শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
তোমাদের জন্য

আহনাফের ফুলগাছ ও কাক

বন্ধু গোলাম মোর্তুজা
  ২৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

আহনাফের বয়স এগারো বছর সাত মাস বিশ দিন। এই তো ক'টা দিন আগে ও ছোট ছিল। আবার এখন যে বড় হয়ে বুড়ো-ধাড়ি হয়ে গেছে তাও না। সে সময়ে কোনো কিছু চেয়ে না পেলে কাঁদতো নীরবে-নিঃশব্দে। অল্পতেই অস্থির। ওকে দেখলে মনে হয় চোখের জল খুব সস্তা। মেধা ও মননেও বেশ চৌকস। সরকারি স্কুলে এবারই চান্স পেয়েছে। পিতা কবির ও মাতা নাতাশা অসাধ্যকে সাধন করায় ছেলে আহনাফকে বুকে তুলে নিয়ে আদরে আদরে ছেলেকে বিরক্ত করে তুলেছিল। 'আমার সোনারে, আমার জাদুরে আমাদের স্বপ্নটাকে সার্থক করে তুলেছে। আলস্নাহ আমাদের কলিজার টুকরাকে মানুষের মতো মানুষ কর।'

সেদিন মনে হয় আকাশ থেকে ঝেঁপে তরতর করে নেমে এসেছিল যৌবনপ্রাপ্ত চাঁদ। রাত পেরুলেই ফলাফল। মা নাতাশা সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারেননি। পিতা কবির অলস সময় কাটিয়েছেন। চাঁদ-তারা দেখে দেখে বাবা, মা সময় না কাটালেও কিন্তু আকাশ জেগে ছিল স্বপ্নিল আবেশে। বাবা-মায়ের হেন কাজে আহনাফও বেশ বিচলিত। সংসারের সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর একমাত্র সলতে ও বলেই এমন হচ্ছে- এটা ও বোঝে। সবাই নির্ঘুমে তাই আহনাফও সে রাতে ঘুমোতে পারেনি এক মুহূর্ত। তাই সেদিন রাত নামক হাঁপর চালাতে চালাতে কখন সকাল হয়ে গেছে কেউ-ই বুঝতে পারেননি।

গ্রামের রাস্তা-পথ মাড়িয়ে, সব গাছ ছেড়ে- ছাড়িয়ে আহনাফের স্কুল চান্সপ্রাপ্তির এক মাসের মাথায় শহরে পাড়ি জমালেন কবির সাহেব। গ্রাম থেকে শহরে স্কুল করা বেশ ঝক্কি-ঝামেলা ও কষ্টকর। তাই ছেলে আহনাফের সব সুযোগ-সুবিধার কথা ভেবেই স্কুলের পাশে একটি ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া নিলেন। সেখানে আরও দুটি ফ্ল্যাটে দুটি পরিবার থাকেন। সবাই-ই যে যার মতো করে চলে আর মুখোমুখি পড়লে হাই-হ্যালো দিয়েই শেষ। শহরে এর চেয়ে বেশিই বা কী আর আশা-ভরসা করা যায়!

আহনাফ এ ফ্ল্যাটে এসে প্রথম প্রথম বেশ উৎফুলস্ন-আনন্দিত। কিন্তু ক'মাস পরে একদিন আহনাফ বেলকনির গ্রিল ধরে একা একা ভাবে- আনমনে, গ্রামে সবাই সবার সঙ্গে কথা বলে, মিলেমিশে থাকে। সবাই সেখানে নিখুঁত-নিখাদ এক সম্পর্কে জড়িয়ে-ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন। এর এই এখানে ইট-বালি সিমেন্ট-কংক্রিটের শহরে উল্টো পথে- ভিন্ন মতে- অন্য ধাঁচে চলেন সবাই-ই। গ্রামে আমার ছিল খেলার প্রিয় সাথী। আর এখানে কেউ খেলে না। মাঠ নেই। পুকুর নেই। খড়ের ছাউনির ঘর নেই। আমার ফুলের বাগান নেই। প্রতিদিন সকালে আসতো কাক সে কাকও নেই। অন্য কাক আসে কিন্তু সে রকম ডাক নেই। এখানে সেসব কিছুই 'সোনার পাথর বাটি' পাবার মতোই অবস্থা। শহরে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে আর হলেও বুঝি না। আমার গ্রামের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি পড়তো ঝম ঝম আর আমি তখন মায়ের পরশ না পেয়েও বৃষ্টির আদরে নরম নরম বাতাসে দাপুটে মনটাকে শান্ত করে কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম বুঝতেই পারতাম না। মা রেগে-মেগে ডাকলেও উঠতাম না। কিন্তু যখন মা অগ্নিমূর্তি ধারণ করতেন তখন দপদপিয়ে জেগে উঠতাম। বলতাম, 'কেবলি ঘুমালাম কেন এখনি ডাকলে?'

নানান চিন্তা আর অনুভবের হাজার দিকের আঘাতে আহনাফ একদিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঠিকমতো খায় না, কারও সঙ্গে কথা বলে না মন খুলে, ওর দিকে তাকালে মনে হয় হাসি-খুশি ওর থেকে চির জনমের মতো বিদায় নিয়েছে। বেশি বকলে কাঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। প্রচন্ড গরমেও কাঁথা-কম্বল জড়িয়ে কাঁদে আর কাঁদে। স্কুলে যেতে চায় না। যেতে ভালো লাগে না। জোর-জবরদস্তি করে নিলেও থাকে না। স্কুল থেকে কর্তৃপক্ষ ফোন দেয় 'আপনার সন্তান কাঁদছে এসে নিয়ে যান।' স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে মেশে না, খেলে না, কথাও বলে না। একাকিত্বের পাহাড় যেন ওকে চেপে ধরেছে। ও সেখান থেকে উত্তরণ হতে কোনোমতে পারছে না। সে দিনটি ছিল শুক্রবার। আজ সবাই যাপিতজীবনের রসে উজ্জীবিত-সঞ্জীবিত। সপ্তাহে একটা দিন মাত্র আরাম-আয়েশ। তাই খায়েশ করে জম্পেশ করে টিভি প্রোগ্রাম, মোবাইল ফোনে ব্যস্ততা। কিংবা জমিয়ে আড্ডা। কিন্তু না কিছুই হলো না। বাড়ির সবাই ভালো-সুখের আলো জ্বালো-জ্বালো। শুধু ভালো নেই আহনাফ। পৃথিবীর সব স্তব্ধতা ওকে ছুঁয়ে গেছে। ছেলের পরিস্থিতিতে বাবা-মায়ের মনে হচ্ছে যেন কেউ শীল-পাটা দিয়ে মারছে সজোরে আর আঘাতে আঘাতে মাথা জর্জরিত হয়ে রক্ত বের হচ্ছে বা হবে। চিন্তার উইপোকারা মাথায় ঢুকে খাচ্ছে ঘিলু। সব শেষ হওয়ার আগেই ছেলেকে নিয়ে বাবা-মা ছুটলেন ড. প্রিন্স আশরাফের কাছে। উনি শুধু ডক্টর নন, পারিবারিক সদস্যও বটে। একজন সাদামাটা রংচটা জীবনের সাদাসিধা মানুষ। ডাক্তার সাহেবের কাছে সব খুলে বললেন আহনাফের মা ও বাবা। সব কথা শুনে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ডাক্তার সাহেব বললেন, 'আপনারা গ্রামে ফিরে যান। আপনার সন্তানের ওষুধ খাইয়ে ভালো বা সুস্থ করার কোনো রোগ হয়নি, যা হয়েছে তার একমাত্র মহৌষধ গ্রাম। গ্রামই আপনার ছেলের প্রাণ ভোমরা। গ্রামে এমন কিছু অনুষঙ্গ ছিল যা ওকে ওর ভাবনার আকাশে বজ্রসম আঘাত করছে। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পেছনের রৌদ্রের ফাঁক গলে বের হওয়া আসা রাক্ষুসী স্মৃতি। সেই মধুমাখা স্মৃতিগুলো, ভালোবাসার রংধনুর সাত রং ওর মনে বিদু্যৎ খেলে যায়- বিভিন্ন স্বরূপে রং ছড়ায়। আর তা সহ্য করতে না পেরে এমন অদ্ভুত, অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আর কটাদিন গেলে হয়তো মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে যাবে। এবং অবশেষে মানসিক রোগীতে পরিণত হবে। আপনারা যে ফ্ল্যাটে উঠেছেন তাকি ওর বান্ধব হয়েছে? না, তা হয়নি। তাই এমন। ওর কোমল মনকে আর করাত দিয়ে কাটবেন না। ওকে বেড়ে উঠতে দিন ওর মতো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<59893 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1