শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
অভিভাবক বিমা

স্বপ্ন পূরণে শিক্ষার্থীদের পাশে

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া এ উদ্যোগের নাম 'অভিভাবক ইন্সু্যরেন্স' প্রকল্প। এ প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অভিভাবকদের ওই পলিসির আওতায় আনা হয়েছে। ফলশ্রম্নতিতে কোনো অভিভাবক স্বাভাবিক বা দুর্ঘটনায় মারা গেলেও অভিভাবক হারানো ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী পান আর্থিক সহযোগিতা, যার মাধ্যমে চলমান থাকে তার শিক্ষাজীবন
মারুফ ইসলাম
  ২০ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মেয়ে খাদিজা খালিদ খুশবু। কিন্তু বিধি বাম! এক সেমিস্টার যেতে না যেতেই বাবা পড়লেন অসুখে। মাত্র একুশ দিনের মাথায় মারাই গেলেন বাবা। চোখের পানি মুছতে মুছে খুশবু বলেন, 'ক্যান্সার হয়েছিল বাবার। বাবা যে আমাদের মাথার ওপর কত বড় ছায়া হয়ে ছিলেন তা বুঝতে পারি ফেব্রম্নয়ারির ১৭ তারিখ বাবার মৃতু্যর পর। আমাদের পুরো পরিবার এলোমেলো হয়ে যায়। সবচেয়ে বিপদে পড়ি আমি। আমার পড়ালেখার খরচ চালাবে কে? তখন ধরেই নিয়েছিলাম যে আমার পড়ালেখা আর হবে না।'

এটুকু বলে আবার চোখের পানি মোছেন খুশবু। তারপর ধরা গলায় জীবনসংকটের গল্প বলতে শুরু করেন, বাড়িতে মা আর ছোট ভাই আছে। ভাইটা নবম শ্রেণিতে পড়ে। দুজনের পড়ার খরচ কীভাবে চালাবেন মা? মাকে বলি, আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দেই মা। ছোট ভাই পড়ুক। মা শুধু কাঁদেন। এত মেধাবী মেয়েটার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে? এসএসসি ও এইচএসটি দুটোতেই যে মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে সেই মেয়ে আর পড়ালেখা করবে না? এত দুর্ভাগ্যও হয় মানুষের?

খুশবু জানান, ঠিক এই মুহূর্তেই তার মনে পড়ে অভিভাবক বিমার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অরিয়েন্টেশন ক্লাসে এই বিমা সম্পর্কে বলেছিলেন শিক্ষকরা। তিনি যোগাযোগ করেন নিজ বিভাগের সমন্বয়ক কর্মকর্তার সঙ্গে। সেই কর্মকর্তা অভিভাবক বিমার ফরম পূরণের ব্যবস্থা করে দেন। অভিভাবক বিমার সহায়তা পেয়ে খুশবুর শিক্ষাজীবন এখন চলমান।

হয়তো একই ঘটনা ঘটতে পারত কুমিলস্নার মেয়ে ইলমা আক্তার স্বর্ণার জীবনেও। হয়তো পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেত তারও। খুশবুর মতো স্বর্ণার বাবারও মৃতু্য ঘটছে আকস্মিকভাবে। খুশবু তবু একুশ দিন সময় পেয়েছিলেন বাবাকে চিকিৎসা করানোর, স্বর্ণা সেটিও পারেননি।

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় সেমিন্টারের এই শিক্ষার্থী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'জানুয়ারির ২৯ তারিখ রাতে হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান বাবা। ডাক্তারের কাছে নেয়ারও সুযোগ পাইনি।'

তারপর স্বর্ণার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। পড়ালেখার খরচ চালাবে কে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার খরচ একটু বেশিই। তা ছাড়া ছোট ভাইটাও উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। তারও পড়ালেখার খরচ আছে। এত খরচ কীভাবে জোগাবেন তার প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকা মা?

ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান স্বর্ণা। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সাক্ষাৎ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খানের সঙ্গে। তিনিই স্বর্ণাকে জানান, অভিভাবক বিমার কথা। সেই বিমা সুবিধা পেয়ে স্বর্ণার শিক্ষাজীবন এখন বাধাহীন।

অপরদিকে বোরহান উদ্দিনের গল্পটা একটু ভিন্ন। বোরহান পড়ছেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে দ্বিতীয় সেমিস্টারে। টাঙ্গাইলের ছেলে বোরহান পড়েন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে। 'আমাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসটা এত সুন্দর, এত সুবজ প্রকৃতিঘেরা যে দিনগুলো খুবই আনন্দে কাটছিল।

এই আনন্দময় দিনগুলোর মধ্যে হঠাৎ করেই একদিন দুঃখ নেমে আসে। সেটা ফেব্রম্নয়ারির ৭ তারিখ। স্ট্রোক করে বাবা মারা যান। বলছিলেন বোরহান। তার গলায় কান্নার একটা পিন্ড আটকে গেলে তিনি কথা থামিয়ে দেন। বারবার চোখ মোছেন।

এরপর অনিন্দসুন্দর ক্যাম্পাসটা তার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। সারাদিন মন খারাপ করে ক্যাম্পাসের এখানে সেখানে বসে থাকেন। আর মনে মনে ভাবেন, এত সুন্দর ক্যাম্পাস ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে। না গিয়েই বা উপায় কী? তার পড়ালেখার খরচ চালাবে কে? যিনি চালাতেন সেই বাবাই তো চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে!

এ রকম দুঃসময়ে বোরহানের মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের উদ্বোধনী ক্লাসের কথা। ওইদিন শিক্ষকরা বলেছিলেন 'অভিভাবক ইন্সু্যরেন্সের' কথা। মনে পড়া মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন অফিসে যোগাযোগ করেন বোরহান। তারপর সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায় তার, মুখে ফুটে ওঠে সেই আগের হাসি। বোরহান এখন 'অভিভাবক বিমার' সুবিধা নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আমাদের চারপাশে এমন খুশবু, স্বর্ণা ও বোরহানের মতো শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়। কেউ হঠাৎ করেই হারিয়েছে বাবা, কেউবা মা, কেউবা বড় ভাই কিংবা বোন- যারা ছিলেন পরিবারের অভিভাবক। অভিভাবক হারিয়ে তারা এখন অথই সমুদ্রে। কে বহন করবে তাদের পড়ালেখার খরচ?

এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া এ উদ্যোগের নাম 'অভিভাবক ইন্সু্যরেন্স' প্রকল্প। এ প্রকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে প্রগতি লাইফ ইন্সু্যরেন্স। এ প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অভিভাবকদের ওই পলিসির আওতায় আনা হয়েছে। ফলশ্রম্নতিতে কোনো অভিভাবক স্বাভাবিক বা দুর্ঘটনায় মারা গেলেও অভিভাবক হারানো ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী পান আর্থিক সহযোগিতা, যার মাধ্যমে চলমান থাকে তার শিক্ষাজীবন।

প্রগতি লাইফ ইন্সু্যরেন্সের সহযোগিতায় আজ সোমবার (২০ মে) খুশবু, স্বর্ণা ও বোরহানের অভিভাবক ইন্সু্যরেন্সের দাবি পরিশোধ করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ মিলনায়তনে 'অভিভাবক বিমা: চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠান' অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রগতি লাইফ ইন্সু্যরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. জালালুল আজিম এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে আরো উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও প্রগতি লাইফ ইন্সু্যরেন্সের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বিমাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বর্তমান অভিভাবকরাও। বিমার চেক হাতে পেয়ে অশ্রম্ন আড়াল করতে পারেননি খুশবুর মা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার মেয়ের পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় যে উপকার করল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমার মেয়ের অনিশ্চিত শিক্ষাজীবনটা নিশ্চয়তা পেল।

কান্না লুকাতে পারেননি স্বর্ণার মাও। অশ্রম্নভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, এমন উদ্যোগ সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই গ্রহণ করা উচিত। তাহলে আর কোনো ছেলেমেয়ের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে না।

চেক হাতে পেয়ে আবেগাপস্নুত হয়ে পড়েন তিন শিক্ষার্থীও। খুশবু বলেন, তিনি একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চান। স্বর্ণা চান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে, কারণ তার বাবা যে সেটাই চাইতেন। আর বোরহান বলেন,আমার বাবার এ অকাল প্রয়াণ আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। 'আমি সরকারি চাকরির চেষ্টা করব। বাবা চাইতেন আমি যেন সরকারি কর্মকর্তা হই।'

উলেস্নখ্য, প্রগতি লাইফ ইন্সু্যরেন্সের পরিশোধকৃত অভিভাবক বিমার অর্থ ওই শিক্ষার্থীর টিউশন ফির সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে তার শিক্ষাজীবন অব্যাহত থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58918 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1