বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাল দলিল চেনার উপায় ও প্রতিকার

দলিল জালিয়াতি করে অন্যের সম্পত্তি দখল এবং পরে সেটি নিয়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা করার বহু ঘটনা আমাদের সমাজে দেখা যায়। জাল দলিল চেনার উপায় কিংবা একটি দলিলের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের উপায় সম্পকের্ অজ্ঞতা এবং চিহ্নিত জাল দলিলের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকারের বিষয়টি সম্পকের্ না জানার ফলে অনেকেই অধিকারবঞ্চিত হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন আবরার মাসুদ
নতুনধারা
  ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

কামরুল ইসলাম তার একটি জমি খাইরুল ইসলামকে হেবা দলিলের মাধ্যমে প্রদান করে। খাইরুল ইসলাম সেই জমিটি গোলাম মোস্তফার নামে উইল করে মারা যায়। খাইরুল ইসলামের মৃত্যুর পর উইলমূলে জমিটির মালিক গোলাম মোস্তফা হওয়ার কথা থাকলেও সে জমিটির দখল নেয়ার আগেই ইমরুল নামের এক ব্যক্তি জমিটির দখল গ্রহণ করে এবং এই মমের্ একটি জাল দলিল পেশ করে যে, তার পক্ষে জিম্মাদার বা ট্রাস্টি হিসেবে খাইরুল ইসলামকে কামরুল ইসলাম জমিটি হস্তান্তর করেছিল। অথার্ৎ ইমরুলের দাবি হলো সবর্প্রথম কামরুল ইসলাম যখন জমিটি খাইরুল ইসলামকে প্রদান করেছিল, তখন সেই হস্তান্তরের উদ্দেশ্য ছিল ইমরুলের কল্যাণাথের্ ট্রাস্ট তৈরি করা। সুতরাং খাইরুলের মৃত্যুর পর ইমরুলই এই জমির মালিক। ইমরুল তার দাবির পক্ষে একটি জাল ট্রাস্ট দলিলও তৈরি করে। এখন গোলাম মোস্তফা ইমরুলের এই জাল দলিলের বিরুদ্ধে কী প্রতিকার পেতে পারে?

দলিল যেভাবে জাল হতে পারে

এজমালি সম্পত্তি অথার্ৎ ভাইবোন মিলে যে সম্পত্তি ভোগ করে থাকে, এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভাইয়েরা বোনদের না জানিয়ে বাটোয়ারা দলিল তাদের নামেই করিয়ে থাকে। মালিকানা ছাড়াই দলিলদাতা সেজে বা কাউকে মালিক সাজিয়ে জমি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রি করে নেয়া হয়। অনেক সময় অপির্ত সম্পত্তি বা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি জীবিত দেখিয়ে জাল করা হয়। সাধারণত যেসব ক্ষেত্রে আদালত থেকে বণ্টননামা সম্পন্ন করা হয় না, সে ক্ষেত্রে দলিল জালের সম্ভাবনা বেশি থাকে। মালিক বিদেশে থাকলে মূল দলিল থেকে জালিয়াতি করা হতে পারে। অনেক সময় ঘষামাজা করে এবং ওভাররাইটিং বা কাটাছেঁড়া করেও দলিল জাল করতে পারে। আবার মূল তারিখ ঠিক রেখে দলিলের বিষয়বস্তু জাল করতে পারে।

দলিল জাল কি-না বোঝার উপায়

১। কোনো দলিল নিয়ে সন্দেহ হলে রেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষণ করা দলিলের সঙ্গে সাল মিলিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য নিদির্ষ্টভাবে দরখাস্ত করতে হবে। এতে দলিলটির যাবতীয় তথ্য দিতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলের প্রকৃতি অনুযায়ী চারটি রেজিস্ট্রার বা ভলিউমে সংরক্ষিত থাকে। ২। বিক্রেতার কাছ থেকে সব দলিল, বিশেষ করে বায়া দলিল চেয়ে নিতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জানতে হবে সব দলিলের ক্রমিক নম্বর, দলিল নম্বর ঠিক আছে কিনা। ৩। সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) অফিস থেকে জমির মিউটেশন বা নামজারি সম্পকের্ খেঁাজ নিতে হবে। নামজারিতে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কিনা, পযের্বক্ষণ করুন। যদি দেখা যায়, সিএস জরিপের সঙ্গে বিক্রেতার খতিয়ানের কোনো গরমিল থাকলে ধরে নিতে হবে সমস্যা আছে। ৪। দলিল সম্পাদনের সময় ব্যবহৃত স্ট্যাম্পের পেছনে কোন ভেন্ডার থেকে স্ট্যাম্প কেনা হয়েছে এবং কার নামে কেনা হয়েছে খেয়াল রাখুন। প্রতিটি স্ট্যাম্পের পেছনে একটি ক্রমিক নম্বর উল্লেখ থাকে। এ নম্বরটি ঠিক আছে কিনা, প্রয়োজনে স্ট্যাম্প বিক্রেতার সঙ্গে দেখা করে যাচাই করে নিন। ৫। একাধিক মালিকের ক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মূল মালিক কে, তা নিণর্য় করতে হবে। ৬। ভ‚মি অফিস থেকে বিভিন্ন সিল পরীক্ষা করেও জালিয়াতি নিণর্য় করা যায়। ৭। অনেক সময় স্বাক্ষর জালিয়াতি করে দলিলদাতা বা গ্রহীতার সাজা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করিয়ে নেয়া যেতে পারে। ৮। ভালো করে তারিখ, কাগজ, সিল ইত্যাদি লক্ষ্য করুন। দেখুন কোনো অসংলগ্ন চোখে পড়ে কিনা। ৯। জরিপ খতিয়ানে জমির পরিমাণ পরবতীর্ সময়ে যতবার বিক্রি হয়েছে, তার সঙ্গে জমির পরিমাণ মিল আছে কিনা, তা যাচাই করুন। দাগ নম্বর, ঠিকানা এসব ঠিক আছে কিনা, পরীক্ষা করুন। ১০। সম্প্রতি কোনো আমমোক্তারনামা দলিল থাকলে তাতে উভয় পক্ষের ছবি ব্যবহার হয়েছে কিনা যাচাই করতে হবে। ১১। কোনো দান করা জমি হলে দলিলে সম্পাদনের তারিখ দেখে কবে জমিতে গ্রহীতা দখলে গেছে তা যাচাই করতে হবে। দলিলটি রেজিস্ট্রি করা কিনা এবং দলিলদাতার সঙ্গে গ্রহীতার সম্পকর্ কী, তা যাচাই করতে হবে। ১২। সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া কোনো বিক্রীত দলিলের দলিল লেখকের নাম ঠিকানা জেনে সরেজমিন কথা বলে নেয়া দরকার।

জাল দলিল বাতিল করতে হয় কীভাবে?

মনে করুন, আপনার একটি দলিল বা আইনি ডকুমেন্ট ছিল, যা অন্যের হস্তগত হয়েছে, কিংবা সেটির এমন পযাের্য় রয়েছে, যার কাযর্কারিতা বহাল থাকলে আপনার জন্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। দলিল বাতিল করার এরকম কোনো প্রয়োজন পড়লে, আদালতের শরণাপন্ন হয়ে কাজটি করা যায়। আমাদের সুনিদির্ষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯নং ধারা হতে ৪১নং ধারা পযর্ন্ত আদালত কতৃর্ক দলিলাদি বাতিলীকরণ সম্পকের্ বিধান বণির্ত হয়েছে। সুনিদির্ষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে লিখিত চুক্তি অবৈধ বা বাতিলযোগ্য, যার যুক্তিসঙ্গত আশঙ্কা রয়েছে যে, তেমন দলিল যদি অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে সেটি তার গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি তা বাতিল বা বাতিলযোগ্য ঘোষণার জন্য মামলা দায়ের করতে পারেন এবং আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে তেমন রায় প্রদান করতে এবং ‘চুক্তি বিলুপ্ত’ হিসেবে ত্যাগ করার নিদের্শ প্রদান করতে পারেন।

দলিলটি যদি রেজিস্ট্রেশন আইন অনুসারে রেজিস্ট্রিকৃত হয়ে থাকে, তাহলে আদালত ডিক্রির একটি কপি সেই সংশ্লিষ্ট অফিসারের কাছে প্রেরণ করবেন, যার অফিসে ওই দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে এবং সেই অফিসার সেই বইয়ে দলিলের নকলে সেটির বিলুপ্তির বিষয় লিপিবদ্ধ করবেন। তামাদি আইন, ১৯০৮-এর ৯১ ধারা অনুসারে যে দলিল বাতিলের জন্য প্রাথর্না করা হয়, সে দলিল সম্পকের্ জানার বা অবগত হওয়ার তিন বছরের মধ্যে মামলা দাখিল করতে হবে, নয়তো এধরনের মামলা তামাদি হয়ে যাবে এবং এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না।

অবশ্য এধরনের মামলা তামাদি হয়ে গেলে সুনিদির্ষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা অনুসারে ‘ডিক্লেরেশন মামলা’ বা ‘ঘোষণামূলক মোকদ্দমা’ দায়ের করে ভিন্নভাবে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে। নালিশি দলিলে যিনি পক্ষে থেকে ওই দলিলে রদ বা বাতিলের জন্য মামলা করেন, সে ক্ষেত্রে কোটর্ ফি অ্যাক্টের বিধান মতে ‘অ্যাডভোলেরম কোটর্ ফি’ প্রদান করে মামলা দায়ের করতে হবে। বাদী যদি নালিশি কবলায় কোনো পক্ষ না থাকেন এবং ওই দলিল তার ওপর বাধ্যকর নয় মমের্ বিজ্ঞাপনী ডিক্রির প্রাথর্না করেন, সে ক্ষেত্রে নিধাির্রত কোটর্ ফি প্রদানে মামলা করা যাবে।

৩৯ ডিএলআরের ‘সুফিয়া খানম চৌধুরী বনাম ফাইজুন্নেছা চৌধুরী মামলা’র সিদ্ধান্ত অনুসারে, কোনো দলিল রদের প্রাথর্না ছাড়াই শুধু ওই দলিল বাতিল মমের্ ঘোষণার মামলা চলতে পারে। তবে যদি দেখা যায় যে, সুনিদির্ষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা অনুসারে ওই দলিল রদের ঘোষণা দরকার কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রাথর্না করা হয়নি, সে ক্ষেত্রে বাদীকে অতিরিক্ত কোটর্ ফি প্রদান করতে বলা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<19976 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1