শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঋতুরানী হেমন্ত

শেখ একেএম জাকারিয়া
  ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

হেমন্ত এলেই মনে পড়ে সুফিয়া কামালের হেমন্ত নামের চিরসবুজ সেই কবিতার কথা,

'সবুজ পাতার খামের ভেতর

হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে,

কোন পাথারের ওপার থেকে

আনল ডেকে হেমন্তকে?'

এ ছাড়া কবি-সাহিত্যিকরা যুগে যুগে হেমন্তের নবান্ন উৎসব, পাকা ধানের ম-ম গন্ধ, শুষ্ক-অনুজ্জ্বল শান্ত প্রকৃতির ভাবচ্ছবি নানাভাবে তাদের রচনায় তুলে ধরেছেন। প্রায় সবাই অবগত, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ দুই মাস মিলে যে ঋতু প্রতি বছর আমাদের দেশে আসে সে ঋতুকে আমরা হেমন্ত নামে জানি। যার কালপর্ব বাংলা বর্ষপঞ্জির কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসব্যাপী। অর্থাৎ ১৭ অক্টোবর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

হেমন্ত ঋতু ছয় ঋতুর চতুর্থ ঋতু। মাস হিসেবে বাংলা পঞ্জিকার সপ্তম মাস, হেমন্ত ঋতুর প্রথম মাস। যা শরতের পরবর্তী এবং শীতের পূর্ববর্তী ঋতু। তাই এ ঋতুকে এ দেশের মানুষজন শীতের পূর্বাভাস বলে অভিহিত করেন। হেমন্তের পুরো সকাল আবছা কুহেলিকায় ঢাকা থাকে। ঢাকা থাকে চারদিকের মাঠ-ঘাট। সবুজ ঘাস ও ধান গাছের ডগায় জমে থাকে শিশিরবিন্দু। যা আমাদের জানান দেয় হেমন্ত এসেছে। এসময় হালকা শীত অনুভূত হয়। সূর্য ওঠার পর ধীরে ধীরে কুহেলিকা মুক্ত হয় চারপাশের মাঠ-ঘাট ও আকাশ। হেমন্ত মানেই শিশিরভেজা নয়ন মনোমুগ্ধকর এক সকাল। এ সময় শরতের কাশফুল একদিকে মাটিতে নুইয়ে পড়ে অন্যদিকে মহাসমারোহ নবান্নের আগমন ঘটে। অনেকেই এ ঋতুকে বৈচিত্র্যময় রং ও পাতা ঝরার ঋতুও বলে থাকেন। কারণ হিসেবে বলা যায়, ঝাউগাছ ছাড়া প্রায় সবগাছের পাতাই এসময় ঝরে যেতে শুরু করে এবং শীতের আগমনের আগেই অধিকাংশ বৃক্ষ পাতাহীন হয়ে যায়।

বইপাঠে জানা যায়, কৃত্তিকা ও আগ্রানামক দুটি তারার নামানুসারে এ ঋতুর মাসদ্বয়ের নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। কার্তিকের আঞ্চলিক নাম 'কার্তি'। যাকে গাঁয়ের লোকজন 'মরা কার্তিক' নামেই জানেন। মরা কার্তিকের পরই আসে সার্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন। এই নবান্ন শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো নতুন অন্ন বা নতুন ভাত। হেমন্তকালীন ধান কাটার পর নতুন চালের পিঠা-পায়েস প্রভৃতি খাওয়ার উৎসব বা পার্বণবিশেষ। যা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মহোৎসব, পলস্নী বাঙালির প্রাণের উৎসব। মূলকথা, নবান্ন হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে তৈরি চালের প্রথম রন্ধন উপলক্ষে আয়োজিত আনন্দানুষ্ঠান, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে পাকা আমন ধান কাটার পর অনুষ্ঠিত হয়। হেমন্তের এই ফসল কাটাকে ঘিরেই নবান্ন উৎসবের সূত্রপাত।

মধ্যযুগে বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কেননা, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষদিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। অগ্রহায়ণের শুরুতে সেই ধান কেটে মাড়াই করে গোলায় তুলে রাখেন কৃষকরা।

অগ্রহায়ণ শব্দটির 'অগ্র' ও 'হায়ণ' এ দুটি অংশের অর্থ যথাক্রমে ধান ও কাটার মৌসুম।

সম্ভবত এ কারণেই সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালের পায়েস, ক্ষীর, পুলি-পিঠে তৈরি করে নিকট-আত্মীয় ও পড়শিদের ঘরে বিতরণ করা হয়। কোনো কোনো গাঁয়ে নবান্নে মেয়ে জামাইসহ দূরের আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকে নাইওর আনা হয় বাপের বাড়িতে। আমাদের দেশে প্রতি বছরই নবান্ন এলে গ্রামে-গঞ্জে মেলা বসে। এসব মেলায় নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান-বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। তার মধ্যে লাঠিখেলা, জারিগান, বাউলগান, পালাগান, যাত্রাপালা উলেস্নখ করার মতো। এ ছাড়া রেশমি চুড়ি, চুলের কাটা, কানের দুল, হাতের আংটি, নাকফুল, গলার চেইন, বিভিন্ন সুগন্ধিদ্রব্য, বাঁশের বাঁশি, একতারা-দোতারা, ছোটদের জমকালো নানারকমের খেলনা, সুস্বাদু রসগোলস্না, চিনি-জামসহ খই ও উকড়া-মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।

হেমন্তে শিউলি, কামিনী, জবা, গোলাপ, মলিস্নকা, বকফুল ইত্যাদি নানা ধরনের ফুল ফোটে। হেমন্তের সকালে শিউলি ফুলের সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে ভিন্ন আমেজ। প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সবাই। এ ছাড়া হেমন্তে নানা ধরনের ফলের সমারোহ ঘটে। হেমন্তে উলেস্নখ করার মতো ফল হলো কামরাঙা ও চালতা। নারিকেল এ ঋতুর প্রধান ফল। প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারে গৃহকর্ত্রীর পিঠার তালিকায় থাকে নারিকেলের তৈরি নানারকম মুখরোচক খাবার। এসময় মহিলারা সারারাত জেগে কষ্ট করে নানারকমের পিঠা তৈরি করেন, আর সে কষ্ট আনন্দময় হয়ে ওঠে সকালে তা পড়শির মধ্যে বিতরণ ও অতিথি আপ্যায়নের মাধ্যমে।

অতীব দুঃখের বিষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপকভাবে ঋতু পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বর্তমানে ছয়টি ঋতুর মধ্যে চারটি ঋতু গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত ঋতুর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। বাকি দুটি ঋতু হেমন্ত ও বসন্ত প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়েই গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75607 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1