শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিদায় আবিরে মলিন রঙিন ভুবন

নাজমুল মৃধা
  ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
বিদায় উপলক্ষে ক্যাম্পাসে আবির মাখামাখি

সুমি আর নিঝুম প্রতিদিন যেভাবে ঘুম থেকে উঠে, বিদায়ী দিন একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। তাদের মলিন মুখের ভাষাই বলে দিচ্ছে ক্যাম্পাসের রঙিন ভুবনে তাদের স্থায়িত্ব আর বেশি দিন নেই। দীঘর্ পঁাচ বছরের ভালোবাসার সম্পকের্ক আনুষ্ঠানিক বিদায় দিতে তারা নানা আয়োজন করলেও সেখানে ছিল সম্পকর্ ছিন্ন হওয়ার শূন্যতা। ছিল আপন রক্তের না হয়েও রক্তবন্ধন ভালোবাসার বিচ্ছেদের জ্বালা। হবেই না বা কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮টি বিভাগের বান্ধবীদের সাথে একই ছাদের নিচে থেকে জমেছে কত স্মৃতি। একরাশ হাসি, আড্ডা, তামাশা, মান-অভিমান ছিল পাঁচ বছরের আবেগ আর ভালোবাসা। এসব যে ছেড়ে যেতে হবে! তাই তো তাদের মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার কয়েকটি লাইনÑ

‘‘ফিরিবার পথ নাহি;

দূর হতে যদি দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।

হে বন্ধু বিদায়।’’

বিদায় উপলক্ষে তারা ক্যাম্পাসে ভ্যানগাড়িতে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে আবির মাখামাখি করছিল হয়তো। কিন্তু মনের কোণে কী এক শূন্যতা বারবার তাদের ধাক্কা দিচ্ছিল। বিদায়ী শিক্ষাথীর্ ইফফাত মিতুর পা সেদিন পিচঢালা রাস্তায় বারবার আটকে যাচ্ছিল। তার মতো হয়তো আরও অনেকের। কে জানে হয়তো তারা ভিতরে ভিতরে ডুকরে কেঁদেছে তখন। তাদের মনে হচ্ছিল ক্যাম্পাস থেকে তাদের বিদায় যেন গাছের সবুজ পাতারাও মেনে নিতে পারছে না। বিদায় মলিনতায় পাতার রং হয়ে উঠছিল ধূসর।

বিদায়ী ছাত্রী নুসরাত জাহান এশা বলছিলেন, ‘রাজশাহীতে যখন প্রথম আসি তখন এর আবহাওয়া এবং পরিবেশ দিয়েছিল তিক্ত এবং মিশ্র এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে মনে হয় নিজ পরিবারের কেউ। এত সুন্দর জীবন ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেও পারছি না।’

অনেকের মনেই উঁকি দিচ্ছে শাবাশ বাংলাদেশ মাঠ, ইবলিশ চত্বর, টুকিটাকিতে বসে আড্ডা দেয়ার স্মৃতি। প্যারিস রোডে বান্ধবীরা মিলে হাত ধরে হঁাটা, আর জমিয়ে আড্ডা দেয়ার ছলে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা। হয়তো আর হবে না পহেলা বৈশাখে লাল শাড়িতে বন্ধুদের সাথে পান্তা-ইলিশ খাওয়া, হবে না তীব্র ঝালে রাজশাহীর কালাই রুটি খাওয়া, হবে না হলের খালাদের সাথে তিক্ত মধুর ঝগড়া। হবে না উদাসী মনে ক্যাম্পাসে রঙিন ভুবনের স্পশর্ পাওয়া। আহ, কি জীবন! এরই নাম ছাত্রজীবন। মানুষ কঅ আর সাধে বলে ‘ছাত্রজীবন সুখের জীবন’ ।

বলতে গেলে জীবনের শেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসমাপ্তি এটি। এর পরের জীবন ভাবলেই পথ আটকে যায়। পড়াশোনা শেষে পরিবার একটি আবদার নিয়ে বসে থাকে। চাকরি করো, বিয়ে করো। শুরু হয় জীবনের দায়িত্বের গুরুভার, অন্যের আশা-আকাক্সক্ষা আর চাহিদা পূরণের এক অবিসংবাদিত পথ।

সবাই জানে এ পথে সবারই আসতে হবে। তবুও তাদের মনে হয় দূর কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে তারা যেন কয়েকজন যাত্রী একটি ট্রেনে চড়েছে। যাত্রাপথে গল্প, আড্ডা, হাসি-তামাশায় তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল মিথ্যা এক সম্পকর্। যে সম্পকের্র কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আছে কেবল রিক্ততা, শূন্যতা! যাত্রাশেষে শেষ স্টেশনে যে যেদিকে পারবে চলে যাবে স্বপ্ন পূরণ করতে। তাদের জায়গা দখল করবে অন্য কেউ, নতুনরা। দেখা হবে না, কথা হবে না। জমবে না আড্ডা, হবে না উদাসী হয়ে গন্তব্যহীন, উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলা। হয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকজনের সাথে হায় হ্যালো হবে। তা আর কি! অনুভ‚তিটা কেমন খবর্ হয়ে যাবে। আর যাদের সাথে দেখাও হবে না কথাও হবে নাÑ তারা কেমন থাকবে? কেউ কেউ হয়তো অনেক ভালো থাকবে, কেউবা মন্দ। আবার কেউবা রাতের আকাশের তারা হয়ে মিটমিট করে জ্বলবে। নষ্টালজিক এই জীবনে কেউ হয়তো কারোর কথা ভাববে না কিন্তু বয়সের ভারে সবাই যেদিন দূরে ঠেলে দিবে সেদিন হয়তো দুরন্ত যৌবনের এসব স্মৃতিই হবে তাদের পরবতীর্ প্রজন্মের রূপকথার গল্পকাহিনী। এমন ভাবনাই ভাবছিল তাপসী রাবেয়া হলের ২০১৩-১৪ সালের বিদায়ী ছাত্রীরা।

তাপসী রাবেয়া হলের ২০১৩-১৪ সেশনের বিদায় সমাপনীর নানা আয়োজন চলছিল। এসব আয়োজনে ছিল হলুদ সন্ধ্যা, রং খেলা, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা এবং নৈশভোজ। তাদের বিদায়কে ঘিরে তাপসী রাবেয়া হল সেজেছিল বিয়ে বাড়ির অঁালপনায়। ‘আমরা প্রজ্বলিত শিখা, তারুণ্যের অগ্রদূত’ এই ¯েøাগানকে সামনে রেখে চলে তাদের বিদায় সমাপনী। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাকে আরও রঙিন করে তুলেন অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচাযর্ প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহান। ছিলেন জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক প্রফেসর ড. প্রভাষ কুমার কমর্কারসহ প্রশাসনিক আরও ঊধ্বর্তন নেতারা।

তাদের বিদায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা দেন উপাচাযর্। সেদিন বিদায়ীদের সজল নয়নে ভাসছিল রঙিন ভুবন পেছনে ফেলার ব্যাকুলতা। আলোর ভুবন থেকে এক চিলতে আলো নিয়ে অন্ধকারে আলো জ্বালাবার অনিশ্চিত মশাল হাতে ছড়িয়ে পড়া। কে জানে কতটুকু আলো তারা দিতে পারবে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে। কঠিন, তবুও তারা জানে অতীতকে পেছনে ফেলেই চলতে হবে সামনে। বন্ধুত্বের বন্ধনকে ছিন্ন করে ছড়িয়ে পড়তে হবে জীবনযুদ্ধে। শুধু বিদায় বেলায় মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের সেই উক্তিÑ

“আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়

মোছ অঁাখি দুয়ার খোল দাও বিদায়।।”

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<19055 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1