শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘ পাহাড়ের মিতালিতে একদিন

শামীম শিকদার
  ২৫ মে ২০১৯, ০০:০০
আদিবাসী পলস্নী ও তাদের বিচিত্র সংস্কৃতি শ্রীমঙ্গলকে করেছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার

চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঝর্ণা। ঘন সবুজের মাঝে অসংখ্য ছোট বড় টিলা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পাহাড় ও রুপালি জলরাশি মিশ্রিত জনপথটি প্রথমবার যে কোনো ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। পাহাড় ঘেরা বন বনানী, যেখানে নীল আকাশ মিতালি করছে সবুজ পাহাড়ের সঙ্গে স্তরে স্তরে সাজানো এই সবুজ বৃক্ষরাজিকে কখনও মনে হয় সাগরের ঢেউ, কখনও বা সবুজ মাঠ। দক্ষ শিল্পী যেন স্তরে স্তরে সবুজ বৃক্ষ সাজিয়ে রেখেছে। সেই সবুজের ভাঁজে ভাঁজে পাখির কলকাকলি, নিঃশব্দের সুর বাজে। বলছি সিলেটের চায়ের শহর শ্রীমঙ্গলের কথা.....

আমাদের পরীক্ষা শেষ, বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। সারাদিন রুমে বসে ও শুয়ে সময় কাটাতে কাটাতে এক প্রকার ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি বললে হয়তো ভুল হবে না। হঠাৎ কলেজ থেকে বিভাগীয় প্রধান স্যারের ফোন, আগামী মঙ্গলবার কলেজ থেকে আমরা সিলেটের শ্রীমঙ্গল শহরে যাচ্ছি। কোনো কিছু না ভেবেই বলে দিলাম আমি যাচ্ছি। এক এক করে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবাইকে ফোন দিলাম। অনেকেই রাজি হলো। সোমবার সকালে হিসাব করে দেখলাম আমাদের ৩য় বর্ষ থেকে ২০ জন যাচ্ছি। সবার সিদ্ধান্তে মাথায় আসল ব্যতিক্রম একটি চিন্তা। তা হলো আলাদা টি-শার্ট তৈরি করা। সবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এই অল্প সময়েই তৈরি হয়ে গেল আমাদের আকর্ষণীয় টি-শার্ট। সামনে লেখা হলো 'শিক্ষা সফর-২০১৯' 'হিসাববিজ্ঞান বিভাগ' এবং পেছনে লেখা হলো 'চলো হারিয়ে যাই চা বাগানে'। মঙ্গলবার সকাল ৭টায় বাস ছাড়বে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে। আমাদের প্রস্তুতির কোনো শেষ নেই। শিক্ষা সফরের যাওয়ার আনন্দে রাত ভর চোখে কোনো ঘুম নেই। সকাল ৬টায় আমরা সবাই কলেজ ক্যাম্পাসে হাজির। এক এক করে সবাই বাসে ওঠলাম। অবশেষে আমার সিটই নেই। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত চেয়ার বসিয়ে বসতে হলো। ভেবেছিলাম তেমন আনন্দ হবে না। কিন্তু কাপাসিয়া পেরিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলায় আমাদের বাস ঢুকতেই শুরু হয়ে গেল আনন্দ উৎসব।

প্রায় দেড় শতাধিক বছরের প্রাচীন চা শিল্পের ঐতিহ্যের গৌরব বহনকারী সুদীর্ঘকালের পথ পরিক্রমায় প্রাকৃতিক আশ্রয়ে গড়ে উঠা পাহাড়ি এবং সমতল ভূমির ওপর এই উপজেলা শহরের অবস্থান। প্রাকৃতিক অপরূপসৌন্দর্য আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই শ্রীমঙ্গলে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, পাহাড়ি ঝর্ণা, পাহাড়, সমতল ভূমি আর হাইল-হাওরের মতো জলাভূমি এবং পাখির অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্র।

বাংলাদেশে মোট ১৩৮টি চা বাগানের মধ্যে এখানেই রয়েছে ৩৮টি। শ্রীমঙ্গল তাই চায়ের রাজধানী। জেলা সদর মৌলভীবাজার থেকে চায়ের রাজধানীর দূরত্ব ২০ কিলোমিটার মাত্র। উপজেলার আয়তন ৪২৫.১৫ বর্গকিলোমিটার। এ শহরের অন্যতম আকর্ষণ বাগানে পাতা তোলায় মগ্ন ভাস্কর্য চা কন্যা। ২৪ ফুট উঁচু ওই শুভ্র ভাস্কর্যের পিঠের ঝুড়িতে কত চা পাতা জমলো কে জানে? সাতগাঁও চা বাগানের সহায়তায় ২০১০ সালে এই ভাস্কর্য তৈরি করে মৌলভীবাজার জেলা প্রসাশন। সঞ্জিত রায় এই ভাস্কর্যের শিল্পী। চা কন্যার সামনেই বিস্তীর্ণ এলাকায় বিছিয়ে রয়েছে সাতগাঁও চা বাগান। চা বাগান, লেক, ঝর্ণা, উঁচু-নিচুঁ টিলা, টিলার ভেতর দিয়ে উঁচু-নীচুঁ আঁকাবাঁকা পথ, আদিবাসী পলস্নী ও তাদের বিচিত্র সংস্কৃতি শ্রীমঙ্গলকে করেছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার।

ভ্রমণে অর্পণ স্যারের ধম ফাটানো হাসির কৌতুক, সুমনের বেসুরা গলায় গান, ফাহিম ও আরফানের খাবার বিতরণ, কিবরিয়া ও মাধবের আপেল নিয়ে ঝগড়া, লিজা, মেহেদী, নাইমের ড্যান্স, মাঝপথে কুপন বিক্রি, সবার এক রঙের টি-শার্ট, পানসী রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার, সাত রঙের চা, প্রকৃতির ধাঁধাঁনো সৌন্দর্যে ভরা চায়ের দেশের ভ্রমণ যেন বারবার বলে চলো হারিয়ে যাই চায়ের দেশে।

যতদূর চোখ যায় মসৃণ সবুজে ছাওয়া উঁচু-নিচু টিলা, উপরে বিস্তীর্ণ নীলাভ আকাশ। এদিক ওদিক তাকালেই চোখে পড়ে সবুজ বনানী আর বর্ণিল সব পাখি। চা বাগান, লেক, হাওর, উঁচু-নিচু পাহাড়, ঘন জঙ্গল, খনিজ গ্যাসকূপ আর আনারস, লেবু, পান, আগর ও রাবার বাগান দিয়ে সাজানো অদ্ভুত সুন্দর এই স্থানটির নামই যেন শ্রীমঙ্গল। শেষে আমরা গেলাম মাধবপুর লেকে। পাহাড় ঘেরা একটি লেক। লেকের পানিতে ফুটে আছে অসংখ্য নীল পদ্ম। চারিদিকের সবুজের ছায়া পড়েছে লেকের পানিতে। শীতের পুরনো জীর্ণ শুকনো পাতা ঝরে গাছে গাছে গজিয়েছে নতুন পাতা। প্রকৃতির এই বসন পরিবর্তনের সৌন্দর্য প্রতিফলিত হচ্ছে মাধবপুর লেকে। পাহাড়ের গায়ে চা বাগানও আছে। পাহাড়ের ওপর থেকে লেকটি দেখতে আরও চমৎকার লাগে। পাহাড়ের উপরে বা টিলার পাশে দাঁড়ালে চোখে পড়ে লেকের সাদা স্বচ্ছ পানি। কারও হাতে সেলফি স্টিক, কারও হাতে ক্যামেরা আবার কারও হাতে মোবাইল। সবাই ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ত এই শান্ত প্রকৃতির পরিবেশকে উপভোগ করতে। এ যেন তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। সত্যি সত্যি হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে চা বাগানে। আমরা ঘণ্টা দেড়েক ছিলাম এখানে। তবে মাধবপুর লেকের সমস্ত সৌন্দর্য নিতে হলে সারাদিনও মনে হয় যেন যথেষ্ট নয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে আমরা বাসের উদ্দেশে হাটলাম। আমাদের বাস ছাড়ল মাগরিবের আযানের পর। শরীর খুব ক্লান্ত। তবে মন বেশ শান্ত। রাতের আঁধারে ধীর গতিতে বাস এগিয়ে চলল কলেজের উদ্দেশে। রাত ১২টায় আমরা পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50930 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1