শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাবা ও ইলিশ মাছ

রুহুল আমিন রাকিব
  ১৫ জুন ২০১৯, ০০:০০

মা আমি ইলিশ মাছ খাব, আজ কত দিন ধরে বাবাকে বলছি ইলিশ মাছ কিনে আনতে।

রাফির কথা শুনে, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে শুকনো হাসি এনে বলল। এই তো বাবু আজকে হাটবার। তোমার বাবা কাজ শেষ করে হাটে যাবে, আজ অবশ্য-ই তোমার জন্য ইলিশ মাছ নিয়ে আসবে।

মায়ের মুখের কথা শুনেও ভরসা পায় না রাফি।

কারণ আজ কয়েক দিন ধরে এই একই কথা বলে আসছে।

সন্ধ্যার একটু আগে রাফির বাবা কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলে। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জয়িয়ে ধরে।

আজ হাটবার স্মরণ করে দিয়ে বলল, বাবা বাবা আজ কিন্তু আমি ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাব।

আজ তুমি যদি ইলিশ মাছ সঙ্গে করে নিয়ে বাড়িতে না আসো, তবে আমি আজ রাতে ভাত খাব না।

এমনকি রাতে ঘুমাবও না।

কত হবে রাফির বয়স, সাত বছর। তবে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যেরকম হয়, রাফিও ঠিক একই রকম স্বভাবের হয়েছে, প্রচন্ড জেদি।

রাফির বাবা একজন দিনমুজর, অন্যের জমিতে কাজ করে রোজ যা আয় করে। কোনো রকমে খেয়ে পরে চলছে ওদের সংসার।

রাফির মা, একজন জন্মগত প্রতিবন্ধী ডান হাতে বল-শক্তি কম। ভারী কোনো কাজ-কাম ঠিকমতো করতে পারে না। ওদের পরিবারে একমাত্র উপার্জন ক্ষমতাবান ব্যক্তি হলো রাফির বাবা।

হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে, বাজার খরচের ব্যাগ হাতে নিয়ে দুর্গাপুর হাটে চলল আজমত মিয়া।

বাড়ি থেকে বাহির হয়ে পুকুর পাড়ে আসতেই রাফি দৌড়ে এসে আবার বলল, বাবা আমার কথা মনে আছে তো! আজ কিন্তু আমি ঘুমাব না তুমি ইলিশ মাছ নিয়ে আসলে, তবেই আমি ওই মাছ দিয়ে ভাত খাব তার পরে ঘুমাব। ছেলের কথার কোনো উত্তর দেয় না আজমত মিয়া।

হেঁটে দুর্গাপুর হাটে এলো। ময়লা জমা ভাঁজ পড়া পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে, টাকা বের করল।

কালকে সকালে একটা সমিতির কিস্তির টাকা দিতে হবে। দুই সপ্তাহ ধরে বকেয়া পড়ে আছে। এই সপ্তাহে কিস্তি দিতে না পারলে অনেক বড় অপমান সহ্য করতে হবে।

পকেটে মাত্র ২৫ টাকা আছে! কিস্তি দিতে হবে ৩০০ টাকা। চাল কিনতে হবে, তরিতরকারি কিনতে হবে। আবার ছেলের আবদার ইলিশ মাছ কিনতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা শেষে রাত হয়ে এলো।

হাটজুড়ে লোকের অনেক ভিড়! আজমত মিয়া, ৩০০ টাকা আলাদা ভাঁজ করে রাখে।

বাকি টাকার থেকে কয়েক কেজি চাল কেনে।

বাদ বাকি টাকা নিয়ে দুর্গাপুর বাজারের উত্তরে মাছ বাজারে যায়।

বড় বড় ইলিশ মাছ দেখে, দাম করার সাহস হয় না।

দূর থেকে শুধু দাঁড়িয়ে দেখে।

আজমত আলী মনে মনে ভাবে, কেন যে ছেলেটা বোঝে না, এসব বড় বড় মাছ হলো বড় বড় কর্তা বাবুদের জন্য। আমাদের জন্য ইলিশ মাছ কেনা তো দূরের বিষয়, কাঁটাও কেনার সাধ্য নেই।

অনেক সময় মাছ বাজারে ঘোরাঘুরি করার কারণে, এক লোকের সন্দেহ হলো আজমত মিয়াকে। কাছে ডেকে জানতে চাইল এত সময় ধরে এখানে কেন ঘোরাঘুরি করছে! ইলিশ মাছ কেনার মতো টাকা হাতে নেই। এই কথা লজ্জা-শরমে সবার সামনে বলতে পারল না। কথার কোনো উত্তর না পেয়ে আজমত মিয়াকে চোর উপাধি দিয়ে সবাই মিলে গণপিটুনি দিল। আজমত মিয়া যদিও সবাইকে চিৎকার করে বলছে, সে চোর নয়। তবে কে শোনে এই কথা! হাটের মানুষ সবাই হুজকে মাতাল। গণপিটুনিতে, মাথায় আর কানে প্রচন্ড রকম আঘাত পায় আজমত মিয়া। লাল লাল তাজা রক্তের স্রোত বয়ে যায় মাছ বাজারের মেঝেতে। এক সময় মাথা ঘুরে পড়ে যায় মেঝেতে। কেউ একজন এগিয়ে এসে ধরাধরি করে নিয়ে যায় পাশের এক ওষুধ ফার্মেসিতে। তবে তার অনেক আগেই, চোর উপাধি নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছে আজমত মিয়া।

অথচ রাফি তখনও বারবার ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে আসছে। আর রাস্তার পানে উঁকি মেরে তাকিয়ে দেখে আজমত মিয়া ইলিশ মাছ নিয়ে কখন আসবে! আহা! বাবা আজ ইলিশ মাছ নিয়ে আসবে, মা রান্না করবে, ম-ম ঘ্রাণ।

রান্না শেষে সবাই মিলে বসে মজা করে পেট পুরে ভাত খাবে। তবে রাফি তখনও জানে না, তার বাবা আর ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। চলে গেছে না ফেরার দেশে, রাফিকে সারা জীবন বেঁচে থাকতে হবে চোরের বাচ্চা উপাধি নিয়ে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<53554 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1