শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
শিশুতোষ গল্প

ভূতের ভয়

মোহাম্মদ অংকন
  ১৭ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

লোটোর পড়ার রুমের পেছনে একটি জলপাইগাছ আছে। গাছটি রুমের দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে। ডালপালাযুক্ত লম্বা সে গাছ। প্রতিবছর ঝুমঝুম জলপাই ধরে। কখনো ঝড় উঠলে গাছের শাখা-প্রশাখা টিনের চালে আঘাত করে। মড়মড় শব্দ হয়। যেন এক্ষুনি সব ভেঙে পড়বে মাথায়। এ দুশ্চিন্তা ঝড়ের সময়ে কিংবা প্রবল বেগে বাতাস উঠলে। জলপাইগাছের ডাল তুলনামূলক নরম হওয়ায় কতবার যে গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে, তার হিসেব নেই। রাতের বেলা এমনটি হলে আঁতকে ওঠা স্বাভাবিক। লোটো এ আতঙ্ক সামলে নিতে পারে বেশ।

বেশ কদিন ধরে লোটো ওর ঘরের পেছন থেকে উৎকট শব্দ শুনছে। মড়মড় শব্দ নয় এটা। এমন হলে ও ধরেই নিত জলপাইগাছের ডাল ভেঙে পড়ছে। আর এখন ঝড়-বৃষ্টিও নেই। ডালপালা ভেঙে পড়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। প্রতিরাতে যে শব্দটি ওর কানে এসে বাজছে, ওর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অস্বাভাবিক মনে হওয়ার একটাই কারণ, রাত বাড়লেই শব্দ শুরু হয়। দলবেঁধে কারা যেন শব্দ করে। সকাল, দুপুর, বিকালে এ রকম শব্দ শোনা যায় না। লোটোর কাছে বড়ই ভয়ার্ত ব্যাপারখানা।

লোটোর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে কদিন বাদে। রাত জেগে পড়তেই হবে। এইটে স্কলারশিপ তাকে পেতেই হবে। এমন পণ তার। তাই পড়তে পড়তে তার রাত ১২টা পেরিয়ে যায় প্রায়ই। রুমে একা একা পড়তে হয়। ততক্ষণে তার মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়ে। লাইট জ্বালিয়ে লোটো গুনগুন করে পড়তে থাকে। খাতাভর্তি অঙ্ক কষতে থাকে। অমনি 'কুটকুট' শব্দ শুরু হয়ে যায়। যেন দলবেঁধে 'কুটকুট' শব্দ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে কারা যেন। লোটো ধীরে ভয় পেতে থাকে। ওর মনের মধ্যে ভেসে ওঠে নানা দুশ্চিন্তা। মনে হয়, ভূত এলো। ভূতের ভয় তাড়া করে ওকে।

লোটো ধীরে ধীরে বুকে সাহস সঞ্চার করে।

'না, ওটা ভূত-পেতনী নয়। আমার মনের ভুল ধারণা।' কিন্তু কদিন এভাবে? মাঝেমধ্যে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। লাইট বন্ধ করতে ভয় পায়। অন্ধকারে যদি সত্যি সত্যি ভূত এসে গলা চেপে ধরে। লাইট জ্বলে থাকলে তো ভূত আসতে পারবে না। ভূতরা নাকি আলোকে খুব ভয় পায়। লোটোর সঙ্গে প্রায় প্রতি রাতে এমনটি হচ্ছে। কিন্তু সে বাবা-মাকে বলার সাহস পাচ্ছে না। ভাবছে, বাবা-মা কিনা ভাবে। তারা হয়তো বলবে, 'এত বড় ছেলে হয়েও ভূতের ভয় পায়।'

কিশোর বয়সে এমন বিষয় বাবা-মাকে বলা সত্যিই লজ্জ্বাজনক ব্যাপার। লোটোও তাই মনের মধ্যে ব্যাপারখানা চেপে রাখে।

লোটোর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে আগামীকাল। রীতিমতো পরীক্ষা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সে। অনেক পড়া বাকি। রাত জেগে পড়তেই হবে। রাত একটা, ২টা বেজে যায় সে রাতে। হঠাৎ রুমের পেছন থেকে 'কুটকুট' শব্দ আসতে থাকে। শব্দগুলো এমন প্রকট যেন চিবিয়ে খাচ্ছে কোনো মানুষের হাড়, মাংস। একদল ভূত কোনো মানুষকে ধরে এনে লোটোর পড়ার রুমের চালের উপর বসে কামড়ে খাচ্ছে। আর ভীষণ শব্দ করে লোটোকে সাবধান করে দিচ্ছে।

'লোটো, তুই পালা। নইলে এবার তোকে খাব।'

এমন নয়ছয় ভাবতেই লোটো স্বজোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে, 'মা আঁ আঁ! বাবা আঁ আঁ! আমাকে বাঁচাওওও!'

লোটোর চিৎকারে বাহির থেকে কি যেন উড়ে যাওয়ার আওয়াজ আসে। শোঁ শোঁ শব্দ করে সবাই যেন চাল থেকে চলে যায়। 'কুটকুট' শব্দ আর শোনা যায় না। ততক্ষণে পাশের রুম থেকে লোটোর মা-বাবা তীব্রবেগে ছুটে আসে।

মা বলে, 'কি হয়েছে বাবা? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?' বাবা বলে, 'তুমি এখনো ঘুমোওনি? ঘরের লাইট তো জ্বলছেই।'

লোটো লজ্জায় কিছু বলে না। ভয় পায় প্রচন্ড। মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। থরথর করে কাঁপে তার শরীর। বাবা-মা ধরে নেয়, পরীক্ষার টেনশনে এমন হচ্ছে। মা একগস্নাস দুধ খাইয়ে দেয়। একটু আদর করে। বুকে ফুঁ দেয়। লাইট অফ করে মশারি টানিয়ে দেয়।

'বাবা, তোকে আর পড়তে হবে না। এখন ঘুমা। সকালে পরীক্ষা। এত রাত জেগে টেনশন করলে পরীক্ষা খারাপ হবে।'

বাবা-মা পাশের রুমে চলে যায়। একাকী লোটোর কিছুতেই ঘুম আসে না। কানে হেডফোন লাগিয়ে এফএম রেড়িও শুনতে থাকে। 'কুটকুট' শব্দের বিষয়টি তার মাথা থেকে যায় না। কান পেতে থাকে, আবার শব্দটি শোনা যায় কিনা। না শোনা যায় না। রাতের আঁধারে ঝিঁঝিঁ পোকার মন্ত্র কানে আসে। ততক্ষণে রাত শেষ হয়ে আসে। লোটোর চোখে ঘুম আসে। ঘুমিয়ে পড়ে। মোবাইলে এফএম রেডিও বাজতে থাকে। ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয়ার কথা স্মরণে থাকে না। লোটোর ঘুমানোর সময় থেকে সকাল পর্যন্ত সময়টা দু-তিন ঘণ্টার ব্যবধান মাত্র। তাই ও সকালে ঘুম থেকে সময় মতো উঠতে পারে না। মা-বাবা এসে টেনে তোলে। 'লোটো, আজ না তোর পরীক্ষা, কখন ঘুম থেকে উঠবি?'

মা গায়ে হাত দিতেই অনুভব করে, জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। পরীক্ষার কারণে সে সময় ডাক্তারের কাছে নেয়া হয় না। বাবা একটা 'নাপা এক্সট্রা' খাইয়ে দেয়। ওটা খেয়ে পরীক্ষার হলে চলে যায়।

বিকালেও লোটোর জ্বর কমে না। বাবা নূরপুর গ্রামের স্বনামধন্য আ. আজিজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তিনি ওষুধ দেন। লোটো বাবার সঙ্গে বাড়ি চলে আসে। রাতে পড়তে বসে। রাত ১২টা পেরিয়ে যায়। আজ আবারও 'কুটকুট' শব্দ তার কানে আসে। সে চিৎকার দেয়। 'মা আঁ আঁ! বাবা আঁ আঁ! ভূত! ভূত!'

পাশের রুম থেকে মা-বাবা ছুটে আসে। ছেলের অস্থিরতায় মা-বাবা উদাস হয়ে যায় আজ। সত্যিই ভূত আসলো নাকি?

'কোথায় ভূত? দেখি তো।'

লোটো মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'এই তো টিনের চালের ওপর বসে আছে। তোমরা এলে আর ওমনি চলে গেল। প্রতিরাতেই তো আসে। অঁ্যা অঁ্যা। আমার বড্ড ভয় করছে।' ছেলের এমন কান্ডকারখানায় সে রাতে লোটোর পাশে তার মা ঘুমিয়ে থাকে। ছেলেকে পাহারা দেয়।

'দেখি, ভূত কোত্থেকে আসে আজ?'

পরের দিন পরীক্ষার পর লোটোকে স্থানীয় একজন কবিরাজের কাছে হাজির করা হয়। লোটোর সঙ্গে প্রতিরাতে কি হচ্ছে, সব সে খুলে বলে। লোটোর কথামতো কবিরাজ তার বাড়িতে আসে। রুমে অবস্থান করে। নানা যজ্ঞ, মন্ত্রের আয়োজন করে। ভাগ্যিস, সে রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়। বাহির থেকে শোঁ শোঁ বাতাস আর জলপাইগাছের মড়মড় আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। শীতকালে এমন বৃষ্টি হয়ে গেল, যেন জলপাই সব বেশ কয়েকটি ডালপালা টিনের চালে ভেঙে পড়ে।

সে রাত কেটে যায়। কবিরাজ কোনো কিছু নির্ণয় করতে পারে না। সকালে লোটোর বাবা জলপাইগাছের ডালগুলো সরাতে ঘরের পেছনে যায়। তার চোখে পড়ে, জলপাই গুঁড়ো গুঁড়ো করে খেয়ে আঁটিগুলো টিনের চালে ছিটিয়ে রেখেছে, গাছের নিচে বিছিয়ে পড়েছে। তিনি এ নিয়ে ভাবতে থাকে। এর থেকেই তার ধারণার জন্ম নেয়, রাতে যখন বাদুড় এসে জলপাই চিবায়, তখন 'কুটকুট' শব্দ লোটোর কানে যায়। আর লোটো ভয় পায়। মনে করে ভূত এমন করছে।

লোটোকে এ কথা বললে কিছুতেই বিশ্বাস করে না। বাবা বলে, 'রাত পর্যন্ত অপেক্ষা কর। প্রমাণ করা হবে, এটা ভূত না বাদুড় ছিল।' রাতে লোটো পর্যবেক্ষণ করে। তার বাবার ধারণা শতভাগ সত্যি হয়। 'কুটকুট' শব্দ শুনে জলপাই গাছের দিকে লাইট ধরতেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় উড়ে যায়। লোটো মনে মনে ভাবে, 'আহ্‌! কি শুনে ভয় পেলাম আমি। পরীক্ষাগুলো খারাপ করলাম অযথা। আমার তো মনেই ছিল না যে আমার লাগানো গাছটিতে অনেক জলপাই ধরেছে।'

জলপাই যাতে বাদুড় খেতে না পারে, রাতে যাতে আর 'কুটকুট' শব্দ না হয়, তাই লোটোর বাবা গাছে একটা ঘণ্টা বেঁধে দিলেন, একটা কাকতাড়ুয়াকে পাহারায় বসালেন। রাতে 'কুটকুট' শব্দ হলে লোটো ঘণ্টার রসি ধরে টান দেবে, অমনি বাদুড় উড়াল দেবে। লোটোর ভূতের ভয় কেটে যাবে।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<62513 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1