শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাফাতের পড়ালেখা

রণজিৎ সরকার
  ০৬ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

রাফাতের জন্ম গ্রামে। বাবা-মার ওর সঙ্গে গ্রামে থাকার কথা ছিল। রাফাত যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে তখন বাবা রওশন আলী মারা যান। রওশন আলী গ্রামে অন্য বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতেন। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জন ব্যক্তি। রাফাতের বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবার আর্থিকভাবে কষ্টে পড়ল। তিন বেলা ভাত জোটে না। খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমভাবে দিন-রাত পার কারতে লাগল। রাফাতের ছোট একটা বোন আছে। বোনটার নাম মুনিয়া। ওর বয়সমাত্র দুই বছর। সন্তানদের কষ্ট দূর করার জন্য রাফাতের মা গ্রামে অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পান তা দিয়ে তিনজন তিনবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। তাই রাফাতও দিনমজুরের কাজ শুরু করল। কিন্তু রাফাত শিশু বলে কৃষিকাজ সব পারে না। সে জন্য বকা খেতে হয়।

রাফাত বাবার কথা মনে করে ভাবে, আমার বাবা কানে কম শুনতেন। বাজারে যাওয়ার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকের ধাক্কায় মারা যান। এত অল্প বয়সে পড়ালেখা বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরতে হবে। তা হলে আগেই বাবার কাছ থেকে কৃষিকাজ শিখে নিতাম। রাফাত কৃষিকাজের সব কাজ পারে না। তাই গ্রামের অনেকেই দিনমজুরের কাজে নিতে চায় না। রাফাত দিনমজুরের কাজ বাদ দিয়ে ফেরি করে বাদাম বিক্রি শুরু করল।

গ্রামের সিদ্দিক চাচা রাফাতের পরিবারের কষ্টের কথা বুঝতে পারেন। কয়েক দিন পর রাফাতের মাকে বলেন, রাফাতকে শহরে নিয়ে যাওয়ার কথা। রাফাতের মা বললেন, 'শহরে গিয়ে কি কাজ করব। গার্মেন্টের কাজ কি পারবে রাফাত?'

সিদ্দিক চাচা বললেন, 'গার্মেন্টে না। আমার পরিচিত এক ভাইয়ের মুদি দোকানে কাজ করবে। প্রথম কয়েক মাস শুধু থাকা-খাওয়া দেব। ছয় মাস গেলে মাসিক কিছু টাকা বেতন দেবে।'

রাফাতের মা আর কোনো কিছু না ভেবে ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে দিলেন। মনে মনে ভাবল, যাক তিন বেলা তো পেট ভরে খেয়ে থাকতে পারবে রাফাত।

রাফাতের মা যখন শহরে যাওযার কথা বললেন তখন সে গ্রামের বন্ধুদের ছেড়ে চলে যেতে চাইল না। মা তাকে অনেক বুঝিয়ে-শুঝিয়ে শেষ কথা বলছিলেন, বড় হতে হলে শহরে যেতে হয়।

অবশেষে, রাফাত শহরে এসে রতনের দোকানে কাজ শুরু করল। কিন্তু মন বসে না। মা আর ছোট বোনটার কথা খুব মনে পড়ে। রাফাতের সামনে মোবাইলে অনেকেই কথা বলে। তাই দেখে মা-বোনের সাথে রাফাতের কথা বলতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু তার মোবাইল নেই। মোবাইল নেই তার মায়ের কাছেও। রাফাত মনে মনে ভাবে- আমাকে একটা মোবাইল কিনতে হবে। বাড়িতে মাকে একটা মোবাইল কিনে দিতে হবে। তা হলেই মা আর বোনের সাথে কথা বলতে পারব। রতনের দোকানের নিয়মিত ক্রেতা রাশেদ সাহেব। রাশেদ দোকানে এসে একদিন দেখে রাফাত ভীষণ মন খারাপ। রাশেদ বুঝতে পারলেন। ভাবলেন, প্রতিটি মানুষের মন খারাপ হয় নিশ্চয় কোনো না কোনো কারণে। তাই রাশেদ ভেবে-চিন্তে জিজ্ঞেস করলেন, 'রাফাত, তোমার মন খারাপ কেন?'

রাশেদ বললেন, 'স্যার, মা আর ছোট বোনটার কথা মনে পড়ছে। খুব মনে পড়ছে। অনেক দিন হয়ে গেল কথা বলি না। তাদের সাথে কথা বলতে মন চায়।'

রাশেদ কথা শুনে বললেন, 'তোমার মায়ের মোবাইল নম্বর দাও। আমার মোবাইল দিয়ে কল করি, তুমি কথা বলো।'

'স্যার, মায়ের তো মোবাইল নেই।'

দোকানের বাইরে ছিল রতন। দোকানে ঢুকেই বললেন, 'রাফাত, বাসায় মাছটা দিয়ে আয়।'

রাফাত আর কোনো কথা না বলে। মাছের ব্যাগটা নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা হলো। দোকান থেকে বাসার দূরত্ব দশ মিনিটের পথ।

পেছনে পেছনে রাশেদ এগিয়ে বললেন, 'রাফাত, তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি অনেক ভালো ছেলে। কিন্তু তোমার গ্রামের বাড়িতে মোবাইল ফোন নেই। তোমার মায়ের মোবাইল নেই।'

'না।'

'তোমাকে যদি একটা মোবাইল কিনে দিই, তা হলে তো মায়ের সাথে কথা বলতে পারবে।'

রাফাত কোনো কিছু বলল না। আসলে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নেয়া ঠিক হবে না। মোবাইল ফোন নিলে আবার দোকানের মালিক রতন কিছু বলেন কিনা।

'কি হলো রাফাত কথা বলো। উত্তর দাও?'

'তা হলে তো কথা বলাই যেত। কিন্তু আপনি কেন আমাকে মোবাইল কিনে দেবেন।'

'আমি আসলে মানুষের কষ্টের চেহারা দেখতে পারি না। অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। মানুষের কষ্ট দেখলে আমার খারাপ লাগে। খুব খারাপ লাগে। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী কষ্ট দূর করার জন্য চেষ্টা করি সব সময়।'

'তা হলে তো আপনি খুব ভালো মানুষ। দাতা হাতেম তাই।'

'তুমি দাতা হাতেম তাইয়ের নাম জানো কি করে?'

'আমার বাবা একদিন গল্প শুনিয়েছিলেন তার। সেই দিন থেকে হাতেম তাইয়ের নাম জানি।'

'বাহ, বেশ।'

রাফাত মাছ নিয়ে বাসায় ঢুকে গেল। রাশেদ হঠাৎ কি যেন ভেবে সেদিন আর রাফাতের সাথে কথা না বলে বাসায় চলে এলো। তার পরদিন রাশেদ বুদ্ধি করে মুদি দোকানের মালিক রতনের কাছে গেলেন। তাকে বললেন, 'চাচা, আপনার সাথে একটা কথা ছিল।'

দোকানদার মালিক বললেন, 'কি কথা বলতে চান। বলেন।'

'আপনার দোকানের কর্মচারী রাফাতকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিতে চাই। আর ওর মার জন্য একটা মোবাইল কিনে গ্রামে পাঠাতে চাই। আপনি কি বলেন?'

'তাতে আবার কোনো আপত্তি নেই। কিনে দিতে পারেন। এখন তো মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। কিনে দেন।'

'ওদের মোবাইল পেলে অনেক উপকার হবে। আমি সে জন্য দিতে চেয়েছি। আর আপনার কাছ থেকে অনুমতি চাওয়ার অর্থ হলো, আপনি যেন রাফাতকে আবার চোর ভাবেন না। কারণ আপনি ভাবতে পারেন কয়েকদিন হলো দোকানে এসে। মোবাইল কিনেছে কীভাবে। কারণ নিশ্চয় দোকানের ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে মোবাইল কিনেছে। সে জন্য বিষয়টা আপনাকে জানালাম।'

'জানানোর জন্য ধন্যবাদ। তবে রাফাত টাকা চুরি করার মতো ছেলে না। ও বিশ্বস্ত ছেলে। এই কয়েকদিনে বুঝে গেছি।'

ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রেতা হিসেবে কাফি। ওদের দুই জনের কথা শুনে কাফি বললেন, 'আপনাদের কথা শুনলাম। কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে।'

রাশেদ বললেন, 'আচ্ছা, আপনি ছেলেটা ও তার মাকে মোবাইল কিনে দেবেন। ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কি আরও একটা ভালো কাজ করতে পারেন?'

'ভালো কাজ কি?'

'রাফাত ও তার বোনকে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দেন। ওরা নিয়মিত পড়ালেখা করবে। এর ফলে দুজনের জীবন নতুন করে ফিরে পাবে। একটু চেষ্টা করে দেখতে পারেন।'

কথাটা শুনে পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মতো রাফাত ও মুনিয়ার ভাগ্যের পূর্ণতা দেখতে পেল রাশেদ। তাই খুশিতে বললেন, 'খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বিষয়টা ভেবে দেখা উচিত।'

রাশেদ কয়েক দিন ভাবতে লাগল। এক সময় তার এক বন্ধু নিশাত বলেছিল। গরিব-দুখীর ছেলেমেয়ে টাকার অভাবে পড়ালেখা করতে পারে না। যদি এমন কেউ থাকে। তা হলে আমি যেন তাকে জানাই। রাশেদ তার বন্ধুকে কথাগুলো বলল। নিশাত রাজি হয়ে গেলেন।

কিছুদিন পর মুদি দোকান থেকে বের হয়ে গ্রামে গেল রাফাত। রাফাত আবার গ্রামের স্কুলে ভর্তি হলো। পড়ালেখা শুরু করল। নিশাত মাসিক টাকা পাঠায়। সেটা দিয়ে ওদের পড়ালেখা ও খাওয়ার খরচ চলতে থাকে...।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<39597 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1