শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

অতিথি ও অতিথি পাখি

মো. বেলাল হোসেন
  ০৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

গত ১০ বছর ধরে জয়নাল হোসেন জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে রিকশা চালান। একজন আপাদমস্তক সংসারী মানুষ, তার কাছে প্রকৃতির সৌন্দযর্ নিছক মনভোলানো গল্প ছাড়া কিছুই নয়। তবুও তার চোখকে জাবি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দযর্ বিমোহিত করে। সঙ্গে সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে এই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশের নেতিবাচক পরিবতর্ন তার চোখে স্পষ্টত। এসব নিয়েই তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল পরিবহন চত্বরের সামনে। সে অকপটে বলে চলল ক্যাম্পাসের পরিবতর্ন। বলছিল আগের দিনে অতিথি পাখির কলতানে ক্যাম্পাস মুখরিত থাকত সবসময়, সে সময় বাইরের মানুষ কম আসত। তখন পাখিদের বিচরণ ছিল সবগুলো জলাশয়ে। কিন্তু এখন অনেক বেশি বহিরাগত দশর্নাথীর্ আসে, কোলাহল অনেক বেশি হয়। পাখির সংখ্যা জলাশয়গুলোতে কমতে থাকে, ধীরে ধীরে কয়েকটি জলাশয়ে পাখি আসা বন্ধ হয়ে যায়। জলাশয়গুলোতে পানির পরিমাণ কমতে থাকে, ফলে শীতকালে জলাশয়গুলোতে এখন আর আগের মতো নীল ও লাল শাপলা জন্মানোর পরিবেশ পায় না।

একজন অভাবী রিকশাওয়ালার এই কথাগুলো একদমই সত্য। হয়তো সত্য বলেই কথাগুলো বলে আফসোস করতে করতে রিকশা নিয়ে নতুন যাত্রীর উদ্দেশে রওনা দিল।

তার এই কথার বাস্তবতায় যেন জানান দিচ্ছে লেকগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঘেটে অতিথি পাখির ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য পাওয়া না গেলেও লোকশ্রæতি ও নিভর্রযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকেই এখানকার জলাশয়গুলোতে অতিথি পাখিদের বিচরণ ছিল। সত্তরের দশকে নতুন নতুন কিছু ভবন ও শিক্ষাথীের্দর আগমনে অতিথি পাখিদের বিচরণে সমস্যার সৃষ্টি হলেও তারা (অতিথি পাখিরা) প্রকৃতির এই রানিকে ছেড়ে যায়নি। এর পরে অতিথি পাখিদের সুরক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্পক্ষ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে ধীরে ধীরে অতিথি পাখি এই ক্যাম্পাসের অংশ হয়ে যায়। যার ফলে ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগরে ৯০ প্রজাতির পাখি দেখা গেলেও ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের দিকে প্রায় ১৯৫ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। যার মধ্যে প্রায় ১২৫টি দেশীয় প্রজাতি এবং প্রায় ৭০টি প্রজাতির পাখিরা পরিযায়ী বা অতিথি। এর মধ্যে দেশীয় প্রজাতিগুলোর মধ্যে প্রায় ৭৮টি প্রজাতির পাখি ক্যাম্পাসে নিয়মিত বাসা বঁাধতেও দেখা যায় । ইদানীং ক্যাম্পাসে পাখিদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বেশি বেশি বিঘিœত হওয়ায় ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কিন্তু বতর্মানে ঠিক কত প্রজাতির পাখি ক্যাম্পাসে বিচরণ করে তার সঠিক পরিসংখ্যান কতৃর্পক্ষ হতে জানা যায়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ থেকে ১৫টি জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে সাত থেকে আটটি জলাশয়ে নিয়মিতভাবে অতিথি পাখিরা আশ্রয় নিয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের জলাশয়, পরিবহন চত্বর সংলগ্ন জলাশয়, সুইমিং পুল সংলগ্ন জলাশয় ও ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার সংলগ্ন জলাশয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মনপুরা এলাকায়, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল সংলগ্ন জলাশয়, বোটানিক্যাল গাডেের্নর পাশের জলাশয়। এগুলোর মধ্যে চার-পঁাচটি জলাশয়ে পাখিদের বেশি বিচরণ করতে দেখা যায়। সচরাচর এত অল্প জায়গায় প্রচুর পাখি বাংলাদেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না। দেশীয় প্রজাতির পাখিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই আসাম, মেঘালয় ও সিলেট অঞ্চল হতে আসে। পরিযায়ী পাখিদের বেশির ভাগ সাধারণত হিমালয়ের উত্তরের দেশ সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপাল থেকে সুদীঘর্ পথ অতিক্রম করে আসে। কারণ এ সময়ে ওই সব অঞ্চলে প্রচুর তুষারপাত ও ঠাÐা হয়। ফলে এ সময় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার কারণে তারা সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এই উপমহাদেশে আশ্রয়গ্রহণ করে থাকে।

এর মধ্যে নদী ও হাওড়ের এই দেশে বেশি আশ্রয় নেয় অতিথি পাখিরা। আবার বাংলাদেশে যত পরিযায়ী পাখি আসে তার চার ভাগের এক ভাগ আমাদের প্রিয় এই সবুজ ক্যাম্পাসে বিচরণ করে। এখানকার জলাশয়গুলোতে সাধারণত খয়রা, চখাচখি, বালিহঁাস, কাদাখেঁাচা, হেরণ, কালির্উ, বুনোহঁাস, ছোটসারস, বড়সারস, সরালি, পিচাডর্, মানিকজোড়, জলপিপি, ফ্লাইপেচার, পিচাডর্, গাগেির্ন, মুরগ্যাধি, কলাই, নাকতা, কোম্বডাক, পাতারি, চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি প্রজাতির পাখিদের সংখ্যাধিক বেশি।

অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে দেশীয় পাখিরা আসা শুরু করলেও পরিযায়ী পাখিদের সাধারণত নভেম্বরের ২য় সপ্তাহ থেকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়। জানুয়ারির মাঝামাঝি পযর্ন্ত পাখিদের এই বিচরণ লক্ষ্য করা যায়।

এ ছাড়াও ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলোতে তিন ধরনের (সাদা, নীল ও লাল) শাপলা ফুল পাওয়া যায়। এর মধ্যে সাদা শাপলা দেশের সব জায়গায় দেখা গেলেও নীল ও লাল শাপলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। লাল শাপলার অন্য নাম রক্ত কমল। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘নাইমপাইয়া রুবরা’। এটি জলজ উদ্ভিদ, এর পাতা এবং বেঁাটা লালচে সবুজ। এর ফুল প্রায় ১০-২০ সেন্টিমিটার চওড়া হয়ে থাকে। যাতে সাধারণ শাপলার চেয়ে অনেক বেশি পাপড়ি থাকে। সাধারণত পাপড়িগুলোর রং হয় লাল। ফুলটি সাধারণত রাতের অন্ধকারে ফোটে। নীল ও লাল শাপলায় ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলো একসময় ভরপুর থাকলেও এখন তা অনেক কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃর্পক্ষ জলাশয়গুলো বাণিজ্যিক হারে লিজ দেয়া শুরু করলে আস্তে আস্তে অনিন্দ্য সুন্দর শাপলা হারিয়ে যাচ্ছে। কতৃর্পক্ষের অবহেলার কারণে জলাশয়গুলোতে পলি জমে ভরপুর। তার ওপর কচুরিপানা ও মানবসৃষ্ট আবজর্না পরিষ্কার করা হয় না। ফলস্বরূপ জলাশয়গুলো এরকম বিচিত্র, বাহারি ও দৃষ্টিনন্দন শাপলা ফুলের জন্য বৈরীপরিবেশ ধারণ করছে। পাখিরা এই সব শাপলাফুল বেষ্টিত জলাশয়গুলোতে বেশি আশ্রয় নিয়ে থাকে। জলাশয়ে ফুলের সংখ্যা কমে যাওয়াতে অতিথি পাখিদের উপযুক্ত পরিবেশের বিঘœ ঘটছে। যার ফলে পাখিদের সংখ্যাও দিনে দিনে কমছে। এ ছাড়াও জলাশয়গুলোতে পানির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে বিগত বছরগুলোর তুলনায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্র্র্র্র্র্র্রার অফিসের অধীনে জলাশয়গুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পাখির নিরাপদ আবাস ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে এস্টেট শাখা। কিন্তু তাদের দায়িত্বে অবহেলার প্রতিফলন জলাশয়গুলোতে প্রতীয়মান হচ্ছে। তবুও কোনো দৃশ্যমান কাজ তারা করছে না।

উল্লেখ্য, প্রত্যেক মৌসুমে অতিথি পাখির জন্য জলাশয়গুলোতে বঁাশ ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে বিশেষ মাচা তৈরি করা হয়। যা গত দুয়েক বছর থেকে তৈরি করা হচ্ছে না। জলাশয়গুলোর আশপাশে দশর্নাথীের্দর কোলাহল, পানিতে ময়লা-আবজর্না ফেলা, গাড়ির হনর্, মাইকিং ও পাখিদের লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশাসনের নিদের্শনা থাকলেও দশর্নাথীর্রা এসব মানছেন না।

আশার খবর হচ্ছে এই যে, এরই মধ্যে পাখিদের নিরাপদে বিচরণ ও অবস্থানের জন্য বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এ ব্যাপারে বিভিন্ন নীতিমালা ও সচেতনতামূলক সংবলিত পোস্টার, প্ল্যাকাডর্ লাগিয়েছে। এ ছাড়াও সেভ দ্যা নেচার নামে একটি গ্রæপ এব্যাপারে বেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। তারা জলাশয়ের তীরগুলোতে সচেতনতামূলক প্ল্যাকার্ড লাগানোর ব্যবস্থা করেছে।

জলাশয়ে হাজারো পাখির কিচিরমিচির এবং লাল ও নীল শাপলা একসঙ্গে দেখলে পাষাণ হৃদয়ের মানুষেরও মন ভালো হতে বাধ্য। এমনি এক প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এখানে সূযর্ উঠে পাখির কলতানে, শিক্ষাথীের্দর ঘুম ভাঙে অতিথিদের ডাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র কারণে এ ক্যাম্পস প্রকৃতির রানি, সবুজ ক্যাম্পাস, অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। কিন্তু আমরা কি সত্যিই সচেতন আমাদের এই বিশ্লেষণ ধরে রাখতে। শিক্ষক, শিক্ষাথীর্ ও দশর্নাথীর্ হিসেবে ক্যাম্পাসের এই প্রকৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে আমরা কতটুকু মূল্যবোধের পরিচয় দিতে পেরেছি তা সময়ই বলে দেবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31175 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1