বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
শিশুতোষ গল্প

মিশন জলপাই

মোহাম্মদ অংকন
  ১১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

এলাকায় গুজব ছড়ানো আছে, পূর্বপাড়ার শ্যামা মিয়া বাজারে মিষ্টিকুমড়ো বিক্রি করতে গিয়েছিল। দেশে নতুন মিলিটারি নিয়োগ দেওয়ার জন্য জনবল খোঁজ করা হচ্ছিল। মিষ্টিকুমড়োর ডালা রেখে লাইনে দাঁড়িয়ে তার মিলিটারি বাহিনীতে চাকরি জোটে। এটি এলাকার জন্য গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সে সময়। লোকে বলাবলি করে, 'ওমুক মিলিটারির চাকরি পেয়েছে।'

শ্যামা মিয়া প্রায় চলিস্নশ বছর মিলিটারির চাকরি করেন। সেই কিশোর থেকে তিনি এখন বয়োবৃদ্ধ। গ্রামের বাড়িতে অবসর দিন কাটছে তার। টাকা-পয়সার অভাব নেই তার। ছেলেরা চাকরি-বাকরি করছে, মেয়েরা পড়াশোনা করছে। কিন্তু স্বভাব বড় খিটকেলে জিনিস। শ্যামা মিয়া হাড়কিপটে স্বভাবের মানুষ।

চলিস্নশ বছর আগে শ্যামা মিয়া বাজারে মিষ্টিকুমড়ো বিক্রি করত। সে অভ্যেস একদম বদলায়নি। এখন তিনি আম, জাম, কলা, কাঁঠাল, বরই, জলপাই বিক্রি করেন। মৌসুম ভেদে মৌসুমি ফল, সবজি। মানুষ তো যা তা বলে। তার কানে ঢোকে না।

'আপনার কিসের অভাব? বাড়ির এসব না বেঁচলে চলে না? এসব আর মানায় না।'

বেচাবেচির চেয়ে শ্যামা মিয়া কিপটে স্বভাবের জন্য বহুল আলোচিত। কোনো জিনিস যদি তিনি ২০ টাকা নির্ধারণ করেন, তবে তাই। একটি টাকাও কমানোর জোঁ নেই। যা মুখের কথা, তাই কাজ। একটি জিনিস বেশি দেওয়াও সম্ভব না। মোটের ওপর তার এ স্বভাব সবার জানা। কেউ কিছু বলতে পারবে না। এটা তার নিজস্ব ব্যাপার বলে কথা। জিনিস কেনার আগে দেখে নেওয়ারও সুযোগ নেই। একদিন শ্যামা মিয়া বাজারে জলপাই বিক্রি করছিলেন। রাশেদকে তার মা বাজারে পাঠায় জলপাই কিনতে, আচার বানাবে। সে এসে দেখে, শ্যামা মিয়া ছাড়া আর কেউই জলপাই বিক্রি করছে না।

'চাচা, জলপাই কত টাকা কেজি?'

'বিশ টাকা।'

'ভালো হবে তো?'

শ্যামা মিয়া রাশেদের এমন কথায় ক্ষেপে উঠলেন। এবার কিশোর তুমি যাবে কোথায়!

'ভালো হবে না মানে কি? হা! মশকরা কর?'

তারপর ঘটে বিদ্ঘুটে এক কান্ড-কারখানা। শ্যাম মিয়া তো রাশেদের কাছে কোনো মতেই জলপাই বিক্রি করবে না।

'আমি তোমার কাছে জলপাই বিক্রি করব না, যাও হে কিশোর নবাব।'

রাশেদ দুষ্টু স্বভাবের। বাজার হওয়ায় মেজাজটা সামাল দেয় তখন। কিন্তু ওকে যে জলপাই কিনতে হবে। নচেৎ মা বকা দেবে। মায়ের বিষয়টা মাথায় রেখে শ্যামা মিয়ার ওখান থেকে বিদায় নেয় তৎক্ষণাৎ। এর বিহিত পরে হবে।

ছেলেকে খালি হাতে দেখে মা জিজ্ঞেস করেন, 'কি রে তোকে পাঠালাম জলপাই কিনতে, তুই কি না খালি হাতে ফিরলি?'

'আম্মু, বাজারে জলপাইয়ের কাটতি খুব। জলপাই নেই।'

'এখন কি উপায়?'

'তুমি কিচ্ছুটি চিন্তা করো না। আমি রাতেই জলপাইয়ের ব্যবস্থা করব।'

'রাতে ব্যবস্থা করবি? মানে কি? কারও গাছে লুট দিবি নাকি? তোর কথাবার্তা সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না রে রাশেদ।'

রাশেদ মায়ের কথায় জবাব না দিয়ে মসজিদের মাঠে খেলতে ছুটে যায়। ওখানে নিশ্চিত খেলছে ওর বন্ধু ইমন, সজলসহ আরও অনেকে।

সত্যই সবাই খেলছে। রাশেদ গিয়ে হাজির হলো। ওরা খেলতে খেলতে রাশেদকে দেখে থেমে গেল। রাশেদ কিছু একটা বলবে, এটি ইমনের বুঝতে বাকি থাকে না।

'কি রে, কিছু হয়েছে নাকি? তোকে দেখে মনে হচ্ছে, গভীর চিন্তায় মগ্ন।'

'হয়েছে তো অনেক কিছুই। চিন্তা করছি না। মাথায় পস্ন্যান আটছি। কি করা যায়!'

ওপাশ থেকে বল ছুড়ে মারতে মারতে সজল বলে ওঠে, 'কিসের পস্ন্যান, বলবি তো আগে?'

রাশেদ সবাইকে নিয়ে মাঠের এক কোণে বসে পড়ে।

'বস সবাই। বলছি। আজকে বাজারে ওই পূর্বপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত শ্যামা মিলিটারি আমাকে বাজারের মধ্যে অপমান অপদস্ত করেছে। আমার কাছে জলপাই বিক্রি করেনি।'

'তুই কি এমন করেছিলি? (ইমন)

'আরে তেমন কিছু না। শুধু বলেছি, জলপাই ভালো হবে তো। যাহ্‌ বাবা তিনি তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন।'

'আমি যদ্দুর জানি তার একটি গাছের জলপাইও ভালো না। সব পানসেটে। এমন অভিযোগ তো সবাই করে।'

'আচ্ছা, তাই বুঝি। তাহলে এসব কারচুপি করে বেচতেই আমার সাথে এমন আচরণ। তাহলে তো পস্ন্যান সাকসেস করলে, জলপাই এক্সপেরিমেন্টটাও হয়ে যাবে দেখছি।'

'পস্ন্যানটা কি বলবি তো?' (সজল)

'শোন, তাহলে.. .'

সবাই রাশেদের পস্ন্যানে রাজি হয়ে গেল। দুষ্টুদের যা কাজ। তাতে দুষ্টুরা রাজি না হলে কি আর চলে।

রাত তখন বারোটা বাজে। পস্ন্যান অনুযায়ী রাশেদ, ইমন, সজল ও মিল্টন আবুল শেখের ভিটেয় এসে হাজির হয়। কারও হাতে টর্চ লাইট, কারও হাতে ব্যাগ, কারও হাতে মুখোশ। বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়। ওদের মিশন, শ্যামা মিয়ার সব গাছের জলপাই ভ্যানিশ করা।

রাস্তার ধারে শ্যামা মিয়ার বাড়ি। বাজার থেকে অনেকেই রাতে ফেরে। তাই রাত আরও গভীর হওয়া দরকার। কিশোর দল তাই অপেক্ষা করতে থাকে কখন রাত ২টা বাজবে।

২টা বাজতেই শুরু হয়ে যায় 'মিশন জলপাই লুট'। রাশেদ গাছে উঠতে পাকা। মুখে মুখোশ বেঁধে, বাম হাতে টর্চ নিয়ে শ্যামা মিয়ার রাস্তার ধারের বড় জলপাই গাছটায় এক লাফে উঠে পড়ে। পিছনে থাকে ইমন ব্যাগ ধরে। সজল থাকে রাস্তার পাশে। কেউ আসছে কিনা, এসব দেখে।

ইতোমধ্যে নিঃশব্দে জলপাই লুট শুরু হয়ে যায়। বাদুড়ের মতো জলপাইগুলো খুঁজে খুঁজে রাশেদ পাড়ে।

এভাবেই প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শ্যামা মিয়ার জলপাই গাছ সাবাড় করে দেয়। দুঃসাহসিক কিশোর দল একবারও ভাবছে না এর পরিণতি কেমন হতে পারে। ওরা যে মানুষের চরম অন্যায় করছে, এটাও মাথায় আসছে না। মাথায় না আসারই কথা। বয়সটা যে এমনই।

জলপাই লুট শেষ। কিন্তু এত জলপাই কি করবে ওরা? প্রায় বস্তাটা ভর্তি করে ফেলেছে। এত জলপাই বাড়িতে নিলে মা-বাবা বুঝতে পারবে। নির্ঘাত পিটুনি।

জলপাই পাড়া শেষ করে ওরা আবার আবুল শেখের পুকুর পাড়ে চলে আসে। এবার রাশেদ তিনজনকে কাছে টেনে নিয়ে বলে এই সব জলপাই পুকুরে ডুবাতে হবে। এতে ইমন আপত্তি জানায়।

'এত জলপাই জলে ফেলে দেওয়া যাবে না। আমি বাড়ি নিয়ে যাব।'

'আরে বোকা, তুই কি ফাঁসাতে চাস? জানিস তো এ লোক মিলিটারির চাকরি করত। থানায় ঢুকিয়ে ছাড়বে আমাদের।'

সজল হাসতে হাসতে বলে ওঠে, 'যে কিপটার কিপটা, টাকা খরচ করে সে করবে মামলা? আমার তো মনে হয় কপাল চাপড়ে মারা যাবে।'

রাশেদ মুখটা আটকে ধরে।

'এত জোরে কথা বলিস না।'

সবাই চুপ হয়ে যায়।

মিল্টন বলে, 'রাত অনেক শেষ হয়ে আসছে। কি করবি তাড়াতাড়ি কর।'

'সবাই কেজি খানেক জলপাই নিতে পারিস। টেস্ট করার জন্য।'

সবাই কেজিখানেক জলপাই নিয়ে বাকিটা বস্তাসহ আবুল শেখের পুকুরে মারল ছুড়ে। ধপাস ধপাস শব্দ হতেই সবাই দৌড়ে পালায়।

সকাল হতে না হতেই পূর্বপাড়ায় হইচইয়ের আওয়াজ মেলে। চারমূর্তির এখনো ঘুম ভাঙেনি। এদিকে শ্যামা মিয়া মাথায় হাত দিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন।

'হায় আলস্নাহ, আমার এত বড় সর্বনাশ কে করল। একটি জলপাইও গাছে নেই।'

এলাকার মানুষজন সান্ত্বনা দিল। তবে বেশির ভাগ মানুষের মন্তব্য, 'কিপটে, বদমেজাজি মানুষের অবস্থা এরকমই হয়।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<83740 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1