বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাল সবুজের ফেরিওয়ালা

সঞ্জয় কর
  ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মুখে খেঁাচা-খেঁাচা দাড়ি, সুঠাম দেহ, গায়ে হাফ শাটর্, ফুল প্যান্ট পায়ের পাতা থেকে একটু উপরে তোলা। কোমরে গামছা বঁাধা। মানুষটিকে সোনালির খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বেশ কয়েক বার তাকে দেখা হয়েছে। কিন্তু কোথায়? চিন্তায় পড়ে যায় সোনালি। লোকটার পায়ের দিকে চোখ পড়তেই সব মনে পড়ে যায় তার। বাম পায়ের দুটি আঙুল নেই, হঁাটুর নিচে দীঘর্ দিন আগের আঘাতের ক্ষত চিহ্ন। লোকটিকে এ পযর্ন্ত তিন বার দেখেছে সে তাদের রাসনগর গ্রামে। তিনি একজন ফেরিওয়ালা। গত বছর মাচর্ ও ডিসেম্বরে আর এ বছর ফেব্রæয়ারিতেও সেই আগের মতো হাতে পঁাচ থেকে ছয় হাত লম্বা এক টুকরো চিকন বঁাশ। বঁাশের মধ্যে ছোট-বড় অসংখ্য জাতীয় পতাকা বঁাধা। কঁাধে ঝুলন্ত ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের ছবি, লাল-সবুজের ক্যাপ, মাথায় বঁাধার ফিতা, জাতীয় পতাকার স্টিকার, জাতির জনকের ছবি...

রাসনগর ছাতক শহর থেকে বেশ দূরের একটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রাম। চতুদিের্ক ছোট-বড় অসংখ্য টিলা, টিলার ওপর ঘর-বাড়ি। টিলার পাশ দিয়ে অঁাকাবঁাকা মেঠো পথ। সবুজে সবুজে আচ্ছাদিত এই গ্রামটি যেন পাখিদের অভয়ারণ্য। গ্রামের আশপাশে হাট-বাজার নেই, নেই কোলাহল, গাড়ির হনর্ যানবাহনের কালো ধেঁায়াও নেই। গ্রামের অধিকাংশ লোকই দরিদ্র। পেট ভরে খেতে না পেলেও প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে তারা। সোনালিও একটি গরিব পরিবারের মেয়ে। বাবা বগার্চাষি। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তবে সোনালিকে বাবা ছাফ ছাফ বলে দিয়েছেন, ‘মা তোমাকে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে। এতে গাফিলতি করলে চলবে না। তোমার নিজের ভাগ্য নিজেই বদলাতে হবে। লেখাপড়া করে সরকারি অফিসার হতে হবে। যত কষ্টই হোক তোমার লেখাপড়ার খরচ আমি দেব।’

সোনালিরও এ অবহেলিত, অভাব-অনটনের জীবন আর ভালো লাগে না। সেও শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে চায়। বাবার বুনে দেয়া স্বপ্নের বীজ বুকে লালন করে সোনালি। শহুরে বালিকাদের মতো দামি দামি স্কুল ব্যাগ নিয়ে, প্রতিদিন নতুন জামা পরে স্কুলে যেতে পারে না সে। তাতে তার কোনো দুঃখ নেই। একটাই স্বপ্ন লেখাপড়া করে বড় অফিসার হতে হবে। সোনালি রাসনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। তার কোনো প্রাইভেট টিচার নেই। বিদ্যালয়ে পাঠদান চলাকালে সে খুব মনযোগী। সে নিয়মিত শিক্ষকদের দেয়া হোম ওয়াকর্ও করে। সে মনে করে সবার আগে পড়াশোনা তারপর অন্য কিছু। টিফিন টাইমে অন্য ছাত্রছাত্রীরা টিফিন খায়, খেলাধুলা করে কিন্তু সোনালি শ্রেণিকক্ষে বসে পড়ে।

এতক্ষণে ফেরিওয়ালাকে ঘিরে ফেলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। যে গ্রামে কোনো দিন অন্য কোনো ফেরিওয়ালা, বাদামওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা কেউ আসে না সেখানে লাল-সবুজের ফেরিওয়ালাকে দেখে সোনালিসহ সবাই বিস্মিত হয়। যেন আকাশের চঁাদ হাতে পায় তারা। নিজের ইচ্ছামতো কেনাকাটা করার সুযোগ পেয়ে সবাই আনন্দিত। কেউ কিনছে পতাকা, কেউ স্টিকার কেউ মুক্তিযুদ্ধের ছবি, কেউ শেখ মুজিবের ছবি...

সোনালি মনে মনে ভাবে এবং এক পা-দুই পা করে ফেরিওয়ালার দিকে আগায়। তার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। সে তো কিছুই কিনতে পারবে না। মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায় তার। ফেরিওয়ালার পিছনে গিয়ে দঁাড়িয়ে থাকে সে।

এক সময় সবাই চলে যায়। ফেরিওয়ালার মাত্র দু-একটা পতাকা ছাড়া সবই বিক্রি হয়ে গেছে। টাকা-পয়সা সামলে নিয়ে সে ঘুরে দঁাড়ায়। সোনালিকে দেখে মায়াবী কণ্ঠে বলে মা-মণি কিছু লাগবে?

- আমার কাছে টাকা নেই।

- কী নিতে চাও মা-মণি?

- একটি পতাকা। টাকা ছাড়া দিবেন?

- অবশ্যই দেবো।

ফেরিওয়ালা একটি পতাকা তুলে দেয় সোনালির হাতে। খুব খুশি হয় সোনালি। তার মুখে হাসি ফোটে। সোনালি ছোটবেলা থেকেই ভীষণ কৌত‚হলী। হাজারো প্রশ্ন কিলবিল করে তার মাথায়। সে আমতা আমতা করে বলে, এই গ্রামে তো অন্য কোনো ফেরিওয়ালা আসে না কিন্তু আপনি...

কথা শেষ করার আগেই ফেরিওয়ালা বলে, যেখানে কেউ যায় না সেখানেই আমি যাই। পতাকা বিক্রি করি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শোনাই। ইতিহাসের বই বিক্রি করি।

- কেন?

- এটা আমার শখ।

- আপনার পায়ের আঙুল নেই কেন?

- মুক্তিযুদ্ধের সময় আঘাত পেয়েছি।

- আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা?

- হ্যঁা।

- আপনি সবসময় আসেন না কেন?

- আমি বিশেষ বিশেষ সময়ে আসি।

- তাই নাকি?

- তুমি একটি গল্প শুনবে?

- গল্প শুনতে আমি খুব পছন্দ করি।

- বলতো এ মাসের নাম কী?

- ফেব্রæয়ারি।

ফেরিওয়ালা বলে, ‘ফেব্রæয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাস। ১৯৫২ সালের এ মাসে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। বিশ্বের আর কোনো জাতি ভাষার জন্য সংগ্রাম করেনি। বিশ্ব নেতারা একুশে ফেব্রæয়ারিকে আন্তজাির্তক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আজ তোমাকে ভাষা আন্দোলনের গল্প শোনাব। চলো সামনের গাছটির নিচে বসি।’

গল্প শুনতে শুনতে অনেক সময় চলে যায়। সোনালি আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে বিদ্যালয়ের সময় হয়ে গেছে। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে বিদায় নেয় সে। বই ভতির্ পলিথিনের ব্যাগটি পিঠে ঝুলিয়ে দুই হাতে পতাকাটি মাথার ওপর তুলে ধরে বিদ্যালয়ের দিকে দৌড় দেয় সোনালি। পতপত করে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লাল সবুজের ফেরিওয়ালা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22335 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1