শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

পরিযায়ী পাখির ডানায়

প্রিন্স আশরাফ
  ০৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

প্রতিদিন সকাল হলেই মাথার কাছে পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙে নেহার। পাখিই যেন তার ঘুমভাঙার এলামর্। ঢাকা শহরে পাখির এই কিচিরমিচির একটু অদ্ভুত হলেও নেহার দাদিই শুরু করে দিয়ে গেছে। এখন দাদি নেই। গ্রামের বাড়িতে গেছে। কিন্তু পাখিরা দাদিকে ভোলেনি। ঠিকই দাদিকে খঁুজতে আসে। আসে খাবারের খেঁাজেও। বাড়ির সবাই এখন ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট খাবার না ফেলে পাখিগুলোর জন্য রেখে দেয়। আর বলে দাদির পাখি। দাদি অবশ্য পাখির খাবারগুলো খুব সুন্দর করে চটকে মেখে দিত। ওরা এমনি এমনি দেয়। পাখিরা খায়। ডেকে বকে কিচিরমিচির করে কৃতজ্ঞতা জানায়।

বাষির্ক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় নেহারের স্কুল এখন শীতের ছুটি। শীতের সকালে বিছানায় লেপের ওমে জড়িয়ে ঘুম দেবেÑ তা না পাখির ডাকে ঘুম ভাঙবেই। আজ যেন পাখিদের কিচিরমিচির একটু বেশিই। নেহা ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বারান্দার দরজাটা খুলে দিল। পাখিদের খাবার গ্রিলের বারান্দার ভেতরেই দেয়া হয়। ওপাশে একটা ঝাকড়া আম গাছ আছে। পাখিরা ওখানে বসে ডাকে। খাবার পেলে বারান্দায় এসে খায়।

নেহা দেখতে পেল বারান্দার এককোণে পাখিদের জটলা। কিছু একটা নিয়ে শোরগোল তুলেছে ছোট্ট পাখিগুলো। নেহাকে দেখেই জটলা ভেঙে পাখিরা উড়ে গিয়ে আমগাছে বসল। কিন্তু জটলার মধ্যমণি হয়ে থাকা একটা পাখি নেহাকে দেখেও নড়াচড়া করল না। জবুথবু হয়ে বসে রইল। নেহা পা পা হেঁটে এগিয়ে গেল। ঠাÐা মেঝেতে ঘরের স্যান্ডেল পরা নিয়ম। কিন্তু এখন কেউ দেখছে না। নেহা ভেবেছিল পাখিটা তাকে আসতে দেখে ফুস করে উড়ে যাবে। কিন্তু একভাবেই ডানার মধ্যে ঘাড় গুঁজে বসে রইল।

‘বারান্দার দরজা খুলেছ কেন? হু হু করে ঠাÐা বাতাস আসছে। বন্ধ কর।’ বিছানা থেকে নেহার মায়ের গলা ভেসে এলো।

নেহা দরজাটা একটু টেনে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘মা, দেখে যাও একটা পাখি। চুপ করে বারান্দায় বসে আছে। নড়াচড়া করছে না। মনে হয় হাত দিয়ে ধরা যাবে।’

মা বিছানা থেকেই গলা চড়াল। ‘ধরো না। ধরো না। হাতে ঠোক্কর দেবে। অসুস্থ পাখিও হতে পারে।’

‘তুমি একটু এসে দেখে যাও না মা। পাখিটা দেখতে খুব সুন্দর।’ মা উঠে জুতা পায়ে না দেখলে বকবে। নেহা তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর থেকে জুতো পরে নিল। তারপর মায়ের বিছানার কাছে এসে কম্বল তুলে দিয়ে বলল, ‘আস না মা। পাখিটাকে একটু দেখ। ও উড়তে পারছে না।’

অনিচ্ছাসত্তে¡ও বিছানা ছাড়ে মা। না হলে কানের পোকা নাড়িয়ে দেবে। চাদর জড়িয়ে মা বারান্দায় এলো। সত্যি সত্যিই একটা বেশ বড়ো সড়ো প্রায় কাকের সাইজের অদ্ভুত একটা পাখি জড়োসড়ো হয়ে পালকের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে চুপটি করে বসে আছে। কাছে এগিয়ে গেল মা। হাত বাড়াতে গিয়েও সামলে নিল। অপরিচিত পাখি। ঠোকর-টোকর দেবে নাকি? ‘নেহা, তোমার স্কুল ব্যাগ থেকে একটা স্কেল আনো তো?’

নেহা বসে ছিল মায়ের পাশে। স্কেল কেন আনতে হবে বুঝতে পারল। দৌড়ে চলে গেল ঘরে। স্কেল নিয়ে এসে মায়ের হাতে দিল। মা স্কেল দিয়ে পাখির গায়ে মৃদু একটা খেঁাচা দিল। খেঁাচা খেয়ে পাখিটা পালকের ভেতর থেকে মুখ বের করল। আর তখনই মায়ের মনে হলো অপরিচিত এই পাখিটা একটু অসুস্থ। আর সে জন্যই উড়তে পারছে না। মা উঠে গিয়ে একটু দুধ আনতে গিয়েও থমকে গেল। বিড়ালে দুধ খায়। কিন্তু পাখিতে খাবে কিভাবে? পাখি কি খায়?

মা পাখিটাকে দুহাতে আলতো করে ধরে বাইরের ঠাÐা থেকে ঘরে নিয়ে এলো। ঘরের উঞ্চতায় পাখিটির মধ্যে যেন একটু সাড়া ফিরে এলো। একটু নড়ে চড়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল। একটু চাল এনে মেঝেতে ছড়িয়ে দিল মা। পাখিটা ঠোট দিয়ে কয়েকবার নাড়াচাড়া করল। তারপর খুঁটে খঁুটে খেতে লাগল।

মা নেহাকে বলল, ‘পাখিটাকে কেমন অপরিচিত পাখি মনে হচ্ছে। যতটুকু মনে হচ্ছে এটা আমাদের দেশি পাখি নয়। মাইগ্রেটরি বাডর্। পরিযায়ী পাখি।’

‘পরিযায়ী পাখি কি মা?’

‘প্রতিবছর শীতকাল এলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি মাতৃভূমি ছেড়ে দল বেঁধে উড়ে যায় নাতিশীতোষ্ণ দেশে। এদের পরিযায়ী পাখি বলে।’ বলতে বলতে মা স্মাটর্ ফোন বের করে ক্যামেরা দিয়ে পাখিটার পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। পাখিটাও বুঝতে পেরে কিনা কে জানে; বেশ ঘাড় উঁচিয়ে পোজ দিল।

‘মা, ওর ছবি তুলে কি করবে?’

‘দেখি, ইন্টারনেটে মিলিয়ে দেখব, এটাকে কি পাখি বলে? কোন দেশের পাখি?” বলে মা আর দেরি করল না। ইন্টারনেটে সাচর্ দিতেই পাওয়া গেল। ‘দেখ নেহা, আমি যা বলেছিলাম, তাই। এটা বিদেশি পাখি। ওদের দেশে শীত বলে ওরা হাজার হাজার কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। এই দেখ এখানে কি লিখেছে। আমি পড়ে শোনাই। এক জাতীয় চিল আছে যাদের কুরিংগাচিল বলে এরা উত্তর মেরু থেকে আমাদের এদিকে উড়ে এসে ৩৫০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আবার ফিরে যায়। তুলোফুড়কি পাখি শীতকালে ৩২০০ কি.মি. পথ পাড়ি দেয়। পরিযায়ী পাখিরা একটানা দেড় দুইদিন পযর্ন্ত ওড়ে। ঘণ্টায় ত্রিশ থেকে আশি কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে ওরা। অনেক ছোটপাখি নিশাচর না হলেও রাতে উড়ে শিকারির হাত থেকে বঁাচার জন্য।’

‘মা, এতদিন ধরে যে উড়ে ওরা কি খায়?’

‘লম্বা জানির্ দেয়ার আগে আগে ওরা বেশ খেয়ে-দেয়ে মোটা হয়ে নেয়। তারপর উড়ার সময় শরীরে জমানো ফ্যাট কাজে লাগায়।’

‘ওরা পথ চিনে যাতায়াত করে কিভাবে মা?’

‘দিনে সূযর্ আর রাতে নক্ষত্র ওদের পথ চেনায়। সে কারণেই কুয়াশায় মাঝে মাঝে পথ ভুল করে ওরা।’ মা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্যগুলো মেয়েকে জানায়। তখনই বারান্দায় থেকে বেড়ালের মিউ মিউ গরর গরর ডাক ভেসে আসে। বাড়িওয়ালার পোষা হুলো বেড়াল। চুরি করে খেতে ওস্তাদ।

‘জানো নেহা, আগে এসব পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে নানান গল্প ছিল। শীতকালের পাখিদের পরে আর না দেখতে পেয়ে মানুষ ভাবত এরা বোধ হয় মাটির তলায় ঘুমাতে যায়।’ মা ফোনে তন্ময়। নেহা খেয়াল করল বেড়াল ঘরে ঢুকেই পাখি দেখে থমকে দঁাড়াল। নেহা বিড়ালের দিকে তেড়ে যেতে যেতে বলল, ‘মা, দেখেছে দুষ্টু বিড়ালটা পাখিটাকে কেমনভাবে দেখছিল।’

মা ফোন থেকে মুখ তুলে বলল, ‘তাহলে তো চিন্তার বিষয়। পাখিটা উড়তে পারছে না। ও তো বিড়ালের খাদ্য হবে কি করা যায়!’

‘মা তুমিই তো বললে ওরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শীতের দেশ থেকে এদিকে আসে। তাহলে ও তো উড়েই এসেছে। নিশ্চয় উড়তে পারে। হয়তো পথ ভুলে গেছে বলে উড়ছে না।’

‘তুই ঠিকই বলেছিস-রে মা। তাহলে এখন কি করা যায়? আমার মনে হয় পাখিটাকে ওর পরিচিত স্বজনদের সঙ্গে দিয়ে আসতে পারলে হয়তো ও আবার উড়তো। পথ ভুলে বোকা বনে গেছে।’

‘যে এতদূর থেকে আসতে পেরেছে সে পথ ভুলে যাবে কেন?’

মা হাত থেকে মোবাইল ফোনটা তুলে মেয়েকে দেখালেন। ‘মোবাইলের রেডিয়েশনে ওরা দিক ভুলে যায়-রে মা!’ হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘ইউরেকা! ইউরেকা! জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়! ওখানেই পরিযায়ী পাখিরা আসে। এই পাখিটার সঙ্গীসাথীরা ওখানে থাকতে পারে। চল, আজ ওখানে পাখি দেখে আসি। আর আমার অফিসের একটা অ্যাসাইনমেন্টও ওটা নিয়েই হতে পারে!’ মাকে বেশ উজ্জীবিত দেখাল।

মা পাখিটাকে বুকের কাছে চাদরের ওমের মধ্যে তুলে নিল। নেহার মনে হলো পাখিটা ওর মাকে ফিরে পেয়েছে। আর মাকে যেন পাখির মায়ের মতোই লাগছে!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31189 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1