শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আদিবাসীদের ঐতিহ্য বিন্নি ধান

হাসান মেহেদি
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বিন্নি ধানকে সিলেট অঞ্চলে বিরোইন ধান বলে। সিলেট অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে এই চালের কদর এখনো আছে। ফলে সিলেট অঞ্চলে বিন্নি ধানের আবাদ এখনো টিকে আছে। এই অঞ্চলে বিরোইন চালের ভাপে ভাত, পোলাও, চুঙা পিঠা, পায়েস রান্না করা হয়। উৎসব পার্বণে বিন্নি চালের পিঠা পায়েস খই চিড়া খাওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে সমভূমি ও পাহাড়ি দুই জনগোষ্ঠীরই। সবুজ বিপস্নবের উফশী ধানের প্রভাবে সমতল থেকে আবাদ প্রায় হারিয়ে গেলেও পাহাড়ের আদিবাসীরা বিন্নি ধানের আবাদ ধরে রেখেছে। এ চাল দিয়েও পালন করা হয় নবান্নের উৎসব।

বিন্নি বা বিনি ধানের বিভিন্ন জাত রয়েছে। যেমন: চন্দন বিন্নি, গেং গেং বিন্নি, মৌ বিন্নি, দুধ বিন্নি, রাঙা বিন্নি, আসানিয়া বিন্নি, ছৎছেৎ বিন্নি, বিজাবিরাং বিন্নি, কুৎচিয়া বিন্নি, আগুনিয়া বিন্নি, কাক্কুয়া বিন্নি, চিচাও বিন্নি, লেদার বিন্নি, লোবা বিন্নি, কবা বিন্নি, হরিণ বিন্নি, লক্ষ্ণী বিন্নি, দরিমা বিন্নি, গারো বিন্নি, কাঁশিয়া বিন্নির নাম উলেস্নখযোগ্য। তবে বর্তমানে বিন্নি চালের রঙ অনুসারে লাল বিন্নি, সাদা বিন্নি, কালো বিন্নি এই তিন ধরনের বিন্নিই সুপরিচিত। অনেক স্থানের আদিবাসীরা বিন্নি ধানকে বলেন 'বিনি ধান'।

বিন্নি ধান পাহাড়ি এলাকার উঁচু নিচু সব ধরনের জমিতেই হয়ে থাকে। এ ধান চাষাবাদ করতে কোন রাসায়নিক সার বা বিষের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া বিন্নি ধান তাড়াতাড়ি ঘরে আসে। প্রতি হেক্টরে বিন্নি ধানের উৎপাদন প্রায় ২৫০০ থেকে ৪০০০ কেজি এবং খড় হয় সাড়ে পাঁচ থেকে ৬ হাজার কেজি।

বাংলাদেশের নেত্রকোনায় বসবাসকারী আদিবাসী হাজং, গারো, রাংসা, সাংমা, মান্দা, দারিংরা দলবদ্ধ ভাবে এ ধান চাষাবাদ করে থাকেন। নেত্রকোনার বিরিশিরি বহুমুখী মহিলা সমবায় সমিতির তত্ত্বাবধানে বিন্নি ধানের ১৩টি জাত চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী প্রায় সব আদিবাসী জুমে বিন্নি ধান আবাদ করে থাকেন।

পাহাড়ি এলাকার স্থানীয় ধানের জাতের মধ্যে বিন্নি আদি ধান। সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিন্নি ধান আদিবাসীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিন্নি ধান না হলে তাদের সমাজে কোনো বিয়ের প্রস্তাব গৃহীত হয় না। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাজে বিন্নি ধান একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

বিন্নি ধানের চালের গুঁড়া দিয়ে সব ধরনের পিঠা তৈরি করা যায়, সে পিঠা অন্যান্য ধানের চালের গুঁড়ার পিঠার চেয়ে নরম হয়। এ চাল দিয়ে সহজেই ক্ষির, পায়েস, ভাপা পিঠা, মুখশালা, চিতই, ভেজানো পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, চোক্ষা পিঠা ইত্যাদি তৈরি করা যায়। ভাত হিসেবেও বিন্নি ধানের চাল আদিবাসীদের কাছে খুবই পছন্দের। কাটারিভোগ, চিনিগুঁড়া চালের মতো সরু বা চিকন না হলেও স্বাদ ও গন্ধের জন্য বিন্নি চাল বিখ্যাত। বিন্নি আতপ চালের আঠালো ভাত খুবই সুস্বাদু। এর রয়েছে ঔষুধি গুণও। আমাশয় সারাতে অনেকে খান এ চালের ভাত। এ চাল সিদ্ধ করতে হয় না বলে তাতে খাদ্যের গুণগত মান বেশি থাকে।

বিন্নি ধানের খড় গবাদি পশু ভালো খায় এবং আদিবাসীরা ঘর ছাউনির কাজে ব্যবহার করেন। ফলে এ ধানের খড়ের চাহিদা বেশ রয়েছে।

বিন্নি ধানের খই না হলে তাঁত শিল্পীদেরও চলে না। তাঁত শিল্পীদের কাছে বিন্নি ধানের খই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁত শিল্পীরা সুতা এবং কাপড় কাটা করা অর্থাৎ মাড় দেওয়ার জন্য বিন্নি ধানের খই ব্যবহার করে থাকেন।

এ যুগের নাগরিক সমাজেও বিন্নি ধানের কদর রয়েছে। রাজধানী ঢাকার কয়েকটি সুপার শপ ও নিরাপদ খাদ্য বিপণনকারী আউটলেটে বিন্নি ধানের খই, লাল বিন্নি, সাদা বিন্নি, কালো বিন্নি এই তিন ধরনের বিন্নি চাল ভালোই বেচাকেনা হয়। এক সময় গাজীপুরের ভাওয়াল গড়ের বাইদ, টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের বাইদ ও বরেন্দ্রভূমি তথা উত্তরবঙ্গে উঁচু জমিতে প্রচুর চাষ হতো বিন্নি ধান। জলবায়ুর পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, আধুনিক নানা জাতের ধানের আগমন ইত্যাদি কারণে দেশের অনেক স্থানেই বিন্নি ধান আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89630 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1