বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
জা হা ঙ্গী র ন গ র বি শ্ব বি দ্যা ল য়

নীল দরিয়ার সান্নিধ্যে একটুকরো মায়াবন

নুসরাত জাহান
  ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চতুর্থবর্ষের ফিল্ডটু্যর ছিল। আমাদের এই টু্যরটি অন্য যে কোনো বিভাগের টু্যরের থেকে আলাদা হয় সবসময়ই। বেশিরভাগ বিভাগ থেকেই আয়োজিত হয় পেস্নজারট্রিপ, যেখানের উদ্দেশ্য থাকে শুধুই ঘোরাঘুরি কিন্তু আমরা যাই প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে তাকে অবজারভ করতে। গত তিন বছরে যথাক্রমে বাংলাদেশের তিনটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অঞ্চল- দিনাজপুর, সুন্দরবন এবং সিলেট এক্সপেস্নার করে এইবার আমাদের স্নাতক সম্মানের শেষ টু্যরটি ছিল টেকনাফ-কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রিজিয়নে।

সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় আমরা ক্লাসের আটান্নজন শিক্ষার্থী রওনা হই। সঙ্গে ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সারির অন্যতম জিওগ্রাফার প্রফেসর ড. মো. শামসুল আলম, ড. শাহেদুর রশিদ, এবাদুলস্নাহ খান এবং ড. তানজিনুল হক মোলস্না। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল টেকনাফ। সন্ধ্যে সাড়ে ৭টার বাসে রওনা হয়ে আমরা পরদিন আনুমানিক ৮টার দিকে পৌঁছে যাই টেকনাফ। সেখান থেকে হালকা নাস্তা সেড়ে ৯টার শিপে করে যাত্রা শুরু করি সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে। শিপে উঠার পর স্বাভাবিকভাবেই সবার মাঝে এক্সাইটমেন্টটা ছিল খুব বেশি- কারণ আমরা ৫৮ জন শিক্ষার্থীর মাঝে সিংহভাগই এর আগে কখনো সেন্ট মার্টিন আসিনি। নিচে তাকালে অবিরাম নীল পানির ঢেউ আর উপরে তাকালে সীমাহীন নীল আসমান। এর মাঝে ডানা ঝাপটে ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওড়াউড়ি করছে হাজারো শঙ্খচিল। আমরা অনেকেই ক্যাম্পাস থেকে শুকনো খাবার এনেছিলাম ব্যাকপ্যাকে। সবাই যে যার মতো খাবার ছুড়ে দিতে লাগলো শঙ্খচিলের দিকে। খাবার ধরতে ধরতে শঙ্খচিলগুলো যেন হাতের একদম কাছে চলে আসছিল। মনে হচ্ছিল এরাই যেন এই সমুদ্র, ঢেউ, জাহাজ আর পর্যটকদের বহুবছরের সাক্ষী। ডানা ঝাপটে স্বাগত জানায় দৈনিক হাজারো পর্যটককে। শিপ যতই এগিয়ে যাচ্ছিল সমুদ্রের ঢেউ ততই উত্তালরূপ ধারণ করছিল। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম সমুদ্রের কিনার ঘেঁষে টেকনাফ সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকতটি তুলনামূলকভাবে কোলাহলমুক্ত। এরও বেশকিছু দূরে যাওয়ার পর যখন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে শিপ হেলেদুলে যাচ্ছিল তখন সমুদ্রের মাঝে সাড়ি সাড়ি জেলেনৌকা থেকে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কত নির্ভয়েই না তারা এই ছোট নৌকা নিয়ে জীবিকার তাগিদে অবিরাম মাছ ধরে যায় এই উত্তাল নীল দরিয়ায়। এ সময় বন্ধুমহল থেকে কে যেন গলায় সুর বাঁধলো-

ওরে নীল দরিয়া,

আমায় দে রে, দে ছাড়িয়া

বন্দি হইয়া মনোয়া পাখি, হায় রে

কান্দে রইয়া রইয়া ....

ও রে নীল দরিয়া ...

সত্যিই এই নীল দরিয়া যেমন মানুষের মনকে চঞ্চল করে তোলে, তেমনভাবেই পরমুহূর্তে ঠেলে দেয় উদাসীনতার সমুদ্রে। বেখেয়ালি মনে এসব চিন্তা আর মজা-মাস্তি করতে করতে কখন যে তিন ঘণ্টা সময় চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। একবন্ধু খুশিতে আত্মহারা হয়ে চিলিস্নয়ে উঠলো 'ওইতো দারুচিনি দ্বীপ। আমরা এসে গেছি।' এরপর জেটির ধারে এসে শিপ থামল। শিপ থেকে নেমে এই প্রথম পা রাখলাম সেন্ট মার্টিনের ভূমিতে। হঁ্যা, আমরা পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে বা দারুচিনি দ্বীপ বা নারিকেল জিঞ্জিরা- যা কিছুই বলি না কেন, জেটি থেকে দাঁড়িয়ে যখন যতদূর চোখ যাচ্ছিল শুধু সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, এর থেকে সুন্দর আর কী বা হতে পারে! এরপর স্যাররা সবাই ঠিকমতো শিপ থেকে নেমেছে কিনা চেক করার জন্য রোলকল করলেন। সবাই উপস্থিত হলে আমরা ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে রিসোর্টের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় সমুদ্রের তীর ধরেই নির্মিত 'সমুদ্র কানন' রিসোর্ট পুরোটাই বুকড ছিল আমাদের জন্য। রিসোর্টে পৌঁছানোর পর প্রফেসর শামসুল আলম আমাদের একটা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিলেন। এর মধ্যে রুম গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে তৈরি হতে হবে প্রাথমিক কাজের জন্য- যেখানে আমরা সেন্ট মার্টিন এলাকাটি অবজারভ করব। যথা সময়ে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। চারজন শিক্ষকের আগেপিছে আমরা শিক্ষার্থীরা সৈন্যদলের মতো হেঁটে যাচ্ছিলাম। জিওগ্রাফার হিসেবে স্যারের কাছে এটাই হলো প্রকৃতিকে অবজার করার অন্যতম পন্থা। হাঁটার কোনো বিকল্প হতে পারে না। প্রায় সূর্য ডোবার আগপর্যন্ত স্থানীয় মানুষের জীবিকা, দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় তারা কিভাবে সারভাইভ করে, পর্যটক এবং জীববৈচিত্র্য দেখে, সানসেট উপভোগ করে রিসোর্টে ফিরলাম। এরপর থেকে সেন্ট মার্টিন যতই দেখছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম। নিজ জন্মভূমির মাঝে এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক উদ্যান ভাবতেই মনে দোলা দিয়ে ওঠে। এরপর রাতে টুকটাক কাজ, স্যারের ব্রিফিং এবং রাতের খাবারের পর বন্ধুরা মিলে হালকা আড্ডা দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সবাই দ্রম্নত ঘুমোতে গেলাম- কারণ ব্রিফিংয়ে স্যার বলে দিয়েছেন, আগামীকাল ভোর সাড়ে ৫টায় বের হয়ে আমরা সানরাইজ দেখব এবং প্রায় ১৪ কি.মি. হেঁটে পুরো সেন্ট মার্টিন এক্সপেস্নার করব। আমরা তখনো বিশ্বাস করিনি যে, পরদিন সত্যিই আমাদের জন্য এমন একটি দিনের অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে। যথারীতি পরের দিন ভোরে সবাই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ি সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্য। সকালের শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ দেখতে দেখতে যখন ভেজা বালুর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল এই যেন স্বর্গ। ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছিল তীরে। আসলে এই সৌন্দর্যের প্রকাশের জন্য ভাষা যথেষ্ট নয়। আস্তে আস্তে নীল জলরাশির ওপর কমলার নির্যাশের মতো ভেসে উঠলো সূর্য। আমরা সবাই কিছুক্ষণ সূর্যোদয় দেখে আবার হাঁটা শুরু করলাম। সেন্ট মার্টিনের যত দক্ষিণে যাচ্ছিলাম তত কেয়াবনের ঘনত্ব বাড়ছিল। আমরা জিওগ্রাফিক্যাল ফিচার, স্ট্রাকচার, ফরমেশন ইত্যাদি অবজারভ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার উদ্দেশ থাকলেও সরকারি রেস্ট্রিকশন অমান্য করে শিক্ষকরা রাজি হলেন না সেখানে নিয়ে যেতে। প্রায় আট কি.মি. হাঁটার পর আমরা পৌঁছলাম সেন্ট মার্টিনের কোকোনাট কোরাল পয়েন্টে। এই জায়গাটা বলতে গেলে জনমানবহীন। বেশখানিকটা জায়গা জুড়ে জন্মে উঠেছে সাড়ি সাড়ি কেওড়া গাছ- যা ঠিক সুন্দরবনের ফ্লেভার এনে দেয়। আমার মনে হয়, আমাদের মতো করে কেউ সেন্ট মার্টিন ঘুরেনি। সেন্ট মার্টিনের সম্পূর্ণ কোলাহলহীন কোকোনাট কোরাল পয়েন্টে যেভাবে ফিনকি দিয়ে কোরালের উপর ঢেউ আছড়ে পড়ে, কেওড়া বনের মাঝে পাওয়া যায় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ফ্লেভার- এমন আর কোথাও পাওয়া যায় না। সমুদ্রের মাঝে আছে সৌন্দর্যে ভরপুর শূন্যতা। এই শূন্যতায় যেন যুগ যুগ হেঁটে হারিয়ে যাওয়া যায়। প্রায় ১০ কি.মি. হেঁটে সবাই যখন একদম ক্লান্ত তখন চোখে পড়লো আরেকটি সৈকত এবং তুলনামূলকভাবে মূল সৈকতের চাইতে এটি অনেক বেশি মনোরম। এখানে মানুষের পদচারণা একদমই নেই। মূল সেন্ট মার্টিন থেকে অনেক দূর এবং তেমন কোনো বসতবাড়ি না থাকায় এদিকটায় কেউই আসে না। সেখান থেকে আরো পাঁচ কি.মি. হেঁটে অবশেষে আমরা ফিরলাম রিসোর্টে। স্যার একটা ছোটো ব্রিফিং দিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমাদের যথেষ্ট সময় দিলেন বিশ্রামের। এরপর থেকে একাডেমিক কাজ, সেন্ট মার্টিনের নীল জলরাশির আছড়ে পড়া ঢেউ, ঢেউয়ের গর্জন, সমুদ্রের পাড় ধরে টং দোকানগুলোতে সামুদ্রিক মাছ ভাজার ছড়িয়ে পড়া গন্ধ আর পূর্ণিমার আলোয় সমুদ্র তীরের চিকচিক বালুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কেটে গেল প্রায় তিনটি দিন। আমাদের টু্যর শিডিউল থেকে শেষ হয়ে গেল সেন্ট মার্টিন। সময়গুলো শেষ হয়ে যাওয়ার মূহূর্তে বারবার মনে হচ্ছিল ভাগ্যিস আমিও একজন জিওগ্রাফার, নাহলে এভাবে পুরো সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য হয়তো কখনওই দেখা হতো না। এরপর সেন্ট মার্টিন থেকে আমরা ফিরে এলাম টেকনাফে। সেখান থেকে প্রায় চারঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম কক্সবাজার। সেদিন আমাদের আর কোনো কাজ করা হলো না। এর পরদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ইনানী সমুদ্র সৈকতে, প্যারাসেইলিং পয়েন্টে এবং ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ সেন্টারে। কক্সবাজারে কাজের চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকায় আমরা ঘোরাঘুরিই বেশি করলাম। শেষদিন আমদের শেষ গন্তব্য হলো মহেশখালী দ্বীপ। শৈত্যপ্রবাহের মতো আবহাওয়ায় সকালের দিকে ট্রলারে চেপে আমরা রওনা হলাম মহেশখালীর উদ্দেশে। ট্রলার যখন বঙ্গপোসাগরে পড়ল তখন সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের মুখে ট্রলারটা ভয়ানকভাবে দুলছিল। এও যেন এক রকম পুলসিরাত। মহেশখালী দ্বীপে পৌঁছেই জেটির ধার বেয়ে বেড়ে উঠা হাজারো কেওড়া গাছ আর শ্বাসমূল দেখে মনে হচ্ছিল যেন আরেকবার সুন্দরবনে চলে এসেছি। এরপর লোকালয়ে প্রবেশ করে প্রথমেই দেখলাম ঐতিহ্যবাহী আদিনাথ মন্দির- যা কিনা বিশাল খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সিঁড়ির মাধ্যমে উপরে উঠে গেছে। আমরা সবাই সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। স্যার আমাদের চারপাশ ভালোভাবে দেখিয়ে এই এলাকা সম্পর্কে বললেন। এইখানকার মানুষের জীবিকার অন্যতম পন্থা হলো পানের বরজ এবং লবণ উৎপাদন। আমাদের দেশে লবণ রপ্তানির প্রায় অর্ধাংশ নির্ভর করে এই মহেশখালী দ্বীপের লবণ উৎপাদনের ওপর। এরপর পুরো মহেশখালী দ্বীপটা মোটামুটি ঘুরে দুপুরের খাবার শেষে আমরা ফেরার জন্য রওনা হলাম। মহেশখালী দ্বীপের মধ্য দিয়েই শেষ হলো আমাদের স্নাতক সম্মানের শেষ টু্যর। কক্সবাজার থেকে রাত ৯টার সময় আমরা রওনা হলাম আমাদের সেই পুরনো ঠিকানায়, ক্যাম্পাসের উদ্দেশে। ফেরার সময় শুধু মনে মনে বারবার বলছিলাম, 'আমরা আবার আসব'। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শাণিত রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ মানুষের মনকে কেড়ে নেবে অনায়াসেই। সমুদ্রপিপাসুদের কাছে গত কয়েকযুগ ধরে এটি যেন এক তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রের উপচে পড়া এই নীল জলরাশির ঢেউ মানুষকে বারবার টেনে নিয়ে আসে এর দ্বারে। একজন বাংলাদেশি নাগরিক ও জিওগ্রাফির স্টুডেন্ট হিসেবে এই সৌন্দর্য উন্মোচন করতে না পারলে কিছু একটা অতৃপ্তি নিয়েই হয়তো বয়ে যেত জীবন। সত্যিই এই নীল দরিয়ার মাঝে আছে এক নিগূঢ় মহিমময়তা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<86062 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1