মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের পোশাক

কবির কাঞ্চন
  ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বাংলার প্রকৃতিতে চলছে শীতের তীব্রতা। সেই সঙ্গে ব্যস্ততা বেড়েছে গ্রামবাংলার মানুষের। কাছের ও দূরের স্বজনদের পিঠাপুলি, ফিরনি, সেমাই, পায়েসসহ আবহমান বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এখানের সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে।

সেজানের দাদাও তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর শীতের ছুটি পেয়েই বাবা-মায়ের সঙ্গে দাদার বাড়ি ছুটে আসে সে। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরের ভ্রমণ তার মনে অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। এর আগে বেশ কয়েকবার যাওয়া হলেও সবকিছু ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারত না সে। এখন তার বুঝ হয়েছে। নতুন কোনোকিছু দেখলে মনের মাঝে তার নানান বিষয়ে প্রশ্ন জাগে। আর অমনি সুযোগ বুঝে যাকে পাশে পায় তাকে প্রশ্ন করে বসে। উত্তর তার মনের মতো হলে সে মুগ্ধ চোখে হাসে। আর মনের মতো না হলে মুখভার করে থাকে।

\হসজান পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। ক'দিন আগেই প্রাথমিক শিক্ষাসমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে সে। তার পরীক্ষাও খুব ভালো হয়েছে। এ বছরটা তার খুব পরিশ্রমের মধ্যেই কেটেছে। সকালে বাবামায়ের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করে বাবার সঙ্গে বাইরে গিয়ে একটু বেরিয়ে এসে পড়তে বসা। এরপর ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে স্কুলে যাওয়া। সামান্য বিরতিতে অতিরিক্ত ক্লাসে অংশ নেয়া। এরপর বাসায় ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বই নিয়ে বসে যাওয়া। বিকেলে খেলার সময়ে মাঠে না গিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রাইভেট পড়তে স্যারের বাসায় যাওয়া। প্রাইভেট শেষে বাসায় ফিরে এসে একটানা রাত জেগে পড়া। এরকম টাইট শিডিউলের মধ্যেই বছরটা পার করেছে সে।

এখন পরীক্ষা নেই। নেই কোনো রুটিন ওয়ার্ক। মাও চোখে চোখে রাখেন না। ওর কাছে মনে হয়, পরীক্ষা নামক বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত পাখির মতো চারদিক ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে সে।

\হসেজানের বাবা সোহেল চৌধুরী ইপিজেড এলাকায় একটি বিদেশি ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার। বন্দরটিলা কাঁচাবাজারের পাশে তাদের বাসা। বিশালাকৃতির বাসাটি যেন ছোটখাটো একটি পার্ক। সেজান বাবা-মা'র কাছে কোনো কিছু চাইতেই পেয়ে যায়। অনেকদিন এমনও হয়েছে সেজান কোনো কিছু চাইনি অথচ পেয়েছে।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে সেজানের প্রিয় ঋতু শীত। শীত এলে সেজান রঙবেরঙের মোটা-পাতলা কাপড়ের পোশাক পায়। বাবা কিনে দেয়। মা কিনে দেয়। নানা-নানি, মামা কিনে দেয়। এমনকি গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে দাদা-দাদি কিনে দেয়। চাচা-ফুপুরা কিনে দেয়। ফলে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই হয়ে যায়। সেজান মনে মনে ভাবে- গত বছর সে গ্রামে তার বয়সী কিছু গরিব-অসহায় ছেলেমেয়েকে দেখেছে। যেখানে প্রচন্ড শীতের দিনে গ্রামের লোকজন গায়ে চাদর কিংবা মোটা কাপড় পরে বের হয়, সেখানে কিছু ছেলেমেয়েকে উদোম গায়ে কাঁপতে কাঁপতে পূর্বদিকে ছুটতে দেখেছে সে। এই চিন্তা থেকে সে নিজের ব্যাগের ভেতর তার বেশকিছু শীতের পোশাক যত্ন করে নিয়েছে।

শীতকালীন অবকাশ যাপন উপলক্ষে গতকাল সেজানের বাবা তার অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। স্ত্রী-পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়ি আসেন। সেজান দাদা-দাদিকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। দাদা-দাদিও তাদের একমাত্র নাতিকে পেয়ে মহাখুশি হন। সারাদিন নাতিকে সঙ্গে নিয়ে দাদা ঘুরে বেড়ান। শুধু খাবার সময় হলে সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যায়। আর রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় সবাই ঘরে থাকে।

\হসেজান দাদার হাত ধরে সবুজ গাঁয়ের ফসলের মাঠ, বনবীথিকা, হাটবাজারসহ সর্বত্র চষে বেড়ায়। দাদা যখন গাঁয়ের সহজ সরল মানুষের কাছে সেজানকে পরিচয় করিয়ে দেন, তখন সে মুগ্ধ হয়ে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। জীবনে যাদের সে কখনও দেখেনি তারাও পরিচিত হয়ে তাকে আপন করে নেয়। শহুরে জীবন সম্পর্কে জানতে তাকে কত প্রশ্ন করে। এটা-ওটা কিনে দেয়। সেজান তাদের কাছে যত আসে ততই মুগ্ধ হয়।

একদিন ভোরে দাদার সঙ্গে ভূঁঞার হাটে আসে সে। বাজারে এসে দাদা-নাতি একসঙ্গে চা-নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। দোকানটির পাশেই রয়েছে নলচিরা ভূঞার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠ। হাতিয়ার প্রধান সড়ক সংলগ্ন। হঠাৎ সেদিকে সেজানের চোখ পড়ে। তখনও পুবাকাশে সূর্য হেসে ওঠেনি। কয়েকটি ছেলেমেয়ে শীতে জড়োসড়ো হয়ে সূর্যের আলোর জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের কারো গায়ে মোটা জামা নেই। সবার পরনে জীর্ণশীর্ণ গেঞ্জি। তাও হাফহাতা। ওদের এভাবে দেখে সেজান দাদার কানে কানে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে এক দৌড়ে বাড়ি চলে আসে। এরপর ব্যাগের ভেতর থেকে সবগুলো শীতের পোশাক নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। ওর এমন কান্ড দেখে মা-দাদিসহ ঘরের সবাই অবাক হয়। কাউকে কিছু না বলে বড় বড় পায়ে হেঁটে এসে মাঠে পৌঁছে সে। এরপর সবার হাতে একটি করে শীতের পোশাক তুলে দেয়। সবাইকে দেয়ার পরও একটি পোশাক তার হাতে রয়ে যায়। সেটি সে নিজে পরে ওদেরকেও পরতে বলল। সবাই শীতের পোশাক পরলো। মোটা কাপড়। সেজানের ব্যবহৃত হলেও ভালোভাবে ইস্ত্রি করা পোশাক দেখে মনে হচ্ছে একদম নতুন পোশাক। মুহূর্তে ছেলেমেয়েগুলোর মুখে হাসি ফোটে ওঠে।

শীতের তীব্রতাকে হারিয়ে ওরা পরম কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে সেজানের মুখের দিকে তাকায়। সেজানও মুগ্ধ চোখে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ততক্ষণে সেজানের দাদা তার নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84244 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1