শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

কবির কাঞ্চন
  ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মিজান আলী রোজ সকালে পতাকা হাতে ঘর থেকে বের হন। সারাদিন এখানে-ওখানে হেঁটে হেঁটে লোকজনের কাছে পতাকা বিক্রি করেন। কপালে লাল-সবুজের পতাকা শোভিত কাপড় বেঁধে পুরো এলাকায় ঘুরে বেড়ান। পতাকার কাপড়টি কপালে জড়িয়ে পতাকা হাতে ঘরের বাইরে পা রাখতেই নিজের মনের ভিতরে পরিবতর্ন লক্ষ্য করেন তিনি। এসময় নিজেকে একজন খঁাটি দেশপ্রেমিক বলে মনে হয়। তার কাছে পতাকা বিক্রি করা অনন্য সম্মানের কাজ বলে মনে হয়। দেশের সবশ্রেণি পেশার মানুষের কাছে পতাকা তুলে দিতে পেরে তিনি আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন।

জাতীয় দিবস এলে মিজান আলীর খুব ভালো লাগে। সারাদিন পতাকা বিক্রিতে ব্যস্ত থাকেন। সববয়সী মানুষ তার কাছ থেকে পতাকা কিনে নেয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখলে পতাকা কিনতে তাদের বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে। ওদের হাতে পতাকা তুলে দিতে তার খুব ভালো লাগে।

আজ ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় বিজয় দিবস। মিজান আলী ফজরের নামাজ পড়ে প্রতি বছরের মতো করে এবারও বেশি করে পতাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। সকালের মৃদু বাতাস গায়ে লাগতেই খুব ঠাÐা অনুভব করেন। শিশির ভেজা সকালে সূযর্ উঠতে এখনো অনেক দেরি। দূর পথের কুয়াশা আস্তে আস্তে হারাতে শুরু করেছে। মিজান আলী একটি পতাকা গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তার পাশের বাড়ির দোতলা থেকে আওয়াজ আসে,

- এই পতাকাওয়ালা, এদিকে এসো। একখানা পতাকা দাও।

মিজান আলী পিছন ফিরে তাকান। যে লোকটি তাকে ডাক দিয়েছিলেন তার সঙ্গে ছোট্ট একটি ছেলে এগিয়ে আসে।

মিজান আলী সযতনে একটি মাঝারি মাপের বাংলাদেশের পতাকা লোকটির হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

‘স্যার, বিজয়ের এই শুভলগ্নে আপনাদের জানাই লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।’

পতাকা বিক্রেতার এমন আচরণে লোকটা খুশি হয়ে বললেন,

‘তোমাকেও লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।’

ততক্ষণে পাশ থেকে ছোট্ট ছেলেটি বলে উঠলো,

- আব্বু, আমার জন্য ছোট থেকে একটি পতাকা নাও।

লোকটি হাসতে হাসতে ছোট মাপের একটি পতাকাও কিনলেন। এরপর পতাকা বিক্রেতা আবার আপন গন্তব্যে চলতে লাগলেন।

সকাল সাড়ে সাতটা। মিজান আলী প্রধান সড়ক সংলগ্ন একটি স্কুলের সামনে হঠাৎ দঁাড়িয়ে গেলেন। স্কুলটির শিক্ষাথীর্রা স্কুলের মাঠে সারিবদ্ধভাবে দঁাড়িয়ে আছে। সম্মুখে দঁাড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের হাতে তাজা ফুল। মাঝের কয়েকজনের হাতে ছোট ছোট পতাকা। সবার কপালে পতাকা শোভিত কাপড় বঁাধা।

শিক্ষকদের কয়েকজন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন।

একটু পরে সবাই মিলে প্রভাতফেরির গান গেয়ে স্কুলের একমাত্র স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বাংলার সূযর্সন্তানদের স্মরণ করবে।

মুহূতের্ পতাকা বিক্রেতার মনের ভিতরে দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত হয়। হঠাৎ স্কুল গেটের দিকে তার চোখ পড়তেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।

স্কুল গেটের গ্রিলে একহাত দিয়ে ধরে আছে একটি ছেলে। ঘাড়ের ওপর অন্য হাত দিয়ে ধরে আছে একটি বড় আকারের থলে। দেখে মনে হচ্ছে ওখানে পরিত্যক্ত জিনিসপত্র আছে। ছেলেটির পোশাক-আশাক দেখে টোকাই বলেই মনে হচ্ছে।

পতাকা বিক্রেতার কাছাকাছি থাকায় স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটির চোখ থেকে অশ্রæ ঝরছে।

পতাকা বিক্রেতা মনে মনে ভাবতে লাগলেনÑ এমন বিজয়ের দিনে ছেলেটি কঁাদছে কেন? তবে কী মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওর কোনো স্বজন হারানোর স্মৃতি জড়িয়ে আছে!

পতাকা বিক্রেতা ছেলেটির কাছাকাছি এসে দঁাড়িয়ে বললেন,

- এই ছেলে, এমন বিজয়ের দিনে তুমি কঁাদছো কেন?

ছেলেটি ময়লাযুক্ত হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,

- না, এমনিতেই।

- এমনি করে কেউ কখনও কঁাদে না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমাকে খুলে বলো।

ছেলেটি আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল,

- ঐ যে আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের দেখছেন। ওরা কত আনন্দ করছে! ওরা পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে। দেশের জন্য। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক সম্মান বয়ে আনবে। একটু পর ওরা স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবে। আমি যদি ওদের মতো করে পারতাম!

- তুমি কেন পড়াশোনা করছো না? এখন তো তোমার পড়াশোনা করার বয়স।

ছেলেটি একটা দীঘর্শ্বাস ছেড়ে বলল,

- আমিও স্কুলে পড়ছিলাম। ওদের মতো আমারও সুন্দর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু—-।

- থামলে কেন? তারপর কী হয়েছিল বলো।

- তখন আমি চতুথর্ শ্রেণিতে পড়ছিলাম। প্রতিদিন আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাবা অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যেতেন।

১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ আমার স্কুলে বিজয় দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান হবে। সেদিন সব শিক্ষাথীর্র উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল। বাবার অফিসে উপস্থিতিও বাধ্যতামূলক ছিল। বাবা প্রতিদিনের মতো করে আমাকে নিয়ে চলতে লাগলেন। স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে বাবা অফিসের দিকে চলে গেলেন। প্রায় আধঘণ্টা সময় অতিবাহিত হলো। আমরা সারিবদ্ধভাবে দঁাড়িয়ে আছি। স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাবো এমন সময় একজন পিয়ন এসে আমার নাম ধরে ডাকলেন। ভিড়ের মধ্য থেকে আমি হাত তুললে আমাকে হেডমাস্টারের রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখি আমার দাদি মন খারাপ করে বসে আছেন। আমি দৌড়ে দাদির কোলে ছুটে আসি। তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর স্যারকে বলে দাদি আমাকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে হঁাটা শুরু করলেন। বাসায় এসে বাবার রক্তেমাখা নিথর শরীর দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ি। উপস্থিত সবার কাছ থেকে জানতে পারি, রাস্তা পার হওয়ার সময় পিছন থেকে তীব্রবেগে ছুটে আসা একটি বাস বাবার ওপর দিয়ে চলে যায়। বাবা জায়গায় মারা যান।

এই কথা বলে ছেলেটি হাউমাউ করে কঁাদতে লাগলো। পতাকা বিক্রেতা ছেলেটির দুঃখের কথা শুনে ব্যথিত হয়ে জল জল চোখে বললেন,

- তোমাদের সংসারে আর কে কে আছেন?

- আমার পৃথিবীতে আপন বলতে মা ছাড়া আর কেউ নেই। নিকট আত্মীয়রা কিছুদিন সান্ত¡না দিলেও এখন আর খেঁাজ নেন না। নিরুপায় হয়ে টোকাইয়ের কাজ বেছে নিয়েছিলাম। সেই থেকে আজও আমি টোকাই।

পতাকা বিক্রেতা আদ্রর্ গলায় বললেন,

- আমি যদি তোমার পড়ামোনার খরচ বহন করি তুমি কী আবার পড়াশোনা করবে?

ছেলেটি বিস্মিত হয়ে বলল,

- আপনি তো আমার রক্তের সম্পকের্র কেউ নন। যেখানে আমার নিকটাত্মীয়রা এগিয়ে আসেননি সেখানে আপনি কেন আমার পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করবেন?

- তুমি আমার রক্তের সম্পকের্র কেউ নও। এ কথা ঠিক। তবে আমার প্রিয় বাংলাদেশেরপ্রন্তান। সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার অধিকার তোমারও আছে। তাছাড়া আমার কোনো সন্তান নেই। তুমি তো আমার সন্তানের মতো। কিছু মনে না করলে একজন পিতার মতো তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিতে পার। তোমাকে আর টোকাইয়ের কাজ করতে হবে না।

- আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনার নিজেরই চলতে কষ্ট হয়। সেখানে আমার খরচ কীভাবে বহন করবেন?

- আমাদের সংসারে তোমার খালাম্মা আর আমিই আছি। সারাদিনে পতাকা বিক্রি করে যা পাই তা দিয়ে বেশ চলতে পারি। তোমার মতো একজন ছেলে থাকলে তাকেও তো আমাদের দেখতে হতো।

এই কথা বলে পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে নিজের ঠিকানা লিখে ছেলেটির হাতে দিলেন। এরইমধ্যে স্কুলের মাঠে সাজ সাজ রব। সবাই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি ততক্ষণে পতাকা বিক্রেতার বুকে জায়গা করে নতুন স্বপ্নের হাতছানিতে ভাসছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<27568 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1