বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপরিণত প্রেম, অভিভাবকদের অদূরদশির্তা ও জেল

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

রুনা ও সুজন (ছদ্মনাম)। একে অন্যকে ভালোবাসে। একজন কলেজপড়–য়া যুবক; অন্যজন স্কুলপড়–য়া কিশোরী। ছেলেটি প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা ও সমাজসেবী নামে এলাকায় পরিচিত। অন্যদিকে মেয়েটি মেধাবী বিতাকির্ক বলে খ্যাতি রয়েছে। বাবা হাটের্র বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর মা অধ্যাপিকা। মেয়ের পরিবার এ অসম প্রেম মেনে নিতে পারেনি। সম্পকের্র শুরু থেকেই বঁাধা আসে তথাগত অভিজাত উচ্চবিত্ত গবির্ত পরিবারের পক্ষ থেকে। তীক্ষè নজর রাখে তারা। কিন্তু তাদের রক্তচক্ষু, অত্যাচার আর শাসনের লৌহকঠিন শেকলের বন্ধন মেয়েটিকে তার ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছাকে উসকে দেয়।

অভিভাবকদের কড়া নজরদারীকে ফঁাকি দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমায়। শিক্ষিত অথির্বত্তশালী অভিজাত ও প্রভাবশালী পরিবার এ ঘটনায় বিপযর্স্ত হয়ে পড়ে। যে কোনো মূল্যেই তারা কিশোরী মেয়েকে অসম প্রেমের কবল থেকে উদ্ধারে সবর্শক্তি নিয়োগ করে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে প্রেমিক ছেলে, ছেলের মা-বাবাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইনের ৭ ধারায় থানা মামলা রেকডর্ করেন। পুলিশ ছেলের মা-বাবাসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের জেলহাজতে পাঠানোর নিদের্শ দেন। কারণ প্রথমত জামিন অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত এ মামলায় জামিন দেয়ার এখতিয়ার সাধারণত নি¤œ আদালতের নেই।

৭ ধারায় নারী ও শিশু অপহরণের শাস্তি সম্পকের্ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদÐে বা অন্যূন ১৪ বছর সশ্রম কারাদÐে দÐনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অথর্দÐে দÐনীয় হবে।

কিন্তু টিনএজার প্রেমিক-প্রেমিকার বেশিদিন পালিয়ে থাকা হলো না। তারা স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমপর্ণ করে। মেয়ের বাবা মা, তাদের উকিল কিশোরী মেয়েকে দিয়ে ‘জোরপূবর্ক তাকে অপহরণ করা হয়েছে’ এ সাক্ষ্য দিতে বলা হলো। কিন্তু কিশোর প্রেমে দায়বদ্ধ মেয়েটি ২২ ধারার জবানবন্দিতে আদালতে উল্টো সাক্ষ্য দিল। তাকে অপরহরণ করা হয়নি, সে স্বেচ্ছায় তার প্রেমিক বন্ধুর সঙ্গে গেছে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পকর্ রয়েছে। জবানবন্দিতে তাদের প্রেমের সম্পকর্ জানার পর তার সঙ্গে বাবা-মায়ের অত্যাচারের কথা মেয়েটি জানায়। মা তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করে, বাবা বেল্ট দিয়ে প্রহার করে, ঘুমের মধ্যে ইনজেশন দেয়ার ঘটনাও তুলে ধরে। অভিভাবকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। তারা দেড় মাস ঘর-সংসারও করে। প্রেমিকের বাবা-মা ও পরিবারের প্রতি তার বাবা যে অভিযোগ এনেছেন তা পুরো মিথ্যা।

আদালত তাকে তার বাবা মায়ের হেফাজতে দিতে চাইলেও সে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে আদালত তাকে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সেফহোমে পাঠায়। সেই সেফহোম থেকে জেদি এই মেয়েটি গোল্ডেনসহ জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পাস করে।

এদিকে থানা পুলিশ ওই মামলায় প্রেমিককে অপহরণকারী ও তার বাবা-মাসহ চারজনকে সহায়তাকারী অভিযুক্ত করে ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চাজির্শট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে। তবে ভিকটিমের জবানবন্দির প্রেক্ষিতে আদালত সুজন ও তার বাবা-মাসহ আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন। সুজন এসময়ে এইচএসসি পাস করে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) ভতির্ হয়ে লেখাপড়া চালাতে থাকে। সে এবং তার বন্ধুরা মিলে ‘আতর্নাদ’ নামে স্থানীয়ভাবে একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলে নানা সামাজিক কমর্কাÐ বাস্তবায়ন করতে থাকে। সুজন আতর্নাদের বতর্মান কমিটির সভাপতি।

মামলাটির বিচার কাযর্ক্রম চলার পযাের্য় ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে শিশু আদালতের বিচারক সুজনকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নিযার্তন দমন আইনের ৭ ধারায় অপহরণের দায়ে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদÐাদেশ ঘোষণা করেন। অন্য চার আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। উল্লেখ্য, ভিকটিম রুনা মাইনর (কম বয়স) হওয়ায় তার জবানবন্দি আদালত আমলে নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।

আদালত তার রায়ে আরও জানান যে, ভিকটিম রুনা পূণর্বয়স্ক না হওয়া পযর্ন্ত সরকারি সেফ হোমে থাকবে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর নিজ জিম্মায় যেতে পারবে।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, এর আগেও মেয়েটি প্রেমিকের বাড়িতে চলে এলে সুজনের বাবা নিজে মেয়ের অভিভাবকদের ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও মেয়ের বাবা ডাক্তার সাহেব তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।

অন্যদিকে মেয়ের মায়ের বক্তব্য সুজনের পরিবার মেয়েটির এমনভাবে ব্রেনওয়াশ করেছেন যে, মেয়েটি তার পরিবারের স্ট্যাটাস ভুলে জেদ আর মিথ্যা আবেগে আবদ্ধ হয়ে গেছে। একদিন সে তার ভুল বুঝতে পারবে। তার মেয়ে মেধাবী, নাচে, গানে, বিতকের্ তুখোড়। সুজনের শাস্তি প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, আল্লার দোয়ায় সঠিক বিচার হয়েছে।

এদিকে কিশোরী প্রেমিকাও অভিমানে ফিরে যায়নি তার বাবা মায়ের কাছে। আশ্রয় নিয়েছে সরকারি সেফ হোমে। এভাবেই করুণ পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে দুটি তরুণ প্রাণকে। বিচারকের দেয়া রায় মাথায় নিয়ে প্রেমিকযুগল চলে গেছে কারাগারে আর মেয়ে সেফ হোমে। প্রেমের বঁাধনকে তারা অটুট রেখেছে। কিশোরী প্রেমিকাকে বাবা-মা ও অন্য অভিভাবকদের রক্তচক্ষু, শত অত্যাচার, নানা প্রলোভন একটুও টলাতে পারেনি। চিড় ধরাতে পারেনি তাদের ভালোবাসায়। তাদের কাহিনী যেন হার মানায় যে কোনো সিনেমার চরিত্রকে।

দুটি নিষ্পাপ প্রাণের ভালোবাসাকে মূল্যায়ন না করা, অভিভাবকদের অদূরদশির্তা অন্যদিকে পরামশর্ ও প্রশ্রয় দাতাদের ভুলের কারণে রুনা ও সুজনের ভালোবাসার গøানি বয়ে বেড়াতে হবে জীবনান্তর।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<19979 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1