শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
গ ল্প

বর্ষা ময়েে

সারমিন ইসলাম রতœা
  ১৮ জুলাই ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ জুলাই ২০১৮, ১৮:০৪

শব্দ করে বৃষ্টি পড়ছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আনমনে বৃষ্টি দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করে কোথা থেকে একটি ব্যাঙ এসে বলল, এত সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে আর তুমি বন্দি ঘরে কীভাবে আছ? আমি বললাম, আমার তো খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই, তোমার মতো বৃষ্টিতে ভিজব। ব্যাঙটি ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডেকে বলে উঠল, চলনা বৃষ্টিতে ভিজি, খুব মজা লাগবে। আমি ব্যাঙটিকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ এদিকে-ওদিকে লাফালাফি করে ব্যাঙটি আবার এলো। ঘ্যাং ঘ্যাং করে বলতে লাগল, চল না বৃষ্টিতে ভিজি, খুব মজা হবে দেখো। আমি ব্যাঙটির অনুরোধ না রেখে আর পারলাম না। এক দৌড়ে বাইরে চলে এলাম। আর বৃষ্টিও এক ঝটকায় ভিজিয়ে দিল আমাকে। সত্যিই তো বৃষ্টিতে ভিজতে দারুণ মজা। তারপর আমি ও ব্যাঙ মিলে পুরো বাগানজুড়ে লাফালাফি করে ভিজতে লাগলাম। চিৎকার দিয়ে বললাম, ও ব্যাঙ বন্ধু তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তুমি যদি আমাকে না বলতে আমি কখনই বৃষ্টিতে ভিজতাম না। জানো, বৃষ্টিতে ভিজতে সবাই আমাকে নিষেধ করে অথচ বৃষ্টিতে ভিজতে কত মজা কত আনন্দ! ব্যাঙটি খুব খুশি হলো, সে ভীষণ জোরে একটা লাফ দিল। এবং তার ঘ্যাঙর ঘ্যাং কণ্ঠটি যতটুকু সম্ভব মিষ্টি করে গান গাইতে শুরু করলÑ জল থই থই মেঘ থই থই ধিন তা নানা ধিন আজ বৃষ্টির দিন। আমিও সেই গানের তালে তালে গাইতে শুরু করলামÑ গাছভতির্ কদম ফুল খুকুর কানে সোনার দুল খুকুমণি গঁাথবে মালা কাটবে সুখে বৃষ্টি বেলা। হঠাৎ আম্মু এসে হাজির। আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে তিনি এক রকম চিৎকার করে বললেন, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন? আমি বললাম, ভিজছি আর কি, আমার ব্যাঙ বন্ধু বৃষ্টিতে ভিজতে বলল তাই ভিজছি। তুমি ব্যাঙের কথা শুনে বাইরে চলে গেলে? আম্মু রেগে গিয়ে বললেন, এক্ষুনি ভিতরে এসো বলছি। আমি দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে এলাম। ব্যাঙটির দিকে ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগই পেলাম না। বৃষ্টি এখনো থামেনি। আমি ব্যাঙটির ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর গান শুনতে পাচ্ছি। আমার খুব মায়া হলো। আহারে ব্যাঙটি একা একা ভিজছে, ওর কোনো সঙ্গি নেই। রাতের বেলা খুব জ্বর এলো আমার। কঁাপুনি দিয়ে জ্বর যেটাকে বলে। আম্মু আমাকে ভীষণ বকে দিলেন। আম্মুর বকা খেয়ে জ্বর আরও বাড়তে লাগল। আব্বু আর ভাইয়া দৌড়াদৌড়ি করে তাড়াতাড়ি ডাক্তার নিয়ে এলেন। ডাক্তার আমাকে দেখে চিন্তিত হয়ে কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। আমি সেই ওষুধগুলো নিয়মিত খেতে শুরু করলাম। জ্বর কমছিল, আবার বারছিল, এ অবস্থায় কেটে গেল কয়েকদিন। ব্যাঙটির ওপর খুব রাগ হলো। কি দরকার ছিল আমাকে অমন অনুরোধ করার। সে তো খুব ভালো করেই জানে আমার বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যেস নেই। আমি ইট পাথরের চার দেয়ালে বন্দি একটি ছোট্ট মেয়ে। তাই প্রকৃতির মায়া-মমতা সহ্য হয় না। সামনে পরীক্ষা, স্কুলে যেতে পারছি নাÑ জ্বরের জন্য। বাসায়ও পড়তে পারছি না। এখন কি করব সারাদিন বসে বসে শুধু সেটাই ভাবি। যাহ! এতক্ষণ আমার নামটাই তো বলা হলো না। আমি বষার্। আব্বু আমাকে আদর করে ডাকেন বষাের্ময়ে। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। সামনে পিছনে বাগানে ঘেরা এক আলিশান বাসায় আমাদের বসবাস, আব্বু, আম্মু, ভাইয়া আর আমি। পাশের বাসার অরনীর সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা। আম্মু বলেছেন আমাকে ওর থেকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। আর এদিকে আমি কিনা জ্বর বঁাধিয়ে বসে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। জ্বরে কঁাপতে কঁাপতে জানালার পাশে এসে দঁাড়ালাম। অমনি কোথা থেকে আবারও সেই ব্যাঙ এসে হাজির। জিভ বের করে হাসতে হাসতে বলল, বষাের্ময়ে তুমি দেখি জ্বরে একেবারে কাবু হয়ে গেছ। ভীষণ রাগ হলো আমার বললাম, তোমার জন্যই তো আজকে আমার এই অবস্থা। তুমি আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে বললে কেন? ব্যাঙ বলল, এত রাগ হলে হয়, দেখো না আমি সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজি, কই আমার তো কিছুই হয় না। তোমার হবে কোথা থেকে, তুমি তো একটা ব্যাঙ, ব্যাঙের কি জ্বর হয়, সদির্ হয়? ব্যাঙ ঘ্যাং ঘ্যাং করে একটা হাসি দিয়ে বলল, সব হয়, কিন্তু আমরা এত সহজে কাবু হই না। দোয়া করি তুমি সুস্থ হও। আচ্ছা বষাের্ময়ে আজ তবে যাই। ভালো থেকো। আমি কান্নামাখা চোখে ব্যাঙ বন্ধুটির চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম। মাত্র কয়েকটি লাফেই হারিয়ে গেল ঝোপের পাশে। আজ শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে বাসায় এলাম। জ্বরের কারণে খুব একটা ভালো পরীক্ষা দিতে পারিনি। দেবো কেমন করে। ঠিকমতো পড়াশোনাই তো করতে পারিনি। সন্ধ্যেবেলা অরনীর আম্মু এলেন আমার আম্মুর সঙ্গে গল্প করতে। দুজনে মিলে সে কি গল্প। আমি পাশে বশে সব শুনছিলাম আর মিটিমিটি হাসছিলাম। অরনীর আম্মু বললেন, অরনী তো খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে। মনে হচ্ছে এবারও সবার থেকে ফাস্টর্ হবে। ওর রোল এবার এক হবে। আম্মু গবের্র একটা হাসি দিয়ে বললেন, আমার মেয়েও খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে। ওর জ্বর হলে কি হবে, খুব মেধাবী মেয়ে আমার। আম্মু এবং অরনীর আম্মুর কথা শুনে আমি মনে মনে হাসতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম, সত্যিই কি আমি মেধাবী। কিন্তু আমার একটুও মেধাবী হতে ইচ্ছে করছে না। বোকা হতে ইচ্ছে করছে, ভীষণ বোকা। আসলেই আমি একটা বোকা, হিঃ হিঃ। পরীক্ষার ফল বের হলো। আমি সেই পরীক্ষায় বড় বড় আলু পেয়েছি। এখন সে আলু ভেজে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বানিয়ে খাব খুব মজা করে খাব। আম্মুকে একটুও দেব না। ওদিকে আম্মু মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কঁাদতে শুরু করেছেন। আমি আম্মুকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য তার পাশে গিয়ে বসলাম, বললাম, আম্মু কান্না করো না, জানই তো আমার জ্বর ছিল, এই জ্বর নিয়ে কীভাবে যে পরীক্ষা দিয়েছি। আম্মু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরও বেশি কঁাদতে লাগলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, কপালে ছোট্ট একটা আদর দিলেন। দরজা খোলাই ছিল, অরনীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন অরনীর আম্মু। ঠেঁাটে ভুবন ভোলানো হাসি। আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, বলেছিলাম না আমার মেয়ে ফাস্টর্ হবে, ওর রোল নাম্বার এক হয়ে যাবে। দেখেছেন ভাবী, কি মেধাবী মেয়ে আমার। অরনী আমাকে সান্ত¡না দিয়ে হাতে হাত রেখে বলল, বন্ধু মন খারাপ করো না। আমি অরনীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললাম, আম্মুরা দুজনে মিলে গল্প করুক আর আমরা খেলা করার জন্য যেখানে খুশি চলে যাই। আমি অরনীকে নিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম। যতরকমের খেলনা ছিল সব নামিয়ে দুজনে মিলে খেলতে বসে গেলাম। খেলতে খেলতে অরনী বলল তুই কেমন করে এমন জ্বর বঁাধালি বল তো? আমি বললাম ইচ্ছা করে বঁাধিয়েছি। অরনী বিস্মিত হয়ে চোখ দুটো কপালে তুলে বলল, সে কি করে? আমি বললাম, বৃষ্টিতে ভিজে। অরনী সব বুঝতে পারার ভঙ্গি করে বলল, ও আচ্ছা তুই যে বলেছিলি তোর এক ব্যাঙ বন্ধু আছে তার সঙ্গেই বুঝি ভিজেছিলি। বষার্ মিটি মিটি হেসে বলল, হ্যঁা। অরনী রাগ করে খেলনাগুলো দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, তোর সঙ্গে কথা নেই, তুই এমন কেন করলি? কারণ আমি চাই না তোকে আর আমাকে নিয়ে আম্মুদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা হোক, তাই করেছি। অরনী হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর মাথায় এত বুদ্ধি কেন বল তো? বারে, সেদিন না আমাদের স্কুলে টিচার ঘোষণা করলেন, প্রত্যেককে একটি করে গল্প লিখে জমা দিতে হবে। গল্পের বিষয়বস্তু বুদ্ধির খেলা। ও তুই তাহলে এই কাÐ করেছিস, নিজের জীবন থেকে সত্যি ঘটনা লিখেছিস। এখনও লিখে শেষ করিনি, তবে মনে হয় আজ শেষ হয়ে যাবে। তুইও লিখে ফেল। আমি লিখে ফেলেছি গল্পের নাম ‘ব্যাঙের বুদ্ধি’।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে