শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাদল

মিতুল সাইফ
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বয়স আর কত হবে? তেরো-চৌদ্দ, তার বেশি নয়। নাম বাদল। সোনার চায়ের দোকানে পানি টানে। খদ্দের এলে এটা-ওটা দেয়। আমি প্রথম যেদিন বাদলকে দেখি; সেদিনই চমকিয়ে গিয়েছিলাম। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মিষ্টি করে কথা বলে। আমাদের প্রথম কথা হয় এভাবে-

: তোমার নাম কি খোকা?

: আমি বাদল, মা অবশ্য এ নামে ডাকে না, মা আমাকে বাবু বলে ডাকে। আচ্ছা কোন নামটা তোমার পছন্দ? বাদল? না বাবু?

: ভালোবেসে যে নামে ডাকা হয় সেটাই সুন্দর, অনেক ভালো নামও যদি মন্দভাবে ডাকা হয় তবে তা মন্দ হয়ে যায়।

: বাহ্‌ তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বলো, আচ্ছা তোমাকে এই যে আমি প্রথম থেকেই তুমি করে বলছি তুমি রাগ করলে না কেন? কেন জিজ্ঞেস করলে না তোমাকে কেন আমি তুমি বলে ডাকলাম?

: কেন? কেন তুমি করে ডাকলে?

: তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। অন্য সবাই আমাকে পিচ্চি বলে ডাকে, ট্যাবলেট বলে, গালাগালি করে, তুই তুই বলে, তুমি সে রকম নও। তাই তোমাকে 'তুমি' বলেছি।

আমি অবাক হয়ে বাদলের কথা শুনেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। কষ্ট পেয়েছি ওকে এই বয়সে চায়ের দোকানে কাজ করতে দেখে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম-

: তুমি পড়ালেখা করো না কেন? সংসারে আর কে আছে? বাবা নেই? বাবার কথা বলতেই ছেলেটা কেমন হয়ে গেল। চোখ ছল ছল করে উঠল, ঠোঁট কেঁপে উঠল। তারপর বলল-

: বাবা নেই। মরে গেছে। মা আছে। মায়ের খুব অসুখ।

: বাবার কী হয়েছিল?

: আমি, মা আর বাবা বাসে করে নানাবাড়ি যাচ্ছিলাম। আমাদের বাসটা হঠাৎই টলকাতে থাকে। তারপরই গাছের সঙ্গে ধাক্কা। আমরা প্রাণে বেঁচে গেলেও বাবা চলে গেল। পরে শুনেছি ড্রাইভার নাকি নেশা করেছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কেঁদে উঠল বাদল, আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত্বনা দিলাম। কিন্তু ওর বুকের ভিতরে তখনো আগুন। যা এই সামান্য চোখের জলে নিভবে না। আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাদল আবার বলতে শুরু করল-

: মা পরের বাড়িতে কাজ করত, আমাকে ইশ্‌কুলে ভর্তিও করে দিয়েছিল। মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি অনেক বড় হবো। মানুষের মতো মানুষ হবো, তা আর হলো না। মায়ের অসুখ হলো। কঠিন অসুখ। মা এখন আর কাজ করতে পারে না। আমি এই দোকানে কাজ করে যা পাই তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে, বাবা কেন যে মরে গেল! জানো, বাবা খুব ভালো ছিল। অন্য বাবাদের মতো নয়।, একদম আলাদা। সবার চেয়ে সুন্দর বাবা। আবার চোখে জল এসে গেল বাদলের। সোনা কাকা ডাক দিল- বাদলা, মতিনের দোকানে চা দিয়ে আয়। চোখ মুছে চা নিয়ে বাদল চলে গেল।। আমি বিস্মিত হয়ে দোকানের বেঞ্চে বসে থাকলাম। একটু পরেই ফিরে এলো বাদল। ওর হাতে দুটো পাঁচশত টাকার নোট দিয়ে বললাম- মায়ের ওষুধ কিনো। বাদল সযত্নে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানালো। বলল-

: তুমি কেন টাকা দেবে? এত টাকা? আমরা গরিব মানুষ, কষ্ট, দুঃখ আমাদের চিরকালের সঙ্গী। আমার মা না হয় একটু কষ্ট করেই সেরে উঠবে। আমি দিনের বেলায় এখানে কাজ করি। রাতে আর এক বেকারিতে কাজ করি। শুধু দোয়া করো যেন আমার মাকে সারিয়ে তুলতে পারি। এতটুকু এই ছেলেটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর স্নেহ এক সঙ্গে ঝরে পড়তে লাগল। বললাম- আমার সঙ্গে যাবে? আমি তোমাকে স্কুলে পড়াবো, মাকে চিকিৎসা করাবো, চলো না আমার সঙ্গে, আমি এক হতভাগা। তোমার তো মা আছেন। আমার কেউ নেই। বড় একলা আমি। সত্যিই বলছি তোমাদের কোনো অযত্ন হবে না। যাবে? বাদল বলল- সত্যি তোমার কেউ নেই? আমি বললাম- না, কেউ না। ছেলেটা একটু খানি হেসে ফেলল- আছে। আমি বললাম- কে? বাদল বলল- আমি। আমি তোমার কেউ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66546 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1