শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বটের পাতা

রিনুর স্কুল ছুটি হয়েছে বেশ আগেই। কিন্তু ও এখনই ঘরে ফিরবে না। গত সপ্তাহে আমিনুল স্যার বলেছেন, রোজ স্কুল থেকে ফেরার পথে ভালো কাজ করতে করতে যেতে। প্রতিটি ভালো কাজের জন্য ১০ নম্বর করে দেবেন। এ কয়দিনে সবাই সত্তর-আশি নম্বর তুলে ফেলেছে। রিনু এখনো কোনো নম্বরই পায়নি...
মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

‘ও মা গো!’ হঠাৎ কঁুকিয়ে উঠল বৃদ্ধ লোকটা। একপায়ে খেঁাড়াতে খেঁাড়াতে পথের পাশে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। পায়ের তলাটা মেলে ধরে মাথা নুয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল।

ভাদ্র মাস। ভ্যাপসা গরম। বৃদ্ধ লোকটা শিরীষ, মাদার, অশ^ত্থ আর বঁাশবাগানের ছায়া ধরে ধরে ওই পথ দিয়ে হেঁটে আসছিল। খালি গা। কঁাধে গামছা। বোধহয় বাজারের দিকে যাচ্ছিল। স্কুলের দিকেও যেতে পারে। বাজারের কাছেই স্কুলÑপঞ্চবটী প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুল ছুটি হলে বাবা-মা, না হয় দাদা-দাদিদের কেউ বাচ্চাদের এগিয়ে নিতে আসে। না এলে ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে বাড়ির পথ ধরে। ছোট্ট থানাশহর। পথেঘাটে অত গাড়িঘোড়া নেই।

রিনুর স্কুল ছুটি হয়েছে বেশ আগেই। কিন্তু ও এখনই ঘরে ফিরবে না। গত সপ্তাহে আমিনুল স্যার বলেছেন, রোজ স্কুল থেকে ফেরার পথে ভালো কাজ করতে করতে যেতে। প্রতিটি ভালো কাজের জন্য ১০ নম্বর করে দেবেন। এ কয়দিনে সবাই সত্তর-আশি নম্বর তুলে ফেলেছে। রিনু এখনো কোনো নম্বরই পায়নি। আমিনুল স্যারের সবুজ রঙের খাতায় ওর নম্বর শূন্য; অবিন্তার ৮০, ফারাজের ৬০। অবিন্তা রাস্তার একটি ক্ষুধাতর্ কুকুরকে পাউরুটি কিনে খাইয়েছে, স্কুলের পেছনে একটা নিমগাছ লাগিয়েছে, আরও কী কী যেন করেছে; আর ফারাজ এক অন্ধ ভিখিরিকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করেছেÑ এরকম সবাই কিছু না কিছু করেছে। রিনু যখন দেখল, বৃদ্ধ লোকটি পথের ধারে বসে পড়েছে, ও বিশাল শিরীষ গাছটার পেছন থেকে বেরিয়ে এলো। লোকটি তখন যন্ত্রণায় কেঁাকাচ্ছিল। রিনু জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার বুঝি কঁাটা বিঁধেছে?’ বৃদ্ধ লোকটি চোখ কুঁচকে ওর মুখের দিকে তাকাল, ‘হ্যঁা, তা তুমি কে?’ ‘আমি রিনু। আমি তোমার কঁাটা তুলতে এসেছি।’ রিনু উপুর হয়ে বসল। তারপর সত্যি সত্যি ও লোকটির পায়ের তলা থেকে একটা কঁাটা তুলে আনল। কঁাটাটা ঝোপের ভেতরে ফেলে দিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘এবার তুমি আরাম পাচ্ছ তো?’

‘একটু পাচ্ছি।’

‘একটু দঁাড়াও, তোমার আরও আরাম লাগবে,’ রিনু ওর ব্যাগের ভেতর থেকে এক থোকা দূবার্ঘাস বের করে মুখে পুরল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে থেঁতো করে, বৃদ্ধ লোকটির পায়ের তলায় লেপে দিল। রিনুর কাÐ দেখে এতক্ষণ সে হঁা-করে তাকিয়ে ছিল, এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তা, তোমার ব্যাগের ভেতরে কি সবসময় দূবার্ঘাস থাকে?’ বৃদ্ধের প্রশ্ন শুনে রিনু কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। শেষে মাটির দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে উত্তর দিল, ‘হ্যঁা, কার কখন কঁাটা বেঁধে, বলা যায়?’ বৃদ্ধ একবার ওর মুখের দিকে চেয়ে, উঠে দঁাড়াল, তারপর যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকে খঁুড়িয়ে খুঁড়িয়ে হঁাটতে থাকল। রিনু ওর ব্যাগের ভেতর থেকে খাতা বের করে ১ যোগ করল। খাতাটা ব্যাগের ভেতরে রাখতে গিয়েও রাখল না, বের করে গুনে দেখল, কতগুলো হয়েছে। ওর চোখ চকচক করে উঠলÑআর কয়েকটা হলে ও অবিন্তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু আজ বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। এত দেরি দেখলে, মা চিন্তা করবে। ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে ও বাড়ির পথে হঁাটতে শুরু করল।

সপ্তাহের শেষদিন। আমিনুল স্যার পঞ্চবটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুথর্ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, স্কুলের সামনের বিশাল বটগাছটির নিচে বসলেন। ছাত্রছাত্রীরা বসল সামনে। বাতাস বইছে। ওদের গায়ের পরে শুকনো বটের পাতা ঘুরে ঘুরে এসে পড়ছে। যার গায়ে যেটা পড়ছে, সেটা তার। তুলে নিয়ে নিজের কাছে রাখছে। আজ বটগাছের নিচে ক্লাস হবে। বাতাসে আমিনুল স্যারের কপালের ওপর থেকে চুল উড়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো ঠিক করতে করতে হঁাক দিলেন, ‘তা তোরা কী কী ভালো কাজ করলি এ সপ্তাহে, শুনি।’

অবিন্তা দঁাড়াল। আমিনুল স্যার তার ঝোলা থেকে সবুজ খাতাটা বের করে কোলের ওপরে মেলে ধরলেন। অবিন্তার দিকে তাকিয়ে, সবাইকে উদ্দেশ করে, কঠিন গলায় বললেন, ‘দ্যাখ্, সত্যি বলবি। মিথ্যে বললে আমি কিন্তু ধরে ফেলি।’ অবিন্তা ওর কথা শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের সমস্বর চিৎকারে থেমে গেল। সবাই একযোগে চিৎকার করে বলল, ‘জানি, স্যা-য়্যা-র।’ আমিনুল স্যার বললেন, ‘জানিস যখন, মনে রাখিস।’

অবিন্তা বলতে শুরু করল, ‘স্যার, আমি মাত্র একটা ভালো কাজ করেছি। আমার দাদুকে এক জোড়া জুতো কিনে দিয়েছি।’ ‘কেন রে, সামনে পুজো আসছে দেখে?’ আমিনুল স্যার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন নাÑঅনেকের কথা শুনতে হবেÑমাথা নিচু করে সবুজ খাতায় লিখলেন, ‘৮০ + ১০ = ৯০’। অবিন্তা কী যেন বলতে যাচ্ছিল, ফারাজ উঠে দঁাড়াল, ‘আমিও তো আমার নানুকে এক জোড়া জুতো কিনে দিয়েছি।’ আমিনুল স্যার ভ্রæ নাচিয়ে বললেন, ‘কেন, তোর তো পুজো নেই।’ ফারাজ কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বিরু, রাব্বি, ইশরাত, চৈতিসহ আরও কয়েকজন একসঙ্গে হুড়মুড় করে দঁাড়িয়ে গেলে, ফারাজ বসে পড়ল। আমিনুল স্যার তজর্নী নাড়িয়ে গুনে দেখলেনÑ৮ জন। ধমকের সুরে বললেন, ‘সবার না একসঙ্গে দঁাড়ানো নিষেধ, ভুলে গেছিস!’ সবাই হুড়মুড় করে একসঙ্গে বসে পড়ল। আমিনুল স্যার হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা, তোরাও কি দাদুকে জুতো কিনে দিয়ে এসেছিস?’ প্রশ্ন শেষ না হতেই ৮ জন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যঁা-য়্যঁা-য়্যঁা।’ আমিনুল স্যার চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘বলিস কী!’ তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘ওরে বাব্বা, দুদিনেই ১০ জোড়া জুতো...।’ ছাত্রছাত্রীদের ভেতরে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। আমিনুল স্যার মাথা নিচু করে সবুজ খাতাটায় লিখতে লিখতে ধমক দিলেন, ‘চিকিরপিকির বন্ধ হোক।’

সবাই হো-হো করে হেসে উঠল, তবে মুখে হাত দিয়ে নিয়েছেÑরিনু দঁাড়িয়েছে। সবার চোখ ওর দিকে। আমিনুল স্যারও মাথা তুললেন, সরু দৃষ্টিতে রিনুর দিকে তাকালেন, ‘কি রে, তুইও মনে হয় ভালো কাজ করে এসেছিস?’ রিনু খুব গবের্র সঙ্গে বলল, ‘জি স্যার।’

‘কয়টা করলি?’

‘১০টা।’

আমিনুল স্যার খাতা বন্ধ করে কোলের ওপর ধরে রাখলেন, ‘গুড! বল দেখি একটা একটা করে।’ বিনু বলতে শুরু করল, ‘আমি প্রথমে বৃদ্ধ এক দাদুর পা থেকে কঁাটা খুলে দিয়েছি?’

‘তারপর।’

‘তারপর আরেকজন বৃদ্ধ দাদুর পা থেকে কঁাটা খুলে দিয়েছি।’

‘তারপর।’

‘তারপর আবারও আরেকজন বৃদ্ধ দাদুর পা থেকে কঁাটা খুলে দিয়েছি।’

‘কয়জনের পায়ে কঁাটা ফুটেছিল রে!’

‘রোজ দুই-তিনজনের পায়ে।’

‘এত কঁাটা কোথায় পেলি!’

সবাই একযোগে হি-হি করে হেসে উঠল, তবে মুখের ওপরে হাত রেখে।

আমিনুল স্যার চোখ সরু করে রিনুকে হুঁশিয়ার করে দিলেন, ‘খুব হয়েছে, তোকে আর ভালো কাজ করতে হবে না।’ রিনু একবার অবিন্তার দিকে তাকালো, একবার ফারাজের দিকে। তারপর মন খারাপ করে ঢোক গিলে বলল, ‘তাহলে তো আমি লাড্ডুগুড্ডু হব, স্যার।’ আমিনুল স্যার আশ^স্ত করলেন, ‘না, তা হবি না, এখন থেকে তুই কিছু না করলেই, ভালো করবিÑ২০ করে দেব।’

বাতাস উঠল। আমিনুল স্যারের কপালের চুলগুলো আবার উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ‘যা, তোদের ছুটি,’ সবুজ খাতাটা ঝোলায় ভরে নিয়ে আমিনুল স্যার উঠে গেলেন। পেছনে ছাত্রছাত্রীরা হট্টগোল শুরু করেছেÑচার, পঁাচ, সাত, চার, তিন...। আমিনুল স্যার একবার পেছনে তাকালেন, দূর থেকে দেখলেনÑকে কয়টা বটের পাতা পেয়েছে, তা-ই গুনে গুনে একজন আরেকজনকে দেখাচ্ছে, ওদের গায়ে শুকনো বটের পাতা ঘুরে ঘুরে এসে পড়ছে, রিনু ব্যাগ কঁাধে হেঁটে হেঁটে বাড়ির পথ ধরছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<10663 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1