শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঋতুর নবান্ন উৎসব

গল্প
শামীম শিকদার
  ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

ঋতু নাক ডেকে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে, তবু ঘুম থেকে ওঠার কোনো নাম নেই। এ অভ্যাসটি তার বেশ পুরনো। তবে শীতকাল এলে যেন তা আরও বেশি স্থায়ী হয়ে যায়। এখন অগ্রহায়ণ মাস, হেমনন্তের শেষ; শীত ছুঁই ছুঁই বলে। এ সময় বাড়িতে অনেক কাজ থাকে। নতুন আমন ধান গোলায় ওঠানোর জন্য চলে ব্যাপক প্রস্তুতি। ধান কাটা, ধান মাড়াই, ধান সিদ্ধ, ধান শুকিয়ে গোলায় তোলার প্রস্তুতি গ্রামের সবার মতো কোনো অংশ কম নয় ঋতুর পরিবারের। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নতুন ধান সিদ্ধের কাজে লেগে যায় ঋতুর মা। ভোরে ফজরের আজান দেয়ার সময় দু-এক মণ সিদ্ধ করা হয়ে যায়। ধান সিদ্ধ শেষে শুকাতে দেয়ার সময় ঋতুকে তার মা ঘুম থেকে উঠে কাজে সহযোগিতা করার জন্য বলে। মায়ের মুখে কাজের কথা শুনে হালকা শিশিরস্নাত শীতে কম্বলের ভিতরে গরম উষ্ণতায় বাইরের ঠাÐা কনকনে বাতাসে যাওয়ার আগ্রহ মোটেও হয় না। তাই ঋতু মায়ের কথায় তেমন ভাবে সাড়া না দিয়ে আরও শক্ত করে কম্বলটি জড়িয়ে ধরে মাথা কম্বলের ভিতরে নিয়ে শুয়ে আছে। চোখে কোনো ঘুম নেই, তবু কেন জানি কম্বলের গরম উষ্ণতা ছেড়ে একেবারে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার। বাইরে থেকে বারবার ঋতুর মায়ের মুখ থেকে ঋতু ডাকের শব্দ বের হয়ে আসছে। সেও জানে মায়ের কথাকে অবজ্ঞা করে কোনো উপায় নেই। একটু পর হয়তো তার বাবার কাছে অহেতুক নালিশ চলে যাবে। বাধ্য মেয়েরমতো শোয়া থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করা শুরু করল।

ঋতু বরুন উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে বলে স্কুলের উদ্দেশ্যে একটু আগে বের হতে হয় তাকে। পথে তার নিত্যসঙ্গী হয় পাশের বাড়ির ইভনাত। দুজন এক সঙ্গে নিয়মিত স্কুলে যায়। সবার বাড়িতে কাজের বেশ ধুম বলে স্কুলে শিক্ষাথীর্র সংখ্যাও অনেকটা কমে গেছে। তবে অন্যদের থেকে আলাদা ঋতুর মা। মেয়ের পড়ালেখার ব্যাপারে বরাবরই সচেতন। মেয়েকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন। নিম্ন আয়ের মানুষ হওয়া সত্তে¡ও অন্যান্য উচ্চ পরিবারের মতো করেই বড় করতে চান নিজের আদরের মেয়েকে। শুধু পড়ালেখার পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই প্রকৃত জ্ঞান পাওয়া যায় না এটাও বিশ্বাস করেন ঋতুর মা। মেয়েকে আলোকিত মানুষ রূপে গড়ার উদ্দেশ্যে নিজের সঙ্গে সব কাজে দক্ষ করার লক্ষ্যে নিজের যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখেন।

নতুন ধান ঘরে তোলা শেষে কয়েকদিন বাদে ঋতুদের গ্রামে শুরু হবে নবান্ন উৎসব। সে উৎসবকে ঘিরে গ্রামের সবার মতো ঋতুর মায়ের অনেক পরিকল্পনা। ঋতুর পরিকল্পনাও কোনো অংশে কম নয়। ঋতুদের অধিকাংশ ধান ক্ষেতের ধানই কাটা প্রায় শেষ। নতুন ধান দেখতে সে তার বাবার সঙ্গে ধান খেতে যায়। নতুন সোনালি ধান দেখে মন জুড়িয়ে যায়। সুগন্ধি ধানের ম-ম গন্ধ নাকের কাছে এসে জানান দেয় ধান কাটার সময় হয়ে গেছে। সকালবেলা ক্ষেতের আইল দিয়ে হঁাটার সময় কুয়াশার স্নিগ্ধ শিশিরে পা ভিজে শরীর শির শির করে কেঁপে ওঠে। ধানের শিসগুলো যেন শিশিরে ভিজে আরও বেশি নবীন হয়ে সূযের্র আলো পড়ে চিক চিক করতে থাকে। পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরের বিন্দুগুলো ধানের পাতাকে ধুয়ে সবুজের বুকে সোনালিরূপে ফুটিয়ে তোলে। ক্ষেতের পাড়ে বসে বাবার ধান কাটা দেখে ঋতু। ধীরে ধীরে কঁাচি দিয়ে ধান কাটার দৃশ্য দেখে মনে হয় কৃষকের মনে আনন্দের জোয়ারের সূচনা হচ্ছে। ধান মাড়াইয়ের জন্য খালি মাঠের ঘাস পরিষ্কার করে প্রস্তুত করা হয়। নিজেরসহ পাশের কৃষকের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয় গরু। চার-পঁাচ গরু পাশাপাশি এক সঙ্গে বেঁধে তাদের নিচে দেয়া হয় অল্প ধানসহ ধানের শিস। ঘাস পরিষ্কার করা জমির মাঝখানে গতর্ করে বঁাশ স্থাপন করা হয় এবং তাতে গরু বাধা হয়। পিছন থেকে একজন লাঠি নিয়ে গরুদের তাড়া করে এবং গরুগুলো ধানের শিসের ছড়ার ওপর দিয়ে হঁাটতে থাকে। একই জায়গার ওপর দিয়ে গরু বারবার হঁাটার ফলে গরুর পায়ের পাড়ায় ধানের শিস থেকে ধান ঝরে মাটিতে পড়ে। ঋতুর কাছে গরু তাড়ানোর ব্যাপারটি খুব মজার লাগে তাই সে খুব আগ্রহ নিয়ে গরু তাড়ায়। মাঝেমধ্যে মুখে শব্দ করে বলে, হু হুস...হু হুট...। তার মুখের শব্দ শুনে গরু আরও জোরে দৌড়াতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখতে পাড়ার অনেক ছেলেমেয়েরা মাড়াই দেয়ার সময় আসে। তারা দূরে দঁাড়িয়ে গরু তাড়ানোর জন্য অনেকেই শব্দ করে। মাড়াই করা শেষে ধানের শিস সরিয়ে তা থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়। ধান সংগ্রহ করে তা চুলায় দিয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকাতে দেয়া হয়। নবীন সিদ্ধ ধান থেকে কুয়াশার মতো ধেঁায়া উঠতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে ঋতুর ছোট ভাই হা করে মুখ থেকে ধেঁায়া বের করে বলে, দেখ আপু আমার মুখ থেকেও ধেঁায়া বের হয়।

ধান পুরোপুরি শুকানোর পর তা মেশিনে ভাঙিয়ে চাল করে ঢেঁকি দিয়ে চাল গুঁড়া করে পিঠা তৈরির জন্য প্রস্তুত করা হয়। একেক দিন একেক রকম পিঠা তৈরির জন্য বায়না ধরে ঋতু। তার পিঠার তালিকায় ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, দোল পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পুলি পিঠা, পানতোয়া পিঠা, দুধরাজ পিঠাসহ কোনো পিঠাই বাদ যায় না। ধানের পিঠা, মুড়ি, চিড়া, খইসহ নানা খাবারের ঘ্রাণে ভরপুর ও আনন্দ উৎসবে ভরে যায় গ্রামীণ জনপদ। ঋতুর মনে নতুন চালের পিঠার ঘ্রাণে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। ঋতুর বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে পিঠার ম-ম গন্ধে নতুন ধানের বাতার্ পেঁৗছে দেয়। নতুন ধানের অন্নে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। ওই সময় ঋতুদের বাড়িতে তার ফুফুরা বেড়াতে আসে। নানান রকমের পিঠা আর নতুন নতুন খাবারে উপযাপন করা হয় নবান্ন উৎসবের। অগ্রহায়ণের শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত ঋতুদের গ্রামে চলে নবান্ন উৎসবের ব্যতিক্রম আয়োজন। পিঠা যেন নবান্ন উৎসবের প্রাণ হয়ে ঋতুর হৃদয়ে বারবার মুগ্ধতা খুঁজে বিস্তার করে। তার মনে ইচ্ছা জাগে, বছরের প্রতিটি দিন যদি নবীন ধান ঘরে তোলা যেত তবে হয়তো নবান্ন উৎসবকে ঘিরে আয়োজন করা হতো নতুন নতুন বাহারি পিঠার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<28879 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1