শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দামি মসলা জাফরান চাষ করে হোন লাভবান

কৃষিবিদ এম এনামুল হক
  ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

জাফরান পৃথিবীর অন্যতম দামি মসলা, ইহা 'রেড গোল্ড' নামেও পরিচিত। প্রাচীন যুগে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে জাফরানের সুগন্ধ ও উজ্জ্বল রঙের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ জাফরান ব্যবহার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে ব্যাপক প্রচলন ছিল। আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, গ্রিস, মিসর, চীন এসব দেশে কম বেশি জাফরানের চাষ হয়ে থাকে। স্পেন ও ভারতের কোনো কোনো অংশে বিশেষ করে কাশ্মীরে এ ফসলের চাষ অনেক বেশি। তবে অন্য দেশের তুলনায় স্পেনে জাফরান উৎপাদন পরিমাণে অত্যাধিক। রপ্তানিকারক অন্যতম দেশ হিসেবেও স্পেন সুপরিচিত। বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ জাফরান স্পেনে রপ্তানি করে থাকে। ফুটন্ত ফুলের গর্ভদন্ড (স্টিগমা) সংগ্রহ করে তা থেকে জাফরান প্রাপ্তি একটা ব্যয় বহুল ও বেশ শ্রম সাপেক্ষ (লেবার ইনটেনসিভ) কাজ বিধায় দামি মসলা হলেও জাফরান চাষে অনেকেই আগ্রহী হন না। তা ছাড়া প্রথম বছর রোপিত সব গাছে ফুল আসে না, এ সময় প্রায় শতকরা ৪০-৬০ ভাগ গাছে ফুল আসতে পারে। এক গ্রাম জাফরান পেতে প্রায় ১৫০টা ফুটন্ত ফুলের প্রয়োজন হয়। পরের বছর একেক গাছ থেকে প্রায় ২-৩টা করে ফুল পাওয়া যায়। তবে তৃতীয় বছর থেকে প্রতি বছরে জাফরান গাছ ৫-৭টা করে ফুল দিতে সক্ষম।

জাফরানের ইংরেজি নাম 'সাফরন', ক্রোকোআইডি (ঈৎড়পড়রফবধব)পরিবার ভুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম- ঈৎড়পঁং ংধঃরাঁং। এ গাছ লম্বায় প্রায় ৩০ সে. মিটার হয়। খাবার সু-স্বাদু করার জন্য বিশেষ করে বিরিয়ানী, কাচ্চি, জর্দা ও কালিয়াসহ নানা পদের দামি খাবার তৈরিতে জাফরান ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠানে জর্দা তৈরিতে প্রাকৃতিক আকর্ষণীয় রং আনতে এবং দামি বাহারি পান বিপণনে জাফরান অন্যতম উপাদান। মুখমন্ডল আকর্ষণীয় করতে ও ত্বকের উজ্জ্বল রং আনার জন্য স্বচ্ছল সচেতন রমণীরা প্রাচীন কাল থেকে জাফরান ব্যবহার করে থাকেন। বিউটি পার্লারে রূপচর্চায় জাফরান অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

আশার খবর হলো- ভারত, ইরানের মতো এবার বাংলাদেশের মাটিতে চাষ হচ্ছে রেড গোল্ড বা জাফরান। এর এই চাষ শুরু করেছেন শাহানাজ শায়লা নামের জবির শিক্ষার্থী। গেল বছর থেকে জাফরান বিক্রয় শুরু করেছেন নরসিংদী শাহানাজ শায়লা। শায়লা প্রাথমিকভাবে এই চাষ শুরু করলেও সরকারের সহযোগিতা পেলে সে বাণিজ্যিকভাবে জাফরান চাষ শুরু করবেন। বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে এই মসলা র বালব বা কন্দ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম জামাল উদ্দিন।

বংশ বিস্তার : গাছের মুথা বা বালব (অনেকটা পেঁয়াজের মতো) সংগ্রহ করে তা বংশ বিস্তারের কাজে ব্যবহার করা হয়। এক বছর বয়স্ক গাছ থেকে রোপন উপযোগী মাত্র দুটা মুথা (ইঁষন) পাওয়া যায়। তবে ৩-৪ বছর পর একেক গাছ থেকে ৫-৭টা মুথা পাওয়া যেতে পারে। নতুন জমিতে রোপণ করতে হলে ৩-৪ বছর বয়স্ক গাছ থেকে মুথা সংগ্রহ করে তা জমিতে রোপণ করতে হবে। একই জমিতে ৩-৪ বছরের বেশি ফসল রাখা ঠিক নয়। মুথা বা বালব উঠিয়ে নতুনভাবে চাষের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

জমি নির্বাচন : সব ধরনের জমিতে জাফরান ফলানো যায়। তবে বেলেদোআঁশ মাটি এ ফসল চাষে বেশি উপযোগী। এঁটেল মাটিতে জাফরানের বাড়-বাড়ন্তি ভালো হয় না, তবে এ ধরনের মাটিতে কিছু পরিমাণ বালু ও বেশি পরিমাণ জৈব সার মিশিয়ে এ মাটিকে উপযোগী করা যায়। জলাবদ্ধ সহনশীলতা এ ফসলের একেবারেই নেই। এ জন্য পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি এ ফসল চাষের জন্য নির্বাচনে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। মাটির পিএইচ ৬-৮ হলে বেশি ভালো হয়। ছায়া বা আধা ছায়ায় এ ফসল ভালো হয় না। পর্যাপ্ত রোদ ও আলো-বাতাস প্রাপ্তি সুবিধা আছে এমন স্থানে এ ফসল আবাদে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেকে ছাদে, পটে বা ছোট 'বেড' তৈরি করে নিয়েও সেখানে সীমিত আকারে জাফরান চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করে থাকে।

চাষ পদ্ধতি : চারা তৈরির জন্য বীজ তলা প্রায় ১৫ সে. মিটার উঁচু হতে হবে। প্রতিটা জাফরানের বালব বা মুথা ১০-১২ সে. মিটার দূরত্বে ছোট গর্ত তৈরি করে তা ১২-১৫ সে. মিটার গভীরতায় রোপন করতে হবে। তাতে এ মাপের বীজ তলার জন্য প্রায় ১৫০টা জাফরানের মোথার প্রয়োজন হয়। বর্ষা শেষ হওয়ার পূর্বক্ষণে জুলাই-আগস্ট মাসে এ ফসলের মুথা বা বালব (ইঁষন) রোপণ করা হয়। শুরুতে বেশি গভীরভাবে জমি চাষ করে বা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে জমি আগাছা মুক্ত ও লেবেল করে নেয়া প্রয়োজন। জমি তৈরি কালে প্রতিশতক জমিতে পচা গোবর/আবর্জনা পচা সার ৩০০ কেজি, টিএসপি ৩ কেজি এবং এমওপি ৪ কেজি প্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটির সঙ্গে সমস্ত সার মিশিয়ে হালকা সেচ দিয়ে রেখে দিয়ে দু'সপ্তাহ পর জাফরান বালব রোপন উপযোগী হবে। বসতবাড়ি এলাকায় এ ফসল চাষের জন্য বেশি উপযোগী।

এ ফসল একবার রোপন করা হলে ৩-৪ বছর পর্যন্ত ফুল দেয়া অব্যাহত থাকে। বর্ষার শেষে আগস্ট মাসে মাটি থেকে গাছ গজিয়ে ফেব্রম্নয়ারি মাস পর্যন্ত গাছের বৃদ্ধি ও ফুুল দেয়া অব্যাহত থাকে। মে মাসের মধ্যে গাছের উপরিভাগ হলুদ হয়ে মরে যায়। মুথা মাটির নিচে তাজা অবস্থায় বর্ষাকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এ সময় গাছের অবস্থিতি উপরি ভাগ থেকে দেখা যায় না।

গাছের বৃদ্ধি ও ফুল : গাছে শীতের প্রারম্ভে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ফুল আসে। বড় আকারের মুথা লাগানো হলে সে বছরই গাছে কিছু ফুল ফুটতে পারে। শীতকালে গাছের বাড়-বাড়তি ভালো হয়। শীত শেষে এ বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। গাছের বয়স এক বছর হলে অতিরিক্ত ১টা বা ২টা মুথা (ঈড়ৎসং) পাওয়া যায়। তিন বছর পর রোপিত গাছ থেকে প্রায় ৫টা অতিরিক্ত মোথা পাওয়া যাবে, যা আলাদা করে নিয়ে নতুনভাবে চাষের জন্য ব্যবহার উপযোগী হবে।

পরিচর্যা : এ ফসল আবাদ করতে হলে সব সময় জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে হালকাভাবে মাটি আলগা করে দেয়া হলে মাটিতে বাতাস চলাচলের সুবিধা হবে এবং গাছ ভালোভাবে বাড়বে। শুকনো মৌসুমে হালকা সেচ দেয়া যাবে। তবে অন্য ফসলের তুলনায় সেচের প্রয়োজনীয়তা অনেক কম। বর্ষায় পানি যেন কোনো মতেই জমিতে না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পানি জমে থাকলে রোপিত বালব পচে যাবে।

জাফরান সংগ্রহ : রোপণের প্রথম বছর সাধারণত ফুল আসে না। তবে জাফরানের রোপিত বালব আকারে বেশ বড় হলে সে বছরই জাফরান গাছ থেকে মাত্র একটা ফুল ফুটতে পারে। পরের বছর প্রতি গাছে পর্যায়ক্রমে ২-৩টা ফুল আসবে। দু'বছরের গাছে ৪-৫টা এবং তিন বছরের গাছে ৭-৮টা ফুল দেবে। জাফরানের স্ত্রী অঙ্গ ৩টা থাকে এবং পুরুষ অঙ্গও ৩টা থাকে। গাছে অক্টোবর মাস থেকে ফুল দেয়া আরম্ভ করে এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। তবে এ ফুলফোটা মৌসুমি তাপমাত্রার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। ফুটন্ত ফুলের গন্ধের মাত্রা তীব্র। ফুলফোটার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভদন্ড গাছ থেকে ছেঁটে সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এ দন্ডের অগ্রভাগের অংশ তুলনায় চওড়া বেশি বা মোটা হয়। এ অংশের রং গাঢ় লালচে হয়। নীচের অংশ অনেকটা সুতার মতো চিকন এবং হালকা হলুদ রঙের হয়। উপরের অংশ জাফরান হিসেবে ব্যবহৃত হয়, নিচের চিকন অংশের গুণাগুণ তেমন ভালো হয় না।

সংরক্ষণের আগে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন তা ভালোভাবে শুকানো হয়। অন্যথায় জাফরান বেশি দিন রাখা যাবে না, প্রাকৃতিক গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফুলফোটার সঙ্গে সঙ্গে পুলের স্টিগমার বা গর্ভদন্ডের প্রয়োজনীয় অংশ কেঁচি দিয়ে বা অন্যভাবে ছেঁটে নিয়ে তা চওড়া একটা পাত্রে পরিষ্কার কাগজ বিছিয়ে নিয়ে তার ওপর সংগৃহীত জাফরান রোদে শুকানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ সময় রোদে দেয়ার জন্য জাফরান সংরক্ষিত পাত্রটা কিছু উঁচু স্থানে টেবিল/টুলে রাখতে হবে এবং কোনো মতেই যেন বাতাস বা অন্য কোন প্রাণির উপদ্রপে পড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জাফরান শুকানোর জন্য এক ধরনের যন্ত্র (ডেসিকেটর বা ড্রায়ার) ব্যবহার করা হয়।

জাফরান দু-তিন দিন পড়ন্ত রোদে শুকানোর পর তা আর্দ্রতা রোধক পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। কড়া রোদে বা বৃষ্টিতে ভেজার আশঙ্কা থাকলে বাড়ির বারান্দায় বা জানালার ধারে সুরিক্ষত স্থানে এ মূল্যবান জাফরান শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাফরান চাষে করণীয় : প্রত্যেক হর্টিকালচার সেন্টারে সুবিধামত স্থানে ২-৩টা স্থায়ী বীজ তলায় এ দামি গুরুত্বপূর্ণ হাইভ্যালু ফসলের আবাদ ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক। পার্শ্ববর্তী যে কোনো দেশ থেকে দু-একশত জাফরান বালব সংগ্রহ করে চাষের উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67767 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1