বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নে ভরা বুক

আরাফাত শাহীন
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

কদিন হলো মোতালেব হোসেনের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। জ্বরে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছেন তিনি। মুখে রুচি বলতে কিছুই নেই। তবে আজ সকাল থেকে গায়ে-গতরে একটু শক্তি ফিরে পেতে শুরু করেছেন। অনেক কাজ পড়ে আছে। মাঠে ধান লাগানো শুরু হয়েছে। গ্রামের বাকি সবাই কাজ শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। শরীর খারাপ থাকার কারণে পেছনে পড়ে গেছেন তিনি। তাই, যত দ্রম্নত সম্ভব কাজ শুরু করা দরকার।

\হমোতালেবের একমাত্র ছেলে জহির। তাকে নিয়েই তিনি কাজকর্ম করে থাকেন। জহিরের বয়স আর কত হবে! বারো বছর হবে হয়তো। জহির স্কুলে যায় না। তবে তার স্কুলে যাওয়ার গরজ ছিল বেশ। মোতালেবই তাকে স্কুলে যেতে দেননি। তিনি বলেন, 'তুই চাষার ছাওয়াল। স্কুলি যাওয়ার কাম নাই তোর।' 'কী কন আব্বা! চাষার ছাওয়াল বলে কি স্কুলি যাতি পারব না!'

বাবার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় জহিরের। সে বলে চলে, 'গিরামের কত ছাওয়াল-মাইয়া স্কুলি পড়তি যায়! আমি গিলি পরে কী অয়!'

জহিরের কথা শুনে মোতালেবের ভারি হাসি পায়। আবার তার বেশ রাগও হয়। গরীব মানুষের ছেলের পড়ালেখা শিখে হবে কী? তিনি বলেন, 'শোন্‌ বাপ, আমরা গরীব মানুষ। আমাগের কাম কইরে খাতি হবি। পড়ালেহা শিখতি হলি ম্যালা টাহা-পয়সার দরকার অয়। আমরা অত টাহা পাবো কহানে? তোর স্কুলি যাওয়ার দরকার নাই। আমার সাথে মাঠে যায়ে কাম করা শিখবি। তারপর কাম কইরে খাতি পারবি।' বাবার কথা শুনে জহিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার বয়সী সমস্ত ছেলেমেয়েরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলের দিকে যায়। তারও বড় ইচ্ছা হয় স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা শিখতে।

জহির উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে লাটিম ঘুরাচ্ছে। পশ্চিম ঘরের দাওয়ায় বসে মোতালেব হোসেন সব দেখতে পান। জহির বাম হাতে লাটিম ধরে ডান হাত দিয়ে প্রথমে সুতো পেঁচায় লাটিমের মাথায়। তারপর নিপুণ দক্ষতায় নারীদের শাড়ি পরার মতো লাটিমের সারা গায়ে সুতো জড়িয়ে দেয়; চোখে শকুনের দৃষ্টি নিয়ে লাটিমটা ছুড়ে দেয় মাটিতে। বনবন করে ঘুরতে থাকে লাটিমটি। জহির ভারি কায়দা করে ঘুরন্ত লাটিম হাতের তালুতে নেয়। তালুর ওপর ঘুরতে থাকে লাটিম। জহির চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। মোতালেব হোসেন চেয়ে থাকেন লাটিমের দিকে। তারপর তাকান ছেলের মুখের দিকে। ভারি মায়াবী চেহারা তার। ছেলেকে তিনি স্কুলে পাঠাতে পারেননি। কিন্তু জহির বড্ড দুরন্ত হয়েছে। বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতে না হলে সে দিন সে সারাদিন ছুটে বেড়াবে টো টো করে। কোথায় পাখির বাসা আছে, বাসায় ডিম থাকলে তাও তার খুঁজে বের করা চাই। সময় সময় সে নদীর তীরে ছুটে যায়। বাড়ি থেকে সামান্য দূরেই দুরন্ত মধুমতি নদী। জহির নদীতে নেমে পড়ে। কখনও একা, কখনও দলবেঁধে। যে দিন সে দলবেঁধে পানিতে নামবে সে দিন তাকে পানি থেকে টেনে তোলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মোতালেবকে লাঠি নিয়ে গিয়ে তারপর তুলে আনতে হয় তাকে।

\হমোতালেব হোসেন এসব কথা ভেবে মনে মনে হাসেন। ছোটবেলায় তিনি নিজেও এমন দুরন্ত ছিলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, 'লাটিম খেলা শেষ হলো বাপ?'

'ম্যালাক্ষণ ধরেই তো খেললাম। এহন বাদ দিলি দিয়া যায়। কিছু করতি হবি নাকি আব্বা?'

জহির প্রশ্ন করে। 'তা আমার সঙ্গে এট্টু মাঠে গিলি মন্দ অয় না। কয়দিন তো কাজকাম একদমই অয় না। সবার ধান লাগানু শ্যাষের দিক। এহন শুরু না করলি পাছে পইড়ে যাতি হবি।' বাবার কথা শুনে মন খারাপ হয় না জহিরের। কদিন থেকে তারও কাজকর্ম নেই খুব একটা। মাঠে গিয়ে বাবার সঙ্গে কাজ করতে ভালোই লাগে। সে বলে, 'তালি পরে চলেন। চারা উঠোয়ে ধান লাগানু শুরু করিগে।'

'হয় বাপ। চলো যাই।' মোতালেব হোসেন মাথায় গামছা বেঁধে, কাঁধে কোঁদাল নিয়ে মাঠের দিকে রওনা হন। তার পেছনে বাঁশের ঝুড়ি হাতে জহির। চারা তোলা শেষ হলে সেগুলো ঝুড়িতে রাখা হবে। বাপ-বেটাকে মাঠের দিকে চলতে দেখে জহিরের মা জাহানারা প্রশ্ন করেন, 'কী ব্যাপার মাঠে চললেন যে! আপনার শরীল না খারাপ!'

\হমোতালেব হাসতে হাসতে বলেন, 'এট্টু ভালো ঠেকতিছে। এহন যদি বাড়ি বসে থাহি তালি পরে সগলের পাছে পইড়ে যাতি হবি। তাই আজকেই ধান লাগানু শুরু করতি হবি।'

\হমোতালেব আবার এগোতে থাকেন। জাহানারা তাকে ডেকে থামান। তারপর বলেন, 'বেলা তো কোম অইলো না। চাইড্ডে খাইয়ে গিলি অয় না? আন্দা অইয়ে আইছে পিরায়।'

\হমোতালেব বলেন, 'আমরা যায়ে কাম শুরু করিগে। তুমি ফাতেমারে দিয়ে ভাত পাঠায়ে দিও। দুই বাপ-বিটা খায়ে নিবানি।' মাঠের দিকে হাঁটা শুরু করেন মোতালেব। পেছনে জহির। জাহানারা তাদের গমন পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার রান্নাঘরে ফিরে আসেন।

প্রায় দুই ঘণ্টা হলো জহিররা কাজ করছে মাঠে। মাথার ওপর সূর্য তেতে উঠেছে। এর মাঝে ফাতেমা তাদের খাবার খাইয়ে গিয়েছে। রৌদ্রের তাপ শরীর পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে বাপ-বেটার। কাদা-পানিতে শরীর মাখামাখি। জহির পূর্ণ উদ্যোমে চারা তুলে গেলেও হাঁপিয়ে ওঠেন মোতালেব। তার জ্বরে ভোগা শরীর সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। জহির বাপের অবস্থা বুঝতে পারে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, 'চলেন, খানিক জিড়েয়ে নেই।' ম্যালা কষ্ট হয়ে গেছে নাহি বাপ?'

হাসতে হাসতে বলেন, মোতালেব। 'তা এট্টু তো অয়ছেই।'

বাবার দিকে তাকিয়ে হাসে জহির। বাপ- বেটার মধ্যে চকিতে দৃষ্টি বিনিময় হয়। যা বোঝার বুঝে নেয় দুজন।

জমি থেকে সামান্য দূরেই সারি সারি তালগাছ। সেখানে গিয়ে বসার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মোতালেব দেখতে পান রাস্তায় একটা গাড়ি থেমে আছে। গাড়ির চালক হাত নেড়ে তাদের ডাকছে। মোতালেব বলেন, 'গাড়িডা কি নষ্ট হইছে নাহি রে? চল তো যাইয়ে দেইহে আসি। বেচারার মনে হয় ম্যালা কষ্ট হইচ্ছে।'

'আমি ম্যালাক্ষণ আগেই দেহিছি গাড়ি দাঁড়ায়ে থাকতি।'

জহির বলে বাবার দিকে চেয়ে। রাগ হয় মোতালেবের। তিনি ধমক মেরে বলেন, 'তা এতক্ষণ কসনেই ক্যা? এট্টু আগে যাইয়ে যদি তার উপকার করতি পারতাম!'

'আমি মনে করিছি এমনিই দাঁড়ায়ে আছে। তাই কিছু কইনেই।, 'আর এরোম গাধামি করবিনে খবরদার। ঠিক আছে?' মোতালেবের প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়ে জহির। বাবার কথা সে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে।

'আরে তুমি জয়নাল জুমাদ্দারের ছাওয়াল মতিয়ার না?'

গাড়ির সামনে দাঁড়ানো যুবককে প্রশ্ন করেন মোতালেব।

'জ্বী চাচা। আপনাদের দেখেই থেমেছি। আরেকটু দেখার পর আপনারা যদি না আসতেন তাহলে আমিই নেমে যেতাম।'

মতিয়ার বলে। 'জরুরি কোনো ব্যাপার নাহি?'

উৎসুক হয়ে ওঠেন মোতালেব। 'না তেমন বিশেষ কিছু নয়। তুমার নিজির গাড়ি নাহি?্থ প্রশ্ন করেন মোতালেব।

হঁ্যা চাচা। আপনাদের দশজনের দোয়ায় গাড়িটা কিনেছি। ঢাকাতে বাড়িও করেছি একটা। খুব ভালো করিছো। 'তা বাড়িতি বেড়াতি আইছো বুঝি?' বেড়াতে নয়, পাকাপোক্তভাবেই থাকতে এসেছি। আব্বা-মার বয়স হয়েছে। এখন তাদের পাশে থাকাটা দরকার।

অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা জহিরের দিকে ঈঙ্গিত করে মতিউর বলে, আপনার ছেলে জহির না, 'হয়, আমার তো এট্টাই ছাওয়াল।'

\হকোন ক্লাসে পড়ো জহির?

প্রশ্নটা জহিরকেই করা হয়। কিন্তু সে বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো জবাব দিতে পারে না। তাকে এই প্রশ্নের হাত থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন মোতালেব। তিনি বলেন, 'চাষা মানষির ছাওয়ালের লেহাপড়া শিইহে হবিডা কী? তুমরা মাস্টারের ছাওয়াল ছিলে পড়াডা ঠিকমত শিহিছো। আমাগের দিয়ে ওসব অবে না।'

\হমোতালেবের কথা শুনে মর্মাহত হয় মতিউর। সে বলে, কী বলেন চাচা! ওকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন না কেন? জহিরকে কি অন্ধ করে রাখতে চান?

'তা তো চাইনেরে বাপ! কিন্তু অভাবের সংসার। পড়ালেহার খরচ তো চালাতি পারবো না। জহির তো স্কুলি যাতি চায়। আমিই যাতি দেইনে। ছাওয়ালডার মাথা খুব ভালো ছিল।'

মতিউর জহিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, তুমি কি স্কুলে যেতে চাও?

'হ ভাই। যাতি খুব ইচ্ছা করে।'

জহির প্রাণপণে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু পেরে ওঠে না। মতিউর বুঝতে পেরে হেসে দেয়।

জহির প্রশ্ন করে, ্তুআপনার গাড়ি কি নষ্ট অইছে?'

না নষ্ট হয়নি। আমি তোমাদের দেখেই থেমেছি।

মোতালেব মতিউরের দিকে চেয়ে বলেন, 'ছাওয়ালডার ম্যালা গুণ। আবার মাথায় বুদ্ধিও আছে ভালো।'

\হসেটা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। বাড়িতে এসে লোকজনের কাছে শুনেছিও খানিকটা। শুনুন, কাল সকালে আমি ওকে নিতে আসব। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।

\হমোতালেব কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে দিয়ে মতিউরে বলে ওঠে, টাকা নিয়ে আপনাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। জহিরের সমস্ত খরচ আমি বহন করব।

জহির খুশি হয়ে ওঠে। সে স্কুলে যেতে পারবে। মতিউর তার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমাকে কিন্তু রোজ স্কুলে গিয়ে ঠিকঠাক মতো লেখাপড়া করতে হবে। আর অবসর সময় বাবার কাজেও সাহায্য করতে হবে। পারবে তো?

জহির ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। এই সামান্য কাজটুকু করতে তার কোনো সমস্যাই হবে না। তার ভেতর এখন অন্যরকম একটা উত্তেজনা কাজ করছে; জেগে উঠেছে নতুন এক স্বপ্ন। স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা শিখতে পারবে সে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!

সদস্য সচিব, জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<38348 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1