মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাক্ষী ভাতা প্রদানে আইন ও বাস্তবতা

ফৌজদারি মামলার বিচারে আসামিদের অপরাধ প্রমাণ করতে হয়। এই অপরাধ প্রমাণের কাজটি করেন মামলার সাক্ষীরা। এমনিতেই সাক্ষ্য প্রদান একটি ঝুঁকিমূলক কাজ। তার ওপর মামলায় সাক্ষীদের বিশেষ স্বাথর্ না থাকলে তারা সাক্ষ্য প্রদান করাকে সময়, অথর্ ও শ্রমের অপচয় বলে মনে করেন। সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হতে যে খরচ হয়, তা সাক্ষীকে প্রদানের বিধান আইনে থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন আবরার মাসুদ
নতুনধারা
  ০২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সাক্ষীরা যাতে আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে পারেন সে জন্য রয়েছে সাক্ষী ভাতা। ফৌজদারি মামলায় দুধরনের সাক্ষী থাকেন- পুলিশ সাক্ষী ও বেসরকারি সাক্ষী। সাক্ষীদের ভাতার যে ব্যবস্থা রয়েছে এ ভাতা পান কেবল পুলিশ সাক্ষীরা। বেসরকারি সাক্ষীদের এ ধরনের ভাতা প্রদান করা হয় না বলে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। এতে সৃষ্টি হচ্ছে মামলার জট। উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে অপরাধীরা খালাস যেমন পাচ্ছেন তেমনি নিরপরাধরাও কষ্ট পাচ্ছেন।

ফৌজদারি মামলার বিচার নিষ্পত্তি বিলম্বের ক্ষেত্রে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে সাক্ষীদের সময়মতো আদালতে হাজির করতে না পারা। এর ফলে অসংখ্য জঘন্যতম অপরাধের বিচারকাজ দ্রæত সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। এটাই বাস্তবতা যে সাক্ষীদের নিজ খরচে আদালতে আসতে হয়। সরকারের যা বরাদ্দ আছে তা নানা জটিলতার কারণে সাক্ষীদের হাতে পৌঁছে না। তিনি বলেন, নিজ খরচে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরে এসে সাক্ষ্য দিতে হয় সাক্ষীদের। গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে শহরে এসে হোটেলে অবস্থান করে নিজ খরচে সাক্ষ্য দেয়া অনেক কষ্টকর ও ব্যয়সাধ্য। ফৌজদারি মামলায় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক সাক্ষী থাকেন। কোনো কোনো মামলায় একবার সাক্ষ্য দেয়ার পর আদালত আবার সাক্ষী তলব করেন। আবার পুলিশ সাক্ষীদের একটা অংশ অবসরজনিত কারণে নিজ জেলায় চলে যান। ফলে দূরের জেলা থেকে কমর্স্থলের জেলায় সাক্ষী দিতে তাদের অনেক টাকার দরকার হয়। এসব কারণে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা দেখান।

সাক্ষীদের অসহযোগিতার কারণে মামলাজট যে কীভাবে বাড়ছে চট্টগ্রাম আদালতের কিছু তথ্যের দিকে নজর দিলে তা স্পষ্ট হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীর আটটি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৬ হাজার ৪১৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় চলতি বছরের জুলাই মাস পযর্ন্ত ৮ হাজার ৭৪৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলার ১৩টি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৫ হাজার ৩৯৩টি মামলা বিচারাধীন আছে। গত জুলাই পযর্ন্ত এসব মামলায় ১০ হাজার ৫০৭ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ সাক্ষীদের মধ্যে যারা পুলিশে কমর্রত তাদের কেউ কেউ নিজের বিভাগ থেকে যাতায়াত ভাতা পেয়েছেন। তবে সাধারণ সাক্ষীসহ বেশিরভাগই কোনো ধরনের যাতায়াত ভাতা পাননি।

দেখা যায়, পুলিশ সাক্ষী থাকলে নিজ বিভাগ থেকে যাতায়াত খরচ দেয়া হয়। তবে অবসরে গেলে নিজ জেলা থেকে আদালতে আসা-যাওয়ার খরচ পাওয়ার সুযোগ থাকে না। ফলে টাকা খরচ করে সাক্ষ্য দিতে আসা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। যেমনটি সাধারণ সাক্ষীদের ক্ষেত্রেও সে ধরনের কোনো ভাতা দেয়া হয় না।

সাক্ষ্য দেয়ার আইনি বাধ্যবাধ্যকতা

দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের মামলাতেই সাক্ষীর আদালতে হাজির হওয়া বাধ্যতামূলক। ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কাযির্বধির ৩১ ধারা অনুসারে দেওয়ানি মামলার সাক্ষীদের প্রতি সমন জারি করা হয়। সাক্ষ্য প্রদান কিংবা কোনো দলিল-প্রমাণ আদালতের সামনে উত্থাপনের জন্য আদালত যে কাউকে তলব করতে পারে। আদালতের সমন পাওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে অবশ্যই আদালতে হাজির হতে হয়। কোনো সাক্ষী যদি এই নিদের্শ অমান্য করে, সে ক্ষেত্রে আদালতের সামনে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য আদালত প্রয়োজনবোধে সাক্ষীর প্রতি গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি করতে পারে। শুধু তাই নয়, আদালত এমনকি তার সম্পত্তি ক্রোক এবং বিক্রি, অনধিক ৫০০ টাকা জরিমানা, জামানত দাখিল কিংবা দেওয়ানি কারাগারে অন্তরীণ রেখেও সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে।

সাক্ষ্য না দিলে ফৌজদারি কাযির্বধির ৪৮৫ ও ৪৮৫ক ধারায় যথাক্রমে অনধিক সাতদিন জেল এবং ২৫০ টাকা জরিমানার বিধান (১৯৭৮ সালে সবের্শষ সংশোধিত) আছে। ৪৮৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ফৌজদারি আদালত কোনো সাক্ষী বা ব্যক্তিকে তার দখলের বা ক্ষমতার অন্তভুর্ক্ত কোনো দলিল বা বস্তু হাজির করতে বললে সে যদি তা হাজির করতে অস্বীকার করে বা তাকে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করে এবং এই অস্বীকৃতির জন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কৈফিয়ত না দেয়, তাহলে আদালত লিখিতভাবে কারণ লিপিবদ্ধ করে তাকে সাত দিনের অনধিক যে কোনো সময়ের জন্য বিনাশ্রম কারাদÐ দিতে পারে অথবা ম্যাজিস্ট্রেট বা জজের স্বাক্ষরিত পরোয়ানা দ্বারা তাকে সাত দিনের অনধিক যে কোনো সময়ের জন্য আদালতের রায়ে অফিসারের হেফাজতে আটক রাখতে পারবেন, যদি না ওই ব্যক্তি ইতোমধ্যে জবানবন্দি দিতে ও জবাব দিতে অথবা দলিল বা বস্তু হাজির করতে সম্মত হয়। ওই ব্যক্তি যদি তার অস্বীকৃতিতে অবিচল থাকে তাহলে ৪৮০ বা ১৮২ ধারা অনুসারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে এবং হাইকোটর্ বিভাগের ক্ষেত্রে তাকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে।

৪৮৫ক ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সাক্ষীকে কোনো ফৌজদারি আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয় এবং সে অনুযায়ী কোনো নিদির্ষ্ট স্থানে ও সময়ে হাজির হতে আনত বাধ্য হওয়া সত্তে¡ও কোনো বৈধ কারণ ছাড়া হাজির হতে অবহেলা করে বা অথবা সেখান থেকে নিধাির্রত সময়ের আগে বেআইনিভাবে চলে যায়, তাহলে যে আদালতের কাছে ওই সাক্ষী হাজির হতে বাধ্য সেই আদালত যদি বিবেচনা করে যে, ন্যায়বিচারের স্বাথের্ এরকম সাক্ষীর সংক্ষিপ্ত বিচার হওয়া উচিত, তাহলে ওই আদালত এই অপরাধ আমলে নেবেন এবং ওই অপরাধীকে কেন এই ধারা অনুসারে শাস্তি দেয়া হবে না, তার কারণ দশাের্নার সুযোগ দিয়ে অনধিক ২৫০ টাকা জরিমানা করবেন।

সাক্ষীদের খরচের ব্যাপারে আইন কী বলে?

১৮৯৮ সালে প্রণয়ন করা ফৌজদারি কাযির্বধি আইনের ৫৪৪ ধারায় বাদী এবং সাক্ষীদের খরচ দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, সরকার কতৃর্ক কোনো নিয়ম প্রণয়ন সাপেক্ষে যে কোনো ফৌজদারি আদালত যদি যথাথর্ মনে করেন তাহলে তদন্ত, বিচার বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে উপস্থিত বাদী বা সাক্ষীদের যুক্তিসঙ্গত খরচ সরকারের পক্ষ থেকে দেয়ার আদেশ দিতে পারবেন। তবে এই আইনে বলা হয়েছে সরকারের প্রণয়ন করা কোনো বিধি সাপেক্ষে এই খরচ দেয়া যাবে। কিন্তু আইনটি প্রণয়নের একশ বছর পরও কোনো বিধি প্রণয়ন করেনি দেশের কোনো সরকার।

তবে ১৯৮২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ও একই বছরের ৬ অক্টোবর তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বতর্মান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) সংস্থাপন বিভাগ দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সাক্ষীদের দৈনিক খাবার বাবদ ২০ টাকা, রাত্রি অবস্থানের জন্য হোটেল খরচ বাবদ ১০ টাকা, ৫ মাইলের মধ্যে আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়া ৫ টাকা, ১০ মাইলের মধ্যে সাড়ে ৭ টাকা, ২০ মাইলের মধ্যে সাড়ে ১২ টাকা ও ২০ মাইলের অধিকের জন্য ১৫ টাকা গাড়ি ভাড়া বাবদ খরচ দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল।

২০১৭ সালের মে মাসে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বাজেটে সাক্ষীদের খরচ বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছে একটি চিঠিও লিখেছিলেন। কিন্তু সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি বলে। এতে মামলাজট পরিস্থিতিরও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

সাক্ষীদের ভাতা চাইলে সরকারি কেঁৗসুলি আদায় করে দিতে পারেন। সাক্ষীর যাতায়াতসহ আনুষঙ্গিক খরচের বিল আদালত থেকে অনুমোদন করে সাক্ষীকে দেয়া সংশ্লিষ্ট মামলার সরকারি কৌঁসুলির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সাক্ষীরা যাতায়াত খরচ পাওয়া তো দূরের কথা উপযুক্ত সম্মানও পান না। তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসলে আইনজীবী একদিকে যেতে বলে তো, পুলিশ আরেক দিকে যেতে বলে। তার ওপর পুলিশ সাক্ষীদের কাছ থেকে উল্টো খরচের টাকা হাতিয়ে নেয়। অবস্থা এমন যে সাক্ষী হয়ে যেন বড় অপরাধ করেছেন তারা।

অনুপস্থিত সাক্ষীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক বিধানগুলো কাযর্কর করার আগে তাদের ন্যায্য যাতায়াত ভাতা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। সাক্ষী ভাতা নিশ্চিত করা গেলে বেসরকারি সাক্ষী হাজিরা কমপক্ষে দ্বিগুণ বাড়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<15244 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1