শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
শিশুদের ডেঙ্গু

কীভাবে বুঝবেন, বাবা-মা ও চিকিৎসকরা কী করবেন?

বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের একটি বড় অংশই শিশু। শিশুরা সাধারণত তাদের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন বা সতর্ক না হওয়ার কারণে তাদের ওপর এই রোগের প্রভাব বড়দের চেয়ে আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় শিশুদের ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় মা-বাবা বা অভিভাবকদেরই সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুনধারা
  ০৭ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের একটি বড় অংশই শিশু। শিশুরা সাধারণত তাদের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন বা সতর্ক না হওয়ার কারণে তাদের ওপর এই রোগের প্রভাব বড়দের চাইতে আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায়, শিশুদের ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় মা-বাবা বা অভিভাবকদেরই সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকার ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে গত এক সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে সামিয়া রহমানের দেড় বছরের শিশু।

প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন মৌসুমি জ্বর হয়েছে, কেননা, ডেঙ্গু রোগের যেসব উপসর্গের কথা সচরাচর বলা হয়ে থাকে, তেমন কোনো লক্ষণ তিনি তার বাচ্চার মধ্যে দেখতে পাননি। কিন্তু ৩-৪ দিনেও জ্বর না কমায় পরে তিনি তার বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানে চিকিৎসকের পরামর্শে মেডিকেল পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।

শুরুতে তিনি বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও তার ও চিকিৎসকদের পরিচর্যায় এখন সুস্থ হওয়ার পথে শিশুটি। এমন অবস্থায় মিসেস রহমান ডেঙ্গু রোগ প্রতিকারের পরিবর্তে প্রতিরোধের দিকে জোর দেয়ার তাগিদ দেন। ডেঙ্গু প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধের দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

শিশুদের ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে করণীয়

শিশুদের ডেঙ্গু রোগ হওয়া থেকে বাঁচাতে শুরুতেই এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যেন তাদের মশা না কামড়ায়। এ ব্যাপারে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবু তালহা কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন।

১. প্রথম পরামর্শ হলো, এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত গৃহস্থালির পরিষ্কার স্থির পানিতে জন্মে থাকে- যেমন ফুলের টব, গাড়ির টায়ার বা ডাবের খোলে বৃষ্টির জমা পানি ইত্যাদি। তাই এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিতে পারে এমন স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

২. শিশুদের দিনে ও রাতে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক শিশুকে সার্বক্ষণিক মশারির ভেতরে রাখা জরুরি। এ ছাড়া হাসপাতালে কোনো শিশু যদি অন্য রোগের চিকিৎসাও নিতে আসে, তাহলে তাকেও মশারির ভেতরে রাখতে হবে। কেননা, ডেঙ্গু আক্রান্ত কাউকে এডিস মশা কামড় দিয়ে পরে কোনো শিশুকে কামড়ালে তার শরীরেও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।

৩. শিশুরা যে সময়টায় বাইরে ছুটোছুটি বা খেলাধুলা করে, সে সময়টায় তাদের শরীরে মসকুইটো রেপেলেন্ট অর্থাৎ মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে এবং কয়েক ঘণ্টা অন্তর পুনরায় এই রেপেলেন্ট প্রয়োগ করতে হবে।

৪. শিশু যদি অনেক ছোট হয় বা তাদের শরীরে ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে তাদের হাতে মসকুইটো রেপেলেন্ট বেল্ট বা পোশাকে পঁ্যাচ ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. মশার কামড় প্রতিরোধে আরেকটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হতে পারে- শিশুদের ফুল হাতা ও ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখা।

৬. তবে মশা প্রতিরোধ অ্যারোসল, মশার কয়েল বা ফাস্ট কার্ড শিশু থেকে শুরু করে সবার জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। এর পরিবর্তে মসকুইটো কিলার বাল্ব, ইলেকট্রিক কিলার ল্যাম্প, ইলেকট্রিক কয়েল, মসকুইটো কিলার ব্যাট, মসকুইটো রেপেলার মেশিন, মসকুইটো কিলার ট্র্যাপ ইত্যাদির সাহায্যে নিরাপদে মশা ঠেকানো যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে এই সরঞ্জামগুলো যেন শিশুর নাগালের বাইরে থাকে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন মিস্টার তালহা।

৭. যদি শিশুর মা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে সেই ভাইরাসের কোনো প্রভাব মায়ের বুকের দুধে পড়ে না। কাজেই আক্রান্ত অবস্থায় মা তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।

চারিদিকে যেহেতু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তাই এই সময়ে শিশুর জ্বর এলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন বলে জানান চিকিৎসকরা।

শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

সাধারণত ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা কামড় দেয়ার পর সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে এবং এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।

তবে শিশুর জ্বর মানেই যে সেটা ডেঙ্গু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। অবশ্য চারদিকে যেহেতু ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, তাই এ সময়ে শিশুর জ্বর এলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. আবু তালহা।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ আগের চাইতে এখন অনেকটাই বদলে গেছে।

ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক কিছু লক্ষণের কথা তুলে ধরেন এই চিকিৎসক-

১. ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এই রোগে জ্বরের তাপমাত্রা সাধারণত ১০১, ১০২ ও ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে। তবে ডেঙ্গু হলেই যে তীব্র জ্বর থাকবে, এমনটা নয়। জ্বর ১০০ এর নিচে থাকা অবস্থাতেও অনেক শিশুর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। মূলত ডেঙ্গুর এই জ্বরকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন ডা. আবু তালহা।

প্রথমত, ফেব্রাইল ফেজ- শিশুর ডেঙ্গু জ্বর ২ থেকে ৩ দিন বা তার চাইতে বেশি স্থায়ী হলে।

দ্বিতীয়ত, অ্যাফেব্রাইল ফেজ- এ সময় বাচ্চার আর জ্বর থাকে না। সাধারণত এর সময়কাল থাকে ২-৩ দিন।

তৃতীয়ত, কনভালিসেন্ট ফেজ- যখন শিশুর শরীরের্ যাশ দেখা যায়। এর সময়কাল থাকে ৪-৫ দিন। মিস্টার তালহা অ্যাফেব্রাইল ফেজে অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে বলেছেন। কেননা, এই ক্রিটিক্যাল ফেজে শিশুর জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর রোগটি সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারে। এই সময়ে রোগীর শরীরে পস্নাজমা লিকেজ হয়ে বিভিন্ন অংশে জমা হয়ে থাকে। এ কারণে রোগীর পেট ফুলে যায় বা রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দেয় এবং যার কারণে শিশুদের শক সিনড্রোম হতে পারে। তাই জ্বর সেরে যাওয়ার দুই থেকে তিন দিন শিশুকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. আবু তালহা। ডেঙ্গু হলে শিশু স্বাভাবিক চঞ্চলতা ভুলে প্রচুর কান্নাকাটি করে থাকে।

২. শিশুর মধ্যে স্বাভাবিক চঞ্চলতা থাকে না- শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং ঝিমাতে থাকে। অযথা কান্নাকাটি করে।

৩. শিশুর মধ্যে প্রচন্ড ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, কিছুই খেতে চায় না। বমি বমি ভাব হয় বা কিছু খেলেই বমি করে দেয়।

৪. ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে শিশুর প্রস্রাব না হওয়া ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি।

৫. শরীরে লালচে র?্যাশ দেখা দিতে পারে।

৬. মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, পেটে ব্যথা হতে পারে।

৭. হতে পারে পানি শূন্যতা এবং পাতলা পায়খানাও।

৮. চোখ লাল হয়ে যাওয়া, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হওয়া। এটা মূলত অ্যাফেব্রাইল স্তরে বেশি হয়ে থাকে।

৯. পরিস্থিতি গুরুতর হলে অর্থাৎ ডেঙ্গুর কারণে শিশুর শকে যাওয়ার অবস্থা হলে তার পেট ফুলে যেতে পারে বা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি। শিশুর ডেঙ্গু শনাক্ত হলে বারবার তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

শিশুদের ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা কেমন হয়ে থাকে-

মেডিকেল পরীক্ষায় যদি শিশুর ডেঙ্গু ধরা পড়ে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ডেঙ্গু হলেই যে শিশুকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে বিষয়টা এমন নয়।

ডা. তালহা বলছেন, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে তাহলে বাড়িতে রেখে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

শিশুর মধ্যে যদি বিপদ চিহ্ন দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকরাই তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন।

শিশুর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকরা সাধারণত কয়েক ধরনের রক্তের পরীক্ষা দিয়ে থাকেন- এগুলো হলো- কমপিস্নট বস্নাড কাউন্ট (সিবিসি), এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন, এফজিপিটি এবং এফজিওটি।

এসব পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে প্রতিদিন একবার সিবিসি পরীক্ষার মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নতি নাকি অবনতি হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।

শিশুর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিচের কয়েকটি উপায়ে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে-

১. শিশুর শরীরে যদি জ্বর থাকে, তাহলে পানি দিয়ে শরীর বারবার স্পঞ্জ করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

২. শিশুকে পানি ও মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি বেশি পরিমাণে তরল খাবার, বিশেষ করে খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের শরবত, সু্যপ ইত্যাদি খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

৩. ডেঙ্গুর ধরন বুঝে চিকিৎসকরা শিশুদের প্যারাসিটামল অথবা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে থাকেন।

৪. রক্তচাপ অস্বাভাবিক থাকলে স্যালাইন দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। শিশুর শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য মেডিকেল পরীক্ষা দেয়া হয়।

৫. যদি শরীরে পস্নাজমা লিকেজের কারণে ফ্লুয়িড জমতে থাকে, তাহলে স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরে অ্যালবোমিন প্রয়োগ করা হয়। রোগী শক সিনড্রোমে চলে গেলে এই চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে।

৬. এ ছাড়া শিশুর শরীরে রক্তক্ষরণ শুরু হলে রক্ত দেয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।

৭. শিশুর রক্তে পেস্নটলেট যদি ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ এর নিচে চলে আসে বা রক্তরক্ষণ হয়, তাহলে শিশুকে আইসিইউতে রেখে পেস্নটলেট দেয়ার প্রয়োজন হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত চারজন ডোনার থেকে এই পেস্নটলেট সংগ্রহ করা হয়। তাই শিশুর শারীরিক পরিস্থিতি গুরুতর হলে অন্তত কয়েকজন রক্তদাতাকে প্রস্তুত রাখতে হবে। একজন ডোনার থেকে পেস্নটলেট সংগ্রহ করা গেলেও তার খরচ কয়েক গুণ বেশি পড়ে যায়।

৮. রোগীর পরিস্থিতি গুরুতর হলে রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি বুকের এক্স-রে, পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি, ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এ ছাড়া প্রস্রাব না হলে ক্রিয়াটিনিনের মাত্রার পরিমাপ করা হয়। রোগীর লক্ষণের ওপর এই পরীক্ষাগুলো নির্ভর করে বলে জানান মিস্টার তালহা।

য় সুস্বাস্থ্য ডেস্ক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<61550 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1