বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাজিতা

মো. মাঈন উদ্দিন
  ২৪ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

ছাদওয়ালা একতলা বিল্ডিং। ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির। দেয়ালে চকচকে লাল রং করা। জানালায় কালো গøাস সঁাটানো। সকালে সূযের্র আলো গøাসে পড়ে তার প্রতিফলন আমার চোখেমুখে বিচ্ছুরিত হলো। দেয়াল সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে একটি ফুলের বাগান। গোলাপ, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ফুল ফুটে রয়েছে বাগানে। অণের্বর মা সকালে পানি দিচ্ছেন। তিনি আমাকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

আমি খাটের এক কোণে বসলাম, অণের্বর মা পাশের রুমে গেলেন। হঠাৎ পুব-পাশের দেয়ালে এসে চোখের দৃষ্টি আটকে গেল। দেয়ালে সঁাটানো একটি ছবি দেখে। দৃষ্টি সরাতে পারছিলাম না কিছুতেই। আমার হৃদ-নয়নের জল ভারী হয়ে এলো।এ যেন চকচকে আকাশে হঠাৎ কালো মেঘের ঘনঘটা, আকাশ ভেদ করে ঝমঝমে বৃষ্টির তাÐব। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এ যে রাজনের ছবি। আমি ঠিক দেখছি তো! চশমা চোখে লাগিয়ে আবার তাকালাম, কিন্তু রাজনের ছবি এখানে কেন? তাহলে কী রাজন এখানে বাড়ি করেছে? অণের্বর মা এসে বললেন, আপা, এটা অণের্বর বাবা, সাইপ্রাস থাকেন। আমার গলা শুকিয়ে এল, তারমানে এটা রাজনের পরিবার! এ বাসায় আগেও একবার এসেছিলাম কিন্তু এই দৃশ্যটি দেখিনি, যে দৃশ্যটি আমার বিশ^াসের মুকুলে কুঠারাঘাত করল দারুণভাবে।

রাজনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ময়মনসিংহ শহরে বিশ্ববিদ্যালয় ভতির্র একটি কোচিং সেন্টারে। রাজন ও আমি একই কোচিংয়ে ভতির্ হলাম। লক্ষ্য করলাম রাজন আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কোনো এক ফঁাকে রাজনকেও আমার আপন মনে হতে লাগল। সারাক্ষণ ওর নিষ্পাপ চোখ দুটি আমার মনের ক্যানভাসে ভেসে বেড়াত।

ভাসিির্টতে পড়াকালে রাজনের বাবা মারা গেল। তার পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম। আমি বাবার কাছ থেকে টাকা এনে তার খরচের জোগান দিলাম। কারণ রাজন যে আমার হৃদয় মন্দিরে সাজানো পদ্মআসনটিজুড়ে বসে আছে। যার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সারাপৃথিবীর প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম। যার চোখ-সাগরে সঁাতার কেটে আমি তৃপ্তি পেতাম।

একদিন ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়ে একটি জবাফুল গাছের পাশে দু’জনে পাশাপাশি বসেছিলাম। পশ্চিম আকাশে সূযর্টা তখনো অস্তমিত হয়নি তবে রক্তিম বণর্ ধারণ করেছিল। গাছপালার ফঁাক দিয়ে সূযর্টা আমাদের দিকে তাকিয়েছিল নিলজ্জভাবে। আমি তাকিয়েছিলাম রাজনের চোখ পানে। ওর চোখ দুটি টলমল করছিল। কপালটা একটু একটু ঘামছিল। সানগøাসটা কপালের ওপরে চুলের সাথে আটকেছিল। আমার একটা হাত সে দু’হাতে ধরে রেখেছিল। আমার হাতের নখগুলি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিল। আমার হাত ছেড়ে সে তার বামহাতটি আমার কোলে মেলে ধরল। বললÑ দেখ তো, আমার হাতের রেখায় কী লেখা আছে? ভবিষ্যৎ অন্ধকার না আলোকময়? আমি গভীর দৃষ্টি দিলাম তার হাতের তালুতে। এই দৃশ্য দেখে পুকুরের মাছগুলো ফিক ফিক করে হেসেছিল। ওপরের স্তরের পানি ছিটিয়ে তারা চলে গেল তলদেশে। সেদিন রাজনের হাতের রেখায় কী লেখা ছিল, আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি রাজনের মনের কোণে লুকায়িত অব্যক্ত কথাগুলো। বুঝতে পারিনি রাজনের হৃদয়ে একরাশ প্রতারণা ভালোবাসার আবরণে মোড়ানো ছিল, যার বাহির অংশটা চাকচিক্যময় হলেও ভেতরটা কলুষিত। বুঝতে পারিনি রাজন আমাকে এতটুকুও ভালোবাসেনি, ভালোবেসেছিল আমার টাকা, ভালোবেসেছিল প্রদত্ত অনুগ্রহ। রাজন আসলে রাজন নয়, একটা ঠক, প্রতারক। সে আমার ভালোবাসা নিয়ে কানামাছি খেলেছে। তৃতীয় বষের্ পড়ার সময় আমার চাকরি হয়ে গেল। উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী। পদ ছোট কিন্তু বাবা বললেন- দ্যাটস ওকে। চাকরিটা ছেড় না। মেয়েদের জন্য চাকরিটা খারাপ না। রাজন সাইপ্রাস সরকারের স্কলারশিপ পেল। যেদিন সে সাইপ্রাস চলে যাবে সেদিন আমার জমানো পঞ্চাশ হাজার টাকা তাকে দিলাম। গোপনে। অঁাচল দিয়ে চোখের জল মুছে বললামÑ প্রতিক্ষায় থাকলাম। ভালো থাকিস। সে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললÑ রুনা, তোকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। আরও কষ্ট হবে তোকে ছেড়ে থাকতে। আমি সেদিনও বুঝতে পারিনি, রাজন আমাকে ভালোবেসে, আমার কপালে চুমু দেয়নি। চুমু দিয়েছিল আমার টাকার কপালে। সেদিন আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছিলাম; কিন্তু আমি সেদিনও বুঝতে পারিনি আমার এই কঁাদা একটি স্বাথের্লাভী পাষাণের জন্য।

সেই যে গেল, রাজন আর কোনো দিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ভাবতে ভাবতে আমার চোখ বেয়ে অশ্রæ গড়িয়ে পড়ছিল। ওপাশ থেকে অণের্বর মায়ের পায়ের শব্দ পেলাম। রুমাল দিয়ে চোখ দুটি মুছে নিজেকে লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। মনটা ভীষণ ভারী হয়ে উঠল তথাপিও দিবালোকে নিজেকে মনের অঁাধারে লুকাতে বাধ্য হলাম।

এক, দেড় মাস পর। সামনেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। লম্বা ছুটি। ছুটির আগেই হাতে থাকা কাজগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। তাই সকাল সকাল কাজে হাত দিয়েছি। ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই ওপাশে মহিলা কণ্ঠস্বর।

-আপা, আমি অণের্বর আম্মা।

- কোন অণের্বর আম্মা? ও আচ্ছা, চিনতে পেরেছি। আমি হেসে বললাম।

-আগামীকাল আমাদের বাসায় আসুন না প্লিজ। একটু সমস্যায় পড়েছি। আপনার সঙ্গে পরামশর্ করা দরকার।

পরের দিন সকাল বেলা বাড়িতে গেলাম। অণের্বর মা বাগানে পানি দিচ্ছে।

-আপা আপনি একটু বসুন। আমি পানি দেয়া শেষ করে এখনি আসছি। ঘরে প্রবেশ করামাত্র চমকে উঠলাম। রাজন খাটে বসে আছে। আমাকে দেখা মাত্র সে ওঠে দঁাড়াল। হাত কচলাতে কচলাতে বললÑ রুনা, আই অ্যাম সরি।

রাজনের মুখটা আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। আমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই আমি দৃষ্টি অবনত করলাম। এক জীবনের সমস্ত স্বপ্ন ভাঙার বিনিময় যদি ‘সরি’ হয়। একটা আস্ত জীবন তিলেতিলে নিষ্পেষিত করার বিনিময় যদি ‘সরি’ হয়। একটা ইতিহাসকে উল্টে দেয়ার বিনিময় যদি ‘সরি’ হয়। তাহলে আমি এই ‘সরি’কে থুঁ থুঁ দিই। ধিক্কার জানাই এই ইংরেজি শব্দটাকে।

রাজন এখন আমার কেউ না। আমি রাজনের কেউ না। যা ছিল তা কেবলই ধূসরঅতীত। রাজন এখন কারও স্বামী, কারও পিতা। সুতরাং এক মুহূতর্ এখানে দঁাড়িয়ে থাকার অধিকার আমার নেই। রাজন নামের এই লোকটার সঙ্গে কথা বলা মানে পরাজয় মেনে নেয়া। আমি দ্রæত পদে প্রস্থান করলাম।

সদস্য

জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম

ময়মনসিংহ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<4810 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1