শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজসাক্ষী ও তার বিধান

যে ব্যক্তি নরহত্যা, সশস্ত্র ডাকাতি, সরকারি তহবিল লুটপাট এরকম কোনো অপরাধ নিজে করেছেন বলে স্বীকার করে নিয়ে ওই অপরাধ সংঘটনে অন্যদের অভিযুক্ত করেন, তাকে ‘রাজসাক্ষী’ বলা হয়। রাজসাক্ষী নিজের গুরুতর অপরাধ স্বীকার করেন এবং ওই অপরাধ কিংবা ওই ধরনের অন্য কোনো অপরাধ সংঘটনে তাকে যারা সহায়তা দিয়েছিলেন তাদের অভিযুক্ত করেন এবং প্রমাণের বিষয়ে সহায়তা করতে সম্মত হন। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন কামরুল হাসান (নাজমুল)
লেখক : কলামিস্ট ও লিগ্যাল রিসাচার্র; শযহধুসঁষ.ষধ@িমসধরষ.পড়স
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

রাজধানীর শ্যামলীতে নিজের বাড়িতেই খুন হন ইমতিয়াজ আহমেদ (৩৫)। পরদিন সকালে প্রতিবেশীরা ইমতিয়াজের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে খবর দেন মোহাম্মদপুর থানায়। তদন্তে নেমে পুলিশ ইমতিয়াজের স্ত্রী সুমনাকে জেরা করতে তার কথায় অসঙ্গতি পায়। উঠে আসে সুমনার প্রেমিক আহসানের ভ‚মিকা। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে আহসানের হাতেই খুন হন ইমতিয়াজ। গ্রেপ্তার করা হয় আহসানকে। সুমনা ইতোমধ্যে বুঝতে পারে যে আগামী দিনে আদালতে তার জন্য এক কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। সে তার আইনজীবীর মাধ্যমে জানতে পারে যে আদালত রাজসাক্ষীর শাস্তি মকুব করে দেয়। ফলে এই সুযোগটা নেয়ার জন্যই সে পুলিশের কাছে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন জানিয়ে বলে আদালতের সামনে সে বলতে প্রস্তুত কীভাবে আহসান তার স্বামীকে খুন করেছে।

‘রাজসাক্ষী’ আসলে কী? রাজসাক্ষী হলে সুমনা কি বিশেষ সুবিধা পেতে পারে? কেউ কি চাইলেই রাজসাক্ষী হতে পারে? ফৌজদারি কাযির্বধির ৩৩৭ ধারা অনুসারে, ম্যাজিস্ট্রেট এবং ৩৩৮ ধারা অনুসারে সম্পূণর্ভাবে সত্য ঘটনা প্রকাশ করার শতের্ দায়রা আদালত রাজসাক্ষীকে ক্ষমা প্রদশর্ন করতে পারেন।

বহুকাল থেকেই অপরাধ জগৎ বড় বিচিত্র। অপরাধীকে খুঁজে বের করা পুলিশের বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর অপির্ত। কিন্তু কখনো কখনো অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ধৃত আসামি সহজে মুখ খুলতে চায় না। তখন পুলিশ অপরাধীকে মুক্তির প্রলোভন দেখিয়ে সত্য ঘটনা বলার জন্য সাক্ষী করার প্রস্তাব দেয়। আসামি রাজি হলে তাকে রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষী করা হয়। সুতরাং বলা যায় ‘রাজসাক্ষী’ মানে রাজ্যের সাক্ষী। যেহেতু সাক্ষ্য আইন প্রণয়নের সময় রাজার ‘রাজ্য প্রথা’ ছিল, সেহেতু এ ধরনের সাক্ষীকে ‘রাজসাক্ষী’ বলা হতো। এখন রাজাও নেই রাজত্ব প্রথাও নেই। তাই রাজসাক্ষীকে বতর্মানে ‘রাষ্ট্রের সাক্ষী’ বলা হয়। যাকে ‘রাজসাক্ষী’ করা হয় তার বক্তব্য গ্রহণ করার জন্য অন্যান্য নিরপেক্ষ সমথর্নযোগ্য সাক্ষীও থাকে।

কোনো আসামি রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলে প্রথমে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরে কারাগারে রাখা হয় যাতে অন্য কোনো অপরাধী বা ব্যক্তি তাকে প্রভাবিত করতে না পারে। এ প্রসঙ্গে সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধী অন্য সহযোগী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করার উপযুক্ত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতে হবে। দুষ্কমের্র সহযোগীর অসমথির্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া হলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে না। এ ধারা মতে আসামিকে যিনি রাজসাক্ষী হবেন তাকে ক্ষমা প্রদশের্নর ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে আসামি সাক্ষী হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

অন্যদিকে সাক্ষ্য আইনের ১৪৪ ধারার বিধান মোতাবেক রাজসাক্ষীর একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি প্রদান করা আইনত যুক্তিসঙ্গত হবে না। কেননা সে অন্যান্য সহযোগী অপরাধীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। কাজেই রাজসাক্ষীর মতো একজন বিশ্বাসঘাতক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণে আদালত বেশ সতকর্তা অবলম্বন করেন। আর আসামির সংখ্যা বেশি হলে এমনভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে যাতে প্রত্যেক আসামির পৃথকভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

অপরাধ দমনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর একারণে অধিকাংশ অপরাধের মামলার বাদী রাষ্ট্র হয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ব্রিটিশ শাসনামলে বাদী হতেন রাজা। তাই গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি যারা আইনের সুযোগ নিয়ে সাক্ষী হয়ে রাজার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করতেন তারাই ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে গণ্য হতেন। কোনো একটি অপরাধ সংঘটনে যে সব ব্যক্তি জড়িত থাকে তাদের প্রত্যেককে অপরাধের সহযোগী বলা চলে। অপরাধে সহযোগী সাধারণত সরকার থেকে ক্ষমার প্রতিশ্রæতি লাভ করে রাজসাক্ষীতে পরিণত হয় এবং সে কারণে সরকারের পক্ষাশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাক্ষ্যের অভাবে কোনো অপরাধী যাতে শাস্তি থেকে অব্যাহতি না পায় সে কারণে ফৌজদারি কাযির্বধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায় কতিপয় শতর্ সাপেক্ষে আসামিকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারীর কোনো সহচর যদি অপরাধের ঘটনা সম্পূণর্ভাবে প্রকাশ করে এবং নিজেকে জড়িয়ে সহচরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে তাহলে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ বলে।

কেবল দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য কোনো অপরাধ বা দশ বছর পযর্ন্ত কারাদÐে দÐনীয় কোনো অপরাধ বা দÐবিধির ২১১ ধারার অধীনে সাত বছর পযর্ন্ত কারাদÐে দÐনীয় কোনো অপরাধ বা দÐবিধির ধারা ২১৬ক, ৩৬৯, ৪০১, ৪৩৫ ও ৪৭৭ক-এর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধটির তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পযাের্য় অপরাধের সহযোগী কোনো ব্যক্তিকে এই শতের্ ক্ষমা করার প্রস্তাব দিতে পারেন যে অপরাধীদের সম্পকের্ গুরুত্বপূণর্ তথ্যগত বিষয়ে সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে ক্ষমা করা যাবে। রাজসাক্ষীর দেয়া তথ্য পরবতীের্ত যদি অসত্য প্রতিপন্ন হয়, সেক্ষেত্রে সে ক্ষমা পাবে না।

রাজসাক্ষীর বিবৃতিতে দুটি উপাদান থাকতে হবে যথা ক) সে অপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং খ) অন্য সব আসামির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূণর্ বিষয় দ্বারা সমথির্ত। রাজসাক্ষী যদি আগে থেকে জামিনে না থাকে তাহলে তাকে বিচার শেষ না হওয়া পযর্ন্ত কারাগারে আটক রাখতে হবে। কারণ জামিনে থাকা রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি অনেকটা দুবর্ল। সহ-অপরাধী বা রাজসাক্ষীর বক্তব্যের ওপর নিভর্র করে সাজা দান করার ক্ষেত্রে আদালত সবোর্চ্চ সতকর্তা অবলম্বন করে এবং সাবির্কভাবে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<12937 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1