মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অকৃতজ্ঞ

মো. মাঈন উদ্দিন
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বাড়িটির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। এই বনগ্রাম ইউনিয়ন সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। মাত্র তিন-চার দিনে যে ক'টি এলাকা ঘুরেছি তাতে মনে হয়েছে, এ এলাকার লোকজন হতদরিদ্র। কিন্তু এই বাড়িটা দেখছি ছিমছাম। এলাকার আট/ দশটি বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছাদওয়ালা একতলা বিল্ডিং। ইংরেজি 'এল' আকৃতির। দেয়ালে চকচকে লাল রং করা। জানালায় কালো গস্নাস সাঁটানো। সকালের ঘন কুয়াশা। কুয়াশার জাল ভেদ করে সূর্যের আলো জানালার গস্নাসে পড়ে। আলোর প্রতিফলন আমার চোখেমুখে বিচ্ছুরিত হয়। দেয়াল সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে একটি ফুলের বাগান। গোলাপ, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধ্যাসহ বিভিন্ন ফুল ফুটে রয়েছে বাগানে। আমি দেউড়ির পাশ থেকে ডাকলাম- বাড়িতে কেউ আছেন?

একজন মহিলা বের হয়ে এল। সঙ্গে ফুটফুটে একটি ছেলে। হালকা শীতের সোয়েটার ঝুলছে তার গায়ে। বড়ই মিষ্টি ছেলেটি। যে কেউ দেখলে আদর করতে ইচ্ছে করবে। আমি তার গাল টেনে আদর করলাম। বললাম- বাবা তোমার নাম কি? মিষ্টি ছেলেটি টেনে টেনে বলল- আমার নাম অর্ণব। পুরো নাম অর্ণব শাহরিয়ার। আমি ব্যাগ হতে একটি খাতা বের করে প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখতে লাগলাম- আপা আপনার কয় ছেলে মেয়ে? মহিলা জানালো, অর্ণব-ই তার একমাত্র ছেলে। আপনার স্বামীর নাম কি? জবাবে মহিলা জানাল- তার স্বামীর নাম রাজন। রাজনের 'র' লিখতেই আমার কলম থেমে গেল। এক অজানা দ্বন্দ্বে আমার হাত কেঁপে উঠল। ঘাড় বাঁকিয়ে বাগানের দিকে নিরর্থক তাকিয়ে চিন্তা করলাম কিছুক্ষণ, রাজন! এ কোন রাজন? আমি সামনে দাঁড়ানো মহিলার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম। অত্যন্ত সহজ সরল টাইপের এক মহিলা- এই মহিলাই কি রাজনের বউ? এই ছেলেটি রাজনের ছেলে? আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল- রাজনতো দেখছি বেশ সুখেই আছে তাহলে। আমি খাতার দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম- আপনার স্বামী কী করেন? তিনি জানালেন, তার স্বামী সাইপ্রাস প্রবাসী। আমি আবার আনমনা হয়ে গেলাম, সাইপ্রাস প্রবাসী! আমার ধারণা তাহলে ঠিক! চোখের ঝাপসা দৃষ্টি কেটে গেল। আমি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে মহিলার সঙ্গে কথা বললাম, অন্যান্য তথ্য লিপিবদ্ধ করলাম। আমি চলে আসব, এমন সময় মহিলা বলল- আপা ঘরে আসেন। আমি বললাম- না, আজ নয়, আরেকদিন। কিন্তু অর্ণব আমার কাপড় ধরে টানতে লাগল। বলল- আন্টি ঘরে এসো। এই মিষ্টি ছেলেটির বায়না ফেলতে পারিনি। ঘরে প্রবেশ করে একটি খাটে বসলাম। অর্ণবের মা পাশের রুমে গেল। আমি ঘরের চারিদিকে নানা রকম আসবাবপত্র দেখছিলাম। হঠাৎ পূর্ব পাশের দেয়ালে এসে চোখের দৃষ্টি আটকে গেল। দৃষ্টি সরাতে পারছিলাম না, দেয়ালে সাঁটানো একটি ছবি থেকে। এ যে আসলেই রাজনের ছবি! এতদিন পর রাজনের ছবি দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ছবিটির দিকে। তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে দেখছিলাম ছবির মানুষটিকে। ছবির মানুষটিও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কোনো পলক ফেলছে না। আমিও পলক ফেলতে পারলাম না। আহা! কতদিন হলো রাজনকে দেখি না।

রাজনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ময়মনসিংহ শহরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির একটি কোচিং সেন্টারে। রাজন ও আমি একই কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। কোচিংয়ের পরীক্ষায় কখনো রাজন কখনো আমি সর্বোচ্চ মার্কস পেতাম। রাজনের বাবা দরিদ্র কৃষক। অর্থ কষ্টে তাদের সংসার চললেও রাজন ছিল গোবরে পদ্মফুলের মতো। অত্যন্ত মেধাবী। প্রথম দ্বিতীয়ের প্রতিযোগিতার কোনো এক ফাঁকে রাজনকে আমার আপন মনে হতে লাগল। সারাক্ষণ ওর নিষ্পাপ চোখ দুটি আমার মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠত। প্রতিযোগিতা নয়, অচিরেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলাম তার প্রতি। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের কারণে কিনা জানি না, রাজন আমার প্রতিটি কথার গুরুত্ব দিত মন থেকে।

একমাস পর রাজন জানাল সে আর কোচিংয়ে পড়বে না। আমি আঠারো বছরের, কোমল হৃদয়ে প্রবল ধাক্কা খেলাম। বললাম- কেন? সে বলল- কোচিংয়ের বেতন আমার বাবার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সারা রাত্র আমার ঘুম হলো না। রাজন যে আমার হৃদয় মন্দিরে সাজানো পদ্মআসনটি জুড়ে বসে আছে। যার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কোচিং সময় পার হয়। যার চোখের সাগরে সাঁতার কেটে আমি তৃপ্তি পাই, তাকে ছাড়া কোচিং এ মন বসাব কি করে। পরের দিন তাকে বললাম- টাকার চিন্তা করিস না। ক্লাস কর।

\হরাজনের মাসিক বেতন আমি পরিশোধের ব্যবস্থা করলাম। বিনিময়ে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। কোচিং শেষে রাজন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। আর আমি ভর্তি হলাম নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফি আমার কাছ থেকে চেয়ে নিতে একটুও সঙ্কুচবোধ করত না। আমিও তার সেমিস্টার ফি পরিশোধ করে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় রাজন প্রতিদিন বিকেলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক বার হলেও ঢু মারত।

একদিন ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়ে একটি জবাফুল গাছের পাশে দু'জনে পাশাপাশি বসেছিলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা তখনো অস্তমিত হয়নি তবে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যটা আমাদের দিকে তাকিয়েছিল নির্লজ্জভাবে। আমি তাকিয়েছিলাম রাজনের চোখ পানে। ওর চোখ দু'টি টলমল করছিল। কপালটা একটু একটু ঘামছিল। সানগস্নাসটা কপালের ওপরে চুলের সঙ্গে আটকেছিল। আমার একটা হাত সে দু'হাতে ধরে রেখেছিল। আমার হাতের নখগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিল। আমার হাত ছেড়ে সে তার বামহাতটি আমার কোলে মেলে ধরল। বলল- দেখতো, আমার হাতের রেখায় কী লেখা আছে? ভবিষ্যৎ অন্ধকার না আলোকময়? আমি গভীর দৃষ্টি দিলাম তার হাতের তালুতে। এই দৃশ্য দেখে পুকুরের মাছগুলো ফিক ফিক করে হেঁসেছিল। ওপরের স্তরের পানি ছিটিয়ে তারা চলে গেল তলদেশে। সেদিন রাজনের হাতের রেখায় কী লেখা ছিল, আমি বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি রাজনের মনের কোণে লুকায়িত অব্যক্ত কথাগুলো। বুঝতে পারিনি রাজনের হৃদয়ে একরাশ প্রতারণা ভালোবাসার আবরণে মোড়ানো ছিল, যার বাহির অংশটা চাকচিক্যময় হলেও ভেতরটা কলুষিত। বুঝতে পারিনি রাজন আমাকে এতটুকুও ভালোবাসেনি, ভালোবেসেছিল আমার টাকা, ভালোবেসেছিল প্রদত্ত অনুগ্রহ।

রাজন আসলে রাজন নয়, একটা ঠক, প্রতারক। সে আমার ভালোবাসা নিয়ে কানামাছি খেলেছে। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমার চাকরি হয়ে গেল। উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী। পদ ছোট কিন্তু বাবা বললেন- দ্যাটস ওকে। চাকরিটা ছেড়ো না। মেয়েদের জন্য চাকরিটা খারাপ না। রাজন সাইপ্রাস সরকারের স্কলারশিপ পেল। যেদিন সে সাইপ্রাস চলে যাবে সেদিন আমার জমানো পঞ্চাশ হাজার টাকা তাকে দিলাম। গোপনে। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বললাম- প্রতিক্ষায় থাকলাম। ভালো থাকিস। সে আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল- রুনা, তোকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। আরো কষ্ট হবে তোকে ছেড়ে থাকতে। আমি সেদিনও বুঝতে পারিনি, রাজন আমাকে ভালোবেসে, আমার কপালে চুমু দেয়নি। চুমু দিয়েছিল আমার টাকার কপালে। সেদিন আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছিলাম। কিন্তু আমি সেদিনও বুঝতে পারিনি আমার এই কাঁদা একটি স্বার্থলোভী পাষাণের জন্য।

সেই যে গেল, রাজন আর কোনো দিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

সদস্য, জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম

ময়মনসিংহ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67063 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1