্ববৃহৎ আমের বাজার। বাংলাদেশের মধ্যে নাম করা সাপাহার উপজেলার আমের রাজার খুবই সুস্বাদু জাতের আম, সাপাহার উপজেলার আম্রপলী আম বাজারে না আসতেই হাজার হাজার মণ আম কেনা-বেচা হচ্ছে এই আম বাজারে। বাজারে এখন গোপালভোগ, খিরসাপাতি, হিমসাগর ও নেংড়া এবং গুটি জাতের আম উঠেছে। সাপাহার উপজেলা সদরের মেইন রাস্তার দুপার্শ্বে জয়পুর হতে গোডাউনপাড়া পর্যন্ত দেড়, দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আমের আড়ত ভরে গেছে।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58032 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1