বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বোধোদয়

কবির কাঞ্চন
  ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

গভীর রাত। চারদিক জনশূন্য। একাকী পথ চলছে বিশ্বজিত চৌধুরী। হালকা বাতাস বইছে। তবুও খুব ঘামছে সে। কিছুক্ষণ পরপর পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালসহ পুরো মুখমÐল মুছছে।

বিশ্বজিত মিশ্র ভাবনার মধ্য দিয়ে বাসার দিকে ছুটছে। বারবার মায়ের মুখটা চোখের সামনে আসছে। মা যেন আকুতি ভরা ১১ ডাকছেন!

- বিশ্বজিত, আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে যাসনে, বাবা। প্র?য়োজনে না খাইয়ে রাখিস। তবু তোকে দেখবার সুযোগ থেকে আমায় বঞ্চিত করিসনে। তোর বৌর সঙ্গে সুন্দর আচরণ করব। যা করতে বলবে তাই করব। তোদের ছাড়া আমি বঁাচতে পারব না। আমার বুকের মানিক, আমাকে রেখে যাসনে।

মায়ের ডাকে বিশ্বজিত ‘মা! মা!’ বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে যায়।

বেশকিছু সময় মাথা নিচু করে থাকে। মায়ের মুখখানা মুহূতের্ অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার পথচলা শুরু করে। খুব বড় বড় পায়ে বাসার দিকে ছুটতে লাগল।

কিছুপথ চলার পর হঠাৎ বৌর মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে।

বিশ্বজিত চৌধুরী একটি বেসরকারি ফ্যাক্টরির সামান্য বেতনের অফিস সহকারী ছিলেন। প্রমোশন পেয়ে পেয়ে এখন অফিসের প্রধান হিসাবরক্ষক। নিজের আয় যত বেড়েছে বৌর প্রতি তার নিভর্রশীলতা ততই বেড়েছে। সেই সঙ্গে মায়ের প্রতি উদাসীনতাও বেড়েছে। ইদানীং অফিসেও কাজের চাপ বেড়েছে।

প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের আগমনের হাওয়া লেগেছে। দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে বেশ রাত করে বাসায় ফিরছে। মায়ের বিরুদ্ধে বৌর নিত্যকার অভিযোগ এড়িয়ে চলেছে।

এ নিয়ে সংসারে রীতিমত অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। রোজ অফিস থেকে ফিরে বৌর কালোমুখ দেখতে হয় তাকে। মায়ের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ শুনে সে বলেছেÑ

শোন, তুমি যার বিরুদ্ধে কথাগুলো বলছ তিনি আমার মা। আজকের আমি কে? যিনি তিলেতিলে এতটুকুতে এনেছেন। তাকে নিয়ে তুমি কোনো বিরূপ মন্তব্য না করলেই আমি খুশি হই। প্লিজ আমাকে আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে বল না। আমাদের খোকনও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ও আমাদের থেকে কি শিক্ষা নেবে!

- তোমার সব কথা আমি বুঝেছি। কিন্তু আমার একটাই কথা। তোমার মা যদি এ বাসায় থাকে তবে আমি আমার বাবার বাসায় চলে যাব। আমাকে রাখতে চাইলে তোমার মাকে অন্য কোথাও রেখে আস। কোনো আপদ আমি এ বাসায় রাখব না।

- তাহলে আমার মা তোমার কাছে আপদ হয়ে গেছে! কয়দিন পরে তো তোমার কাছে আমিও আপদ হয়ে যাব।

- এত প্যঁাচানোর দরকার নেই। তুমি অন্যত্র তার থাকার ব্যবস্থা করে দাও।

- আর কোথায় থাকবে? আমিই তো তার একমাত্র সন্তান। বাবাকে হারিয়ে আমাদের নিয়ে বেঁচে আছেন।

- আমি বলি কি! আজকাল বুড়োবুড়িরা বৃদ্ধাশ্রমেই ভালো থাকেন।

তাদের সব শখ আহ্লাদ তো পূরণ হয়েছে। এখন বৃদ্ধাশ্রমে থেকে নিরিবিলি ঈশ্বরকে ডাকুক।

স্ত্রীর এমন কথায় বিশ্বজিতের

গলা শুকিয়ে আসে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে গেস্ট রুমের সোফার ওপর শুয়ে নীরবে কঁাদতে থাকে। পরদিন উপোস অফিসে চলে আসে। মন খারাপ করে চেয়ারে বসে থাকে সে। কোনোভাবেই কাজে মন বসছে না তার। সারাক্ষণ স্ত্রীর কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ও কি করে এমন নিচ হতে পারল! ওরও তো বাবা-মা আছেন। ইদানীং কথায় কথায় খোকনকেও কারণে-অকারণে মারধর করছে। কিছু বললে আমার সঙ্গেও দুবর্্যবহার করে বসে। লোকসমাজের ভয়ে কিছু করতেও পারি না। সংসারে অশান্তি যেভাবে শুরু হয়েছে এভাবে চলতে থাকলে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ তো নষ্ট হয়ে যাবে। না, আর এভাবে চলতে দেয়া যায় না। আজই এর একটা বিহিত করতে হবে।

অফিস শেষে বাসায় ফিরে বিশ্বজিত। স্ত্রী দৌড়ে এসে বলল,

- এতো দেরি করে এলে যে? কি একটা ব্যবস্থা করে এসেছো?

- কিসের ব্যবস্থা?

- তোমার মাকে অন্য কোথাও রাখবার ব্যবস্থার কথা বলছি।

- আমার মা তোমার কি?

- শাশুড়ি।

- মা তোমার কি এমন ক্ষতি করেছে যে প্রতিদিন অভিযোগ কর।

- বুড়ো মানুষ। নিত্য অসুখ-বিসুখে পড়ে থাকে। আমার ছেলেকে বারণ করলেও তার কাছে ছুটে যায়। যদি ওরও অসুখ হয়?

- তুমি তো ছেলের বৌ হিসেবে যা করা দরকার তা করো না। যা ওই কাজের মেয়েই করে থাকে।

- তার পিছে যা ব্যয় করো তা অপচয় ছাড়া কিছু না। এই সংসারে তিনি একটা অচল পয়সা।

বিশ্বজিত খুব উত্তেজিত হয়ে বৌকে গালাগাল করতে থাকে। বৌও কোনো অংশে কম যায় না। মুখে মুখে তকর্ শুরু করে।

বিশ্বজিত নিজের রাগকে সংবরণ করে বলল,

-প্লিজ, আস্তে কথা বল। মা শুনতে পারেন। তা ছাড়া পাশের বাসার লোকজনে শুনলে ছিঃ! ছিঃ! করবে।

দেখি কী করা যায়!

এরপর কেউ কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ে।

পরদিন অফিস শেষে বিশ্বজিত সোজা চলে যায় ঢাকাস্থ একটি বৃদ্ধাশ্রমে। মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার সব বন্দোবস্ত করে বাসার পথে রওনা দেয়। মোবাইলটা অবিরাম বেজেই চলেছে। কিন্তু বিশ্বজিতের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। আজ এক ঘোরের মধ্যে কাটছে তার সময়। আপ্রাণ বাসার পানে ছুটছে। কিন্তু তবুও পথ যেন শেষ হয় না। জীবনের সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজটি আজ তাকে করতে হয়েছে। বিশ্বজিত বারবার তার হাতের ডকুমেন্টের দিকে তাকাচ্ছে। দুচোখে অঝরে জল ঝরছে।

রাত সাড়ে বারোটা। বিশ্বজিত ঘরে পা ফেলতেই ভয় পেয়ে দ্রæত বেডরুমে প্রবেশ করে। স্ত্রীকে পাগলের মতো হায়হুতাশ করতে দেখে ছেলের কাছে গিয়ে বসে। খোকনের মা খোকনকে জড়িয়ে ধরে কঁাদছে। খোকন তখনও বিছানায় দাপাদাপি করছে। যেন ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রীতিমত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। খোকনের এমন অবস্থায় ওর বাবা-মা দুজনেই ভয়ে কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। পাশের রুম থেকে খোকনের দাদি কঁাপতে কঁাপতে খোকনের কাছে আসে। তিনি কঁাদো গলায় বললেন,

আমার দাদুর কি হয়েছে?

বিশ্বজিত অস্থির অবস্থায় বলল,

- হঠাৎ করে খোকনের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। দেখো নাÑ মা, আমার খোকন কেমন যেন করছে!

খোকনের দাদি এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বললেন,

- বাবা, আগে খোকনকে বাইরে বারান্দায় নিয়ে যা। আর বৌমা কয়েল জ্বলছে কোথায়? তাড়াতাড়ি কয়েলটা নিভিয়ে দাও।

খোকনের মা দ্রæত জ্বলন্ত কয়েলটা নিভিয়ে দিয়ে খোকনের কাছে ছুটে যায়। ততক্ষণে খোকন একটু একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

খোকন দাদিকে শক্ত করে ধরে রাখে।

পাশ থেকে খোকনের মা স্বামীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

- তোমার হাতে ওটা কি?

বিশ্বজিত স্ত্রীর হাত ধরে আবার বেডরুমের নিয়ে এসে

হতাশার সুরে বলল,

- দ্যাখো, এতদিনে তোমার মনোবাসনা পূণর্ হতে যাচ্ছে। অন্তত আজকের দিনের জন্য হলেও আমার মায়ের সঙ্গে একটু সুন্দর আচরণ কর। কাল সকাল হলেই আমি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাব।

এই কথা বলে বিশ্বজিত নিঃশব্দে কঁাদতে লাগল। খোকনের মা স্বামীর হাত থেকে বৃদ্ধাশ্রমের ডকুমেন্টস কেড়ে নিয়ে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল,

- আমি বড় পাপী। তোমার যত ইচ্ছে আমাকে শাস্তি দাও। আমি সোনা চিনতে ভুল করেছি। তোমার মা তো আমারও মা। মাকে শুধু শুধু ভুল বুঝেছি। আজ মা এ বাসায় না থাকলে তো আমাদের খোকন মরেই যেত। মাকে অন্যত্র রেখে আসতে বলে আমি তোমাকেও খুব টেনশনে রেখেছি। আমাদের পুরো সংসারে অশান্তি লেগেছিল। সব দোষ আমার। আমার মাকে তুমি কোথাও নিতে পারবে না।

এই বলে স্বামীর বুকে মাথা রেখে কঁাদতে শুরু করে খোকনের মা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<26443 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1