শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের স্থপতি

নতুনধারা
  ১৫ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

কবির কাঞ্চন

বিলাস এইমাত্র স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছে। ওর আজকের দিনটা প্রতিদিনের মতো হয়নি। ওদের শ্রেণিশিক্ষক প্রথম ঘণ্টায় এসে রোল কল শেষ করেই ডায়েরি বের করতে বললেন।

বিলাসসহ ওর বেঞ্চের সহপাঠীরা একে অন্যের মুখের দিকে কৌত‚হলী চোখে তাকায়। স্যার প্রতিদিন ক্লাসে এসে রোল কল করেন। এরপর পাঠদানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মাঝেমধ্যে আয়া নোটিশ খাতা নিয়ে এলে স্যার পাঠে একটু বিরতি নেন। নিজে নোটিশে চোখ বুলান। এরপর জোরে জোরে শব্দ করে তা ক্লাসে পড়ে শোনান। এবং ছাত্রছাত্রীদের তা ডায়েরিতে তুলে নেয়ার তাগিদ দেন। কিন্তু আজ কোনো আয়া নোটিশ খাতা নিয়ে আসেনি। স্যার হাজিরা খাতার ভিতর থেকে একটি রঙিন কাগজ বের করে বোডের্ লিখতে লিখতে বললেন,

- আগামী ১৫ আগস্ট আমাদের জাতির জনকের ৪৩তম মৃত্যুবাষির্কী। এ উপলক্ষে তোমাদের জন্য বিভিন্ন ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ করে তোমরা যারা ছবি অঁাকতে পারো তাদের জন্য সুখবর হলোÑ এবার জাতীয় শোক দিবসে তোমাদের অঙ্কনের বিষয় হলো ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মনের মতো ছবি অঁাকা’। তোমরা যারা এতে অংশ নেবে তারা সামনে এসে আমার কাছে নাম জমা দিতে পারো।

এই কথা বলে স্যার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। ব্যাগ থেকে আরও কিছু কাগজ নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন। ডায়েরির লেখা তুলে নিয়ে আগ্রহীরা স্যারের কাছে নিজেদের নাম জমা দিল।

এরপর স্যার আবার বললেন,

- আর কেউ অংশ নেবে? এরপর কিন্তু আর কারও নাম জমা নেয়া হবে না।

বিলাসকে দঁাড়াতে দেখে স্যার বললেন,

- বিলাস, তুমি তো ভালো অঁাকতে পারো। নাম জমা দিচ্ছো না কেন?

বিলাস একটু ভেবে নিয়ে বলল,

- স্যার, অঙ্কনের নিধাির্রত বিষয় নিয়ে আমি খুব চিন্তিত।

স্যার বিস্মিত হয়ে বললেন,

- এত সুন্দর একটি বিষয় পেয়ে আবার কীসের চিন্তা!

- স্যার, নিঃসন্দেহে বিষয়টা খুবই তাৎপযর্পূণর্। সমস্যাটা আমার মনের মধ্যে।

- মানে?

- আমার দাদার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পকের্ জেনেছি। বঙ্গবন্ধু কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। মা, মাটি দেশকে তিনি জীবন দিয়ে ভালোবেসে গেছেন। ক্ষমতার লোভ পযর্ন্ত করেননি। এমন একজন মহান নেতার ছবি অঁাকতে মনের বল লাগে। মনের মধ্যে অসীম ভালোবাসা লাগে। আমি কী তার সুন্দর ছবি অঁাকতে পারব, স্যার!

বিলাসের কথাগুলো শুনে স্যার ওর আরও কাছে এসে দঁাড়ালেন।

তারপর পিঠে হাত রেখে বললেন,

- অবশ্যই পারবে। বঙ্গবন্ধুর জন্য যার বুকে এমন শ্রদ্ধা আছে তার অঁাকা ছবি হবে মনের মতো। আচ্ছা তোমার দাদা কী কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন?

- হ্যঁা, দাদু বলেছেন, ৭ মাচের্র সেই ভাষণে তিনি নাকি বিশাল জনসমুদ্রের সামনের দিকে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছিলেন তখন লাখো মানুষের ¯েøাগানে পুরো ময়দান উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এরপর মাইকের সামনে দঁাড়াতেই চারদিকে সুনসান নীরবতা।

দাদুর মতে, নেতা এলেন, দিকনিদের্শনা দিলেন, আর উদ্বেলিত জনতার মনে প্রিয় মাতৃভ‚মিকে মুক্ত করার বীজ বপন করে চলে গেলেন।

এরপর স্যার বিলাসকে বললেন,

- বাসায় গিয়ে তোমার দাদুকে আমার সালাম জানাবে।

‘জ্বি স্যার’ বলে বিলাস ঘাড় নাড়ে।

স্যার ক্লাস থেকে চলে যাওয়ার পর বিলাস বন্ধুদের সঙ্গে নিজের দাদার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার গল্প শোনায়। বন্ধুরা দাদুর সাক্ষাৎ লাভের জন্য বিলাসের কাছে বায়না ধরে। বিলাস তাদের দাদুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়ার কথা দেয়।

কিছুদিন পর বিলাসের দাদা ওর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে স্কুলের দিকে আসেন। ততক্ষণে স্কুল ছুটি হয়ে যায়। দাদুকে দেখে বিলাস ও তার বন্ধুরা খুশি হয়ে এগিয়ে আসে।

বিলাস তার বন্ধুদের সঙ্গে দাদুকে পরিচয় করিয়ে দেয়।

পরিচিত হয়ে কথা বলতে বলতে তারা স্কুলের মাঠের এক কোণে শহীদমিনারের পাশে গিয়ে বসলেন।

বিলাসের বন্ধুরা একজন মুক্তিযোদ্ধার সান্নিধ্য পেয়ে ভেতরে ভেতরে কৌত‚হলী হয়। মহান এই মুক্তিযোদ্ধাকে ঘিরে মনে মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগে। দেশকে শত্রæমুক্ত করতে অস্ত্র ধরার সৌভাগ্য তাদের হয়নি। এজন্য প্রায় অনুশোচনা করে। জন্মটা কেন একাত্তরের আগে হলো না? আবার ভাবে, জন্মে তো আল্লাহ ছাড়া কারোর হাত থাকে না।

দাদু বিলাসের সহপাঠী মুনিরকে ভাবনায় নিমগ্ন থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

- কি ভাবছো, দাদু?

- আপনাকে।

- আমাকে মানে!

- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন যোদ্ধাকে সামনাসামনি দেখছি। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে। আমাদের দেশের প্রকৃত বীর কিন্তু আপনারাই।

বিলাসের দাদু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

- না, দাদুভাই আমাদের দেশের প্রকৃত বীর একজনই। আর তিনি হলেনÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা দেশবাসী ছিলাম সেই বীরের অনুসারী।

- সরি, আপনি যেভাবে ভাবছেন আমি সে অথের্ বলিনি। আমার মতে, দেশের ডাকে সেদিন যারাই সাড়া দিয়েছিলেন তারা সবাই হিরো। আচ্ছা, বিলাসের কাছ থেকে জেনেছি আপনি নাকি রেসকোসর্ ময়দানের ৭ মাচের্র ঐতিহাসিক ভাষণে উপস্থিত ছিলেন। সেই অবিস্মরণীয় দিনটিতে আপনার অভিজ্ঞতার কথা যদি আমাদের বলতেন।

- সেদিন খুব ভোরের দিকে আমরা মিছিল নিয়ে রেসকোসর্ ময়দানে পৌঁছি। বেলা যত গড়াতে থাকে তত মানুষের ঢল নামতে থাকে। আমরা আগে আগে পৌঁছেছিলাম বলে একেবারে মঞ্চের কাছে বসার সৌভাগ্য হয়। মূলত দুপুর ৩টার পর থেকে আমাদের মন ছটফট করতে থাকে। নেতার কাছ থেকে সঠিক নিদের্শনার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকি। মাঝে মধ্যে গা গরম করতে ¯েøাগান ধরি। অবশেষে সবাই জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চে আসেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রথমে উপস্থিত জনতার অভিবাদন গ্রহণ করলেন। এরপর পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির সব ষড়যন্ত্রের বণর্না দিলেন। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূবর্ পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহŸান জানান।

এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ... বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠের এই ভাষণে আমরা সেদিন উজ্জীবিত হই।

এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে আমরা যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলাম।

সবাই প্রিয় জন্মভ‚মিকে শত্রæমুক্ত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরে আসি। তারপরের ঘটনা তো সবার জানা। আমাদের অসীম ত্যাগের ইতিহাস।

বিলাস ও তার বন্ধুরা খুব আগ্রহী মনে শুনছিল। এরপর রেজা পাস থেকে বলল,

- দাদু, যুদ্ধ পরবতীর্ সময়ে দেশের সাবির্ক পরিস্থিতি সম্পকের্ জানতে চাই।

- যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু আবার নতুন করে দেশ গড়ার কাজে হাত দেন। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে লাগলেন। বিশ্ব নতুন এক স্বাধীন রাষ্ট্রকে আবিষ্কার করে। চারদিকে বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ধন্য হতেন। কিন্তু...।

হঠাৎই যেন দাদুর কণ্ঠ ভারি হয়ে এলো। অবাক হয়ে সবাই খেয়াল করল, তার চোখ জলে ভরে গেছে এবং অশ্রæ গড়িয়ে পড়ছে।

বিলাস ও তার বন্ধুরা দাদুর আরও কাছে বসে দাদুর কান্না থামানোর চেষ্টা করে।

কিছুক্ষণ পর দাদু নিজেকে সামলে নিয়ে আবেগী গলায় বললেন,

- তারপর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কিছু কুলাঙ্গার রাতের অঁাধারে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে।

বিলাস দাদুর মুখের দিকে লক্ষ্য করল। তখনও দাদুর চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। স্বজন হারানোর নিদারুণ কষ্ট দাদুর হৃদয়কে ভেঙে চুরমার করছে।

বিলাস সন্দেহের চোখে বলল,

- আচ্ছা দাদু, বঙ্গবন্ধুর জীবনের গল্প বলতেই যেভাবে কঁাদলে তাতে মনে হচ্ছে তিনি আমাদের পরিবারের কেউ!

বিলাসের দাদু খুব আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন,

- তুমি একদম ঠিক কথা বলেছো, দাদুভাই। সত্যি তো বঙ্গবন্ধু আমাদের পরিবারের কেউ নন। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, তিনি আমাদের আত্মার লোক। তার সঙ্গে বাঙালির সম্পকর্ রক্তে নয়; আত্মার। স্বাথের্ রক্তের বঁাধন ছিঁড়ে; আত্মার বঁাধন জনম জনম অটুট থাকে। তা ছাড়া পিতাকে কি কভু ভোলা যায়?

বিলাসের বন্ধু আদিত্য বলল,

- না, তা কি করে সম্ভব! পিতা তো পরম শ্রদ্ধার পাত্র।

দাদু বললেন,

- এ বিষয়ে তুমি কি কিছু বলবে?

- ঈশ্বরের কৃপায় পিতার জন্যই তো জীবন পেয়েছি।

শন্তানুর কথা শেষ হতে না হতেই দাদু উজ্জ্বল মুখে বললেন,

- তোমাদের বাবা যেমন তোমাদের জন্ম দিয়েছেন বলে তোমরা বাবাকে ‘বাবা’ বলে পরম শ্রদ্ধা কর। তেমনি যে দেশটিতে আজ তোমরা সুখে-শান্তিতে বড় হচ্ছো এর স্থপতি মানে জন্মদাতা কিন্তু এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ জন্যই তিনি আমাদের বাঙালি জাতির পিতা।

দাদুর কথাগুলো শুনে বিলাস ও তার বন্ধুরা মুগ্ধ চোখে দাদুর মুখের তাকিয়ে থাকে। দাদু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

- জাতীয় শোক দিবসে তোমাদের ছবি অঁাকার কি খবর?

তখন ওরা প্রায় একসঙ্গেই বলল, ‘দাদু আপনার কাছ থেকে গল্প শুনে না দেখা সেই মহান ব্যক্তিটির ছবি আমাদের হৃদয় ক্যানভাসে ইতোমধ্যে এঁকে ফেলেছি। এখন শুধু কাগজে অঁাকার অপেক্ষা। আশা করছি অবশ্যই ভালো হবে। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

দাদু হাসতে হাসতে গবর্ করে বললেন,

- যে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার পিতাকে এত ভালোবাসতে পারে সে জাতির উন্নতি তো সময়ের ব্যাপারমাত্র। আশা করি তোমাদের কাছে আমাদের সীমাহীন ত্যাগে অজির্ত পতাকার সম্মান অক্ষুণœ থাকবে।

বিলাস ও তার বন্ধুরা দাদুর চোখে চোখ রেখে দেশের জন্য সবর্দা কাজ করার শপথ নেয়। এরপর দাদু সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শহীদমিনারের সামনে এসে দঁাড়ায়। পরম শ্রদ্ধায় জাতির সূযর্সন্তানদের স্মরণ করে।

বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজ চট্টগ্রাম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<7930 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1