শখটা যে পিয়াসের মাথায় নতুন করে চেপে বসেছে তেমন নয়। বহুদিন ধরেই মনের ভেতর বাসা বেঁধে বসে আছে। এতদিন তেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। তবে মামাবাড়ি গিয়ে পৌঁছুতেই শখটা আবারও বেশ জোরেশোরেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
আম্মু একটা কাজের জন্য মামাবাড়ি পাঠিয়েছিলেন। মামাবাড়ি গিয়ে পিয়াসের অবাক হওয়ার দশা। এর আগে মামাবাড়ি এসে কখনো এমন দৃশ্য সে দেখেনি। উঠোনের একপাশে সারি সারি সাজানো কবুতরের খোপ। একটি খোপের ওপর আরেকটি খোপ এমনভাবে সাজানো যেন বহুতলবিশিষ্ট কোনো ভবন। পিয়াস অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। খোপভতির্ ধবধবে সাদা রঙের কবুতরগুলো অবাক বিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কবুতরগুলোর কুচকুচে কালো রঙের চোখগুলোতে যেন রাজ্যের মায়া এসে ভর করেছে।
‘ইশ কী সুন্দর দেখতে! আমার নিজের যদি কবুতর থাকতো!’
অস্ফুট স্বরে কথাগুলো বলল পিয়াস। তবে অনুচ্চৈঃস্বরে বললে কী হবে, ছোটমামা ঠিকই কথাগুলো শুনে ফেললেন। কখন যে ছোটমামা এসে পিছনে দঁাড়িয়েছেন তার কিছুই টের পায়নি ও। আসলে কবুতর দেখে বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গিয়েছিল। জগতের অন্য কোনোকিছুর দিকেই বিন্দুমাত্র খেয়াল ওর ছিল না।
‘কখন এলি পিয়াস? আর অমন করে কী দেখছিলি?’
মামার কথা শুনে পেছন ফিরে তাকাল পিয়াস।
‘এই তো মামা, কিছুক্ষণ হলো এসেছি। আচ্ছা মামা, কবুতর পোষা শুরু করলে কবে থেকে? এর আগে তো কখনো দেখিনি!’
‘এই তো কয়েকমাস হলো এনেছি। এরমাঝে তো তুই আর আসিসনি। দেখবি কেমন করে!’
মামা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন।
‘সবগুলোই কি কিনেছো?’
‘না রে পাগল! এতগুলো কবুতর একসঙ্গে কেনার টাকা পাবো কোথায়! কিছু কিনেছি আর কিছু তাদের দেয়া বাচ্চা।’
‘এরা খুব তাড়াতাড়ি বাচ্চা দেয় বুঝি?’
‘নিয়মিত বাচ্চা হলে খোপভতির্ হতে খুব বেশিদিন সময় লাগে না। এবার চল, তোর নানির সঙ্গে দেখা করবি।’
মামার কথা শুনে পিয়াস বেশ লজ্জা পেয়ে গেল। নানুবাড়ি এসে প্রথমেই ও নানির সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। আজই এর ব্যতিক্রম হয়ে গেল। আসলে এতগুলো কবুতর একসঙ্গে দেখে ওর আর কোনোকিছু মনেই ছিল না!
পিয়াসের নানু বেশ কয়েকবছর হলো মারা গিয়েছেন। নানু পিয়াসকে প্রচÐ রকমের ভালোবাসতেন। পিয়াসের মনে আছে, এ বাড়িতে এসে পৌঁছুলে নানা প্রথমেই ওকে কোলে তুলে নেয়ার পরিবতের্ ঘাড়ে তুলে নিতেন। নানুর ঘাড়ে চড়তে কী যে ভালো লাগত! পিয়াস নানুর ঘাড়ে চড়ে কত জায়গায় যে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। নানুর জন্য এখনো ওর খুব কষ্ট লাগে।
নানির কাছে গিয়ে পিয়াস দেখল তিনি তেলের পিঠা ভাজছেন। এই পিঠা ওর ভীষণ প্রিয়। পিয়াসের কেন যেন মনে হয় পিঠাটা তার নানিই সবচেয়ে ভালো বানাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জগতে তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। কিন্তু নানি এমন সময় পিঠা বানাতে বসেছেন কেন! তাহলে তার আসার খবর কি আগেই পৌঁছে গিয়েছে! পিয়াস নানিকে প্রশ্ন না করে পারল না।
‘আচ্ছা নানি, আমি যে এখন আসব তা আপনি কীভাবে বুঝলেন?’
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নানি মুচকি মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, ‘এতদিন পর নাতি আসবে আর নানি জানতে পারবে না তা কি হয়!’
নানির কথা শুনে মামাও হাসতে লাগলেন। পিয়াস সহসা রহস্য ধরতে পারল না।
‘মামা, তুমিই বলো না, আমার আসার খবর কীভাবে পেলে?’
‘তুমি বাড়ি থেকে রওনা হলেই তোমার আম্মু ফোন করেছিল। এবার বুঝেছো?’
মামা নয়, জবাবটা নানিই দিলেন।
পিয়াস এবার হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই সদ্য তেলে ভাজা পিঠা খেতে লাগল। আহ! কী স্বাদ! এমন পিঠা বানাতে পারে জগতে সাধ্য আছে কার!
পিয়াস ঠিক বুঝে উঠতে পারল না মামাকে কথাটা কীভাবে বলবে। কবুতরগুলো তো মামার নিজেরও খুব প্রিয়! যদি তিনি দিতে সম্মত না হন! নানারকম প্রশ্ন জড় হয়ে এসে ওর বুকটা ভেঙে দিতে চাইল। সহসা মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এদিকে যাবার সময়ও হয়ে এলো।
পিয়াসের মন খারাপ দেখে মামা এগিয়ে এলেন। তারপর মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে প্রশ্ন করলেন, ‘কী রে! মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?’
পিয়াস মামার দিকে চোখ তুলে তাকাল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। মামা বললেন, ‘এদিকে আয়। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’
পিয়াস কিছুটা অবাক হলো। তারপর মামার পিছু পিছু হঁাটা শুরু করল।
‘কী সুন্দর দেখতে!’
সাদা ধবধবে চারটা কবুতর দেখতে পেয়ে ওর বুক চিরে বিস্ময়বোধক কথাগুলো বেরিয়ে এলো।
মামা বললেন, ‘এগুলো তোর জন্য। বাড়ি নিয়ে গিয়ে পুষবি।’
‘সত্যি বলছো তুমি!’
পিয়াসের বিশ্বাস হতে চায় না।
‘হ্যঁা। তখন পিছন থেকে তোর কথাগুলো আমি শুনেছিলাম। আর তোর যে কবুতর পোষার খুব শখ তা তো আমি জানি।’
মামা হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন।
কবুতর পেয়ে খুশি হওয়ার পাশাপাশি একটা আশঙ্কাও পিয়াসের মনে এসে ভর করল। মামাকে সেটা ও জানিয়েও দিল।
‘আমার তো কোনো খোপ নেই। এদের নিয়ে রাখবো কোথায়?’
ইতোমধ্যে কবুতরগুলোকে ও আপন ভাবতে শুরু করেছে।
‘সে চিন্তাও আমি করে রেখেছি। আমার একটা বাড়তি খোপ পড়ে আছে। ওটা তোকে দিয়ে দেবো।’
কী বলে যে মামাকে ধন্যবাদ দেবে সহসা ও কোনো শব্দ খুঁজে পেল না।
‘ছেলের পড়াশোনা এবার লাটে উঠবে। তুমি এগুলো ফেরত দিয়ে আসতে বলো।’
কবুতর নিয়ে বাড়ি পেঁৗছুতেই আম্মু রেগে গেলেন। আব্বু অবশ্য তেমন কিছু বলছেন না।
‘তোমাকে এগুলো কে আনতে বলেছে? তোমার কবুতর পোষা লাগবে না।’
আম্মুর কথা শুনে পিয়াসের কান্না পেয়ে গেল।
তার এতদিনের শখ আজ পূরণ হতে গিয়েও বুঝি হলো না!
তবে বরাবরের মতো এবারও আব্বু উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন।
‘কী শুরু করলে তুমি! ছেলেটির বহুদিনের শখ আজ পূরণ হবে। তুমি ওর সাথে এমন করছো কেন? ছোট বলে ওর কোনো শখ-আহ্লাদ থাকতে পারে না?’
আব্বুর কথা শুনে আম্মু কিছুটা নরম হলেন। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে আমাকে কথা দিতে হবে, পড়াশোনার কোনো ক্ষতি করা যাবে না। ঠিক আছে?’
পিয়াস ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল।
আব্বু বললেন, ‘এমন শখ বাচ্চাদের পড়াশোনাতে আরও বেশি মনোযোগী করে তোলে। তুমি দেখবে, পিয়াস এবার আরও ভালো করবে।’
‘তাই যেন হয়।’
আম্মু মন্তব্য করলেন।
বাবার সঙ্গে পিয়াস তখনই খোপ স্থাপন করতে লেগে গেল। এ ক্ষেত্রে বাড়ির সবচেয়ে নিরিবিলি স্থান নিবার্চন করা হলো। খোপ স্থাপন শেষে খোপের চারিদিক জাল দিয়ে ঘিরে দেয়া হলো যাতে হিংস্র কোনো প্রাণী আক্রমণ করে ওদের ধরে নিয়ে যেতে না পারে।
সব কাজ শেষ হতে বাচ্চাগুলোকে খোপের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হলো। ছোট ছোট চোখ মেলে ওরা পিয়াসের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাব দেখে মনে হলো পিয়াস যেন ওদের কতদিনের চেনা। তখনই ওদের মধ্যে একটা ভাব হয়ে গেল। নতুন মালিকের সঙ্গে ভাব স্থাপন করতে পেয়ে কবুতরগুলোও বেজায় খুশি হলো। বহুদিন পর শখটা পূরণ হওয়াতে পিয়াসের খুশির অন্ত রইল না।