শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তিভিত্তিক তর্কই বিতর্ক

যুক্তিবিহীন সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। দেশকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি যৌক্তিক তর্ক খুবই জরুরি। যৌক্তিক তর্ক তথা বিতর্ক মানুষকে পরমতসহিষ্ণুতা শেখায়, তরুণদের নেতৃত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখে। বিতর্কের ফলে আরও কী কী সুফল পাওয়া যায় সেগুলো জানাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কিছু বিতার্কিক। তাদের গল্প লিখেছেন অনিক আহমেদ।
নতুনধারা
  ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বিতর্ক একটি প্রতিবাদের ভাষা

বিতর্ক ও বিতার্কিক সম্পর্কে জনপ্রিয় মন্তব্যের মাঝে একটি হলো- 'ঝগড়া ছাড়া বিতর্ক কিছুই না আর বিতার্কিকরা কোনো কিছু পেলেই তর্ক করা শুরু করে।'

তবে আমার কাছে বিতর্ক একটি শিল্প, যা বিতার্কিকের মাঝে কখনো ডাইনেসিয়ান শিল্পের মতো আবার কখনো অ্যাপোলিনীয় শিল্পের মতো কাজ করে। এখানে ব্যক্তি সব কিছুর ঊর্ধ্বে যুক্তিকে আসীন করতে উন্মাদ আবার নিজের যুক্তির বাইরে অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুভব করার ব্যাপারে বিনয়ী। একজন শিল্পী যেমন সমাজের সব অন্ধকারের বিরুদ্ধে তার শিল্পকে আলো হিসেবে দাঁড় করান, তেমনি বিতর্ক একটি প্রতিবাদের ভাষা- যা সব মিথ্যা এবং অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার। সংসদ, সচিবালয় থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যে কোনো আলোচনায় নিজের মতের সঙ্গে অসংগতি পেলেই ব্যক্তিগত আক্রমণ, ভিন্ন প্রসঙ্গ এনে বহুরকম ফ্যালাসি তৈরি করা হয়। এরকম অসুস্থ পরিবেশ সংস্কারের জন্য দরকার যুক্তিবোধ যা বিতর্কের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে।

ফয়সাল মাহমুদ শান্ত

সভাপতি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট অর্গানাইজেশন

মানুষের মধ্যে সহনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক

বাংলা ভাষায় যে কোনো শব্দের পূর্বে প্রত্যয় যোগ হলে, শব্দটির বিশেষ অর্থ প্রকাশ পায়,? সে ক্ষেত্রে 'বিতর্ক' শব্দের পূর্বে ব্যবহৃত প্রত্যয় 'বি' একটি বিশেষ ধরনের তর্ককেই বুঝাচ্ছে বিতর্কের মাধ্যমে কোনো বিষয় বা কাজ করার যৌক্তিকতা খোঁজা হয়। এই বাকশিল্প শুধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় আর আন্তঃস্কুল বা কলেজের প্রতিযোগিতার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বিশ্ব রাজনীতির পটভূমি রচনায় প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বিতর্ক ২ হাজার বছর আগে থেকেই চলে আসছে, বর্তমান পৃথিবীতে তার গুরুত্ব আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বিতর্কের প্রসার সমাজকে গঠনমূলকভাবে এগিয়ে নেয়, সমাজের মানুষকে করে সহনশীল। অপরের ভালো যুক্তির সঙ্গে সহমত পোষণ করে একটা উন্নত সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বির্তকের মধ্যে দিয়েই জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা পোষণকারী ব্যক্তিবর্গ তাদের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে- ইতোমধ্যে ২০২০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে, মার্কিন টেলিভিশন বিতর্ক আয়োজন করা হয়। আর এই বিতর্কের বাস্তবিক চর্চার ফলেই, আজও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গণতন্ত্রের চর্চা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মানুষ যখন কোনো একটা সমস্যা বা স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে বিতর্ক করে জেতার জন্য চেষ্টা করে, ঠিক সেই সময়টাতে তার নিজের অজান্তেই সে নিজেই ওই সমস্যার স্টেকহোল্ডার হিসেবে ভেবে নেয়। কারণ ভেতর থেকে কথা বা যুক্তি তখনই বের হয়, যখন নিজেকে ভুক্তভোগীর জায়গায় রাখা যায়। এভাবেই একজন বিতার্কিক, বিতর্ক চর্চার মধ্যে দিয়ে হয়ে উঠে সুনাগরিক এবং দেশপ্রেমিক।

মুস্তাফিজুর রহমান

সদস্য সচিব

গণবিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি

দেশের ইতিবাচক অগ্রগতিতে সহায়তা করে

বাসার নিচে মামার চায়ের টং দোকানটিতে আমরা প্রায়ই দেখে থাকি এলাকার মধ্যে আলোড়ন ফেলা মানুষগুলো ব্যস্ত তাদের নিজেদের মতো প্রকাশের জন্য। কিন্তু মত প্রকাশের প্রেক্ষাপট যদি মনের চোখ দিয়ে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখতে পারব, সেখানে সবাই বাকযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে এবং শেষে সবাই একটি যুক্তিহীন মন-মানসিকতা নিয়ে সেখান থেকে চলে যাচ্ছে। আর এখানেই পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তর্ক এবং বিতর্কের মাঝে। বিতর্ক এমন একটি শব্দ যার মাঝে লুকিয়ে আছে অনেক ইতিবাচক বিষয়বস্তুর ছন্দপতন। যে বিষয়গুলো আমাদের শেখায় কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে নিজেকে অপরের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। আরে শেখায় কিভাবে অপরের মতাদর্শকে মূল্য দিতে হয় এবং কিভাবে যুক্তিনির্ভর কথা বলতে হয়। বির্তকের মাধ্যমে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বিতর্ক চলাকালে কোনো একপর্যায়ে একজন বিতার্কিক তার ভুলগুলো উপলব্ধি করতে পারেন। যার ফলে একজন মানুষের মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হয়।

মো. ফারদিন জাহান সীমান্ত

ঢাকা বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বক্তা

জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৯

বিতর্ক স্বসম্মানে দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদান

নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশেষ নিয়মে বক্তব্য প্রদানকে বিতর্ক বলে। বিতর্কে দুই বা ততোধিক দল থাকে, যারা প্রত্যেকেই নিজেদের বিষয়ের স্বপক্ষে তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তির আলোকে নিজ নিজ বক্তব্য প্রদান করেন। সনাতনী ও সংসদীয় বিতর্কে দুটি দল, অন্যদিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি (বিপি) বিতর্কে ৪টি দল আর বারোয়ারি বিতর্কে প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা পক্ষ। উপর্যুক্ত প্রত্যেকটি বিতর্কে প্রত্যেক দল এবং ব্যক্তি নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নিজ নিজ বক্তব্য প্রদান করেন। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে স্টান্ড পয়েন্ট নির্ধারিত হয় এবং সে আলোকে প্যারামিটারের ভিত্তিতে প্রত্যেক বক্তা বক্তব্য প্রদান করেন। সুতরাং বিতর্ককে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিভিন্ন দল কিংবা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদান বলতে অতু্যক্তি হবে না।

মো. মতিউর রহমান

সভাপতি, নৈয়ায়িক

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

যুক্তিভিত্তিক তর্কই বিতর্ক

বিতর্ক অনেকের কাছে ব্যাপারটা শুধু তর্ক, আমার কাছে ব্যাপারটা মোটেও তেমন না। আমার কাছে ব্যাপারটা হলো 'যুক্তি দিয়ে তর্ক'। এটা কোনো ঝগড়া না!যদি সত্যি মনে হয় অপর মানুষটি ভুল বলছে, তাহলে যুক্তি দিয়ে তাকে শোধরায়ে দেয়া হয়। এমনকি যদি নিজেও ভুল করি আমরা, তাহলে অপরের যুক্তি মেনে নেয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। একজন বিতার্কিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা মোটেও সহজ কাজ না। এর জন্য পরিশ্রম, অধ্যবসায় দরকার এবং অনেক পড়াশোনা করার দরকার। এটাও অন্যদের সঙ্গে বিতার্কিকের তফাৎ। বিতার্কিকদের কোনো একটা ঘটনার গভীর পর্যন্ত জানতে হয় এবং সেগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হয়। এই ধরনের পড়াশোনার ফলাফল হয়তো তৎক্ষণাৎ পাবে না, কিন্তু একটা সময় পর দেখা যাবে নিজের ভেতরে অনেক তথ্যের ভান্ডার আছে। বর্তমান সময়ে পড়াশোনা হয়ে গেছে একদম একাডেমিক সিলেবাস নির্ভর। শিক্ষার্থীরা এর বাইরে পড়ার সুযোগ পায় না বা পড়তে চায় না। যার কারণে জানার পরিধি একটা জায়গায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে। অনেকে বলতে পারে, এসব জেনে কি হবে? আমার যুক্তি, কোনো কিছু জানার মাঝে কোনো ক্ষতি নেই। আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি কোথায় আছে, ১৯৭১ এ কোথায় ছিল, আগামী ২০ বছরে কোথায় যাবে, আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, রাশিয়া-আমেরিকা দ্বন্দ কোথায় যেয়ে ঠেকবে, বিশ্ব নেতারা কি ভাবছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিজেদের মাঝে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো কেমন যাচ্ছে, ভারতে জম্মু কাশ্মীরের কি হবে, ভারতের বিজেপি সরকারের অবস্থান, চীনের পরিকল্পনা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় আছে যেগুলো জানা কোনো সময় অপচয় না। বরং এগুলো নিজেদের আরো ৮-১০ জন থেকে আলাদা করে দেবে। বিতার্কিকরা এসব জানার চেষ্টা করে এবং নিজেদের অনেক বেশি উন্নত করার চেষ্টা করে।

তানভীর রিফাত

সাধারণ সম্পাদক

রাজশাহী ডিবেট ফোরাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<74034 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1