বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুসলিম আইনে বিবাহ ও দেনমোহর প্রাসঙ্গিক আইনি আলোচনা

বিবাহ মানবসভ্যতার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে যে খেতাব লাভ করেছে তাতেও অবদান বিবাহর। পৃথিবী সৃষ্টির আদি থেকে মানব ধারার সুশৃঙ্খল বিন্যাস কেবল বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের জন্যই টিকে আছে। বিবাহ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে মূলত ধর্মীয় প্রভাবে। বাংলাদেশে বিবাহপ্রথাও মূলত গড়ে উঠেছে ধর্মীয় আইনের ওপর ভিত্তি করে। মুসলিম আইনে বিবাহ ও দেনমোহর নিয়ে দুই পর্বের প্রাসঙ্গিক আইনি আলোচনার আজ শেষ পর্ব। লিখেছেন উদয় তাসমির-
নতুনধারা
  ১২ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

দেনমোহর, আলস্নাহতায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত একটি বিশেষ বিধান যা একজন বিবাহিত মুসলিম নারীর বিশেষ অধিকার হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। বিশেষভাবে উলেস্নখ করা প্রয়োজন যে, বিবাহ কোনো সাধারণ পণ্যের চুক্তি নয় এবং দেনমোহরও কোনো পণ্যের চুক্তিমূল্য নয় বরং এটি একজন স্বামীর ওপর অর্পিত একটি দায়িত্ব একই সঙ্গে একজন স্ত্রীর অধিকার যা পবিত্র কোরআন দ্বারা স্বীকৃত।

গাম্প্রতিক সময়ে বিবাহকে সহজ করার নামে দেনমোহরের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধান নিয়ে কেউ কেউ বলতে চান, কোরআনের কিছু অংশ মুখস্থ করে তেলাওয়াত করে শুনিয়ে দিয়ে দেনমোহর আদায় কওে নেবে অথচ দেনমোহর আদায়ের নূ্যনতম সামর্থ্য তাদের রয়েছে। এটি অত্যন্ত ভুল একটি পন্থা। হাদিস থেকে জানা যায় এ অবস্থা তখনই গ্রহণযোগ্য যখন একজন মানুষ এতটাই সামর্থ্যহীন যে একটি লোহার আংটিও গড়িয়ে দেয়ার সামর্থ্য তিনি রাখেন না। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণস্বরূপ এবং অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। বিবাহের সময় প্রতিদানস্বরূপ বর কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে সম্মত অথবা গৃহীত কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে মোহর বলে। বিবাহের সময়ে বা আগে এই দেনমোহর স্থির হয়। অবশ্য পরেও করা যেতে পারে।

দেনমোহরের সংজ্ঞায়নে ডিএফ মোলস্না বলেন, 'মোহর বা মোহরানা হলো কিছু টাকা বা অন্য কিছু সম্পত্তি যা বিবাহের প্রতিদানস্বরূপ স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পাওয়ার অধিকারী। দেনমোহরকে বিবাহ-চুক্তির মূল্য বা শর্ত বলা চলে না (মুসলিম বিবাহে কোনো শর্ত থাকে না)।' সহজ কথায় এমন বস্তু যার আর্থিক মূল্য আছে। বর্তমান সময়ের ইসলামী তাত্ত্বিকরা স্ত্রীকে পড়াশোনা করানোকেও দেনমোহর আদায়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন যেহেতু এখন পড়াশোনার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সুযোগ হয়েছে। ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী মোহর আদায় প্রতিটি স্বামীর জন্য ফরজ। দেনমোহর স্বামীর জন্য একটি ঋণ, সর্বাবস্থায় দেনমোহর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।

রাসুল (সা.) বলেছেন 'যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে মোহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিবাহ করেছে, কিন্তু সে মোহরানা দিতে তার ইচ্ছে নেই, কেয়ামতের দিন সে আলস্নাহর সামনে অপরাধী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে' (মুসনাদে আহমদ)। লাহোর ও এলাহাবাদ হাইকোর্ট দেনমোহরকে স্ত্রীর মর্যাদাস্বরূপ বলে বিচার করেছেন অর্থাৎ এটি হলো আইনগত স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা। বিবাহ-চুক্তিতে যদি লেখাও থাকে দেনমোহর দিতে হবে না; সে ক্ষেত্রেও দেনমোহর স্ত্রীর প্রাপ্য। অন্যপক্ষে কলকাতা হাইকোর্টের মতে, দেনমোহর হলো সম্পত্তির মূল্য।

মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন হিসেবে স্বামীর ওপর আরোপিত একটি দায়িত্ব। দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তার স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ (২১ ডিএলআর) মামলায় মহামান্য বিচারপতি কর্তৃক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, 'সহবাসের আগে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর কাছে তলবী মোহরানার দাবি করতে পারে এবং স্বামী তলবী দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্ত্রী তার স্বামীর অধিকারে অর্থাৎ সহবাসে যেতে স্ত্রী অস্বীকার করতে পারেন।' স্বামী এহেন মোহরানা পরিশোধ ছাড়া দাম্পত্য অধিকারের ডিক্রি পেতে পারে না। যে কোনো বিষয় সম্পত্তি মোহরানার জন্য ধার্য করা যায় না। তা হতে পারে নগদ অর্থ, কোনো বীমা পলিসি বা অন্য কোনো দ্রব্য সামগ্রী। তবে কোনো হারাম বস্তু হতে পারবে না। স্বামীর দখলে নেই এমন কোনো সম্পত্তি পারে না। ভবিষ্যৎ কোনো বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না।

দেনমোহরের পরিমাণ কীভাবে নির্ধারণ পদ্ধতি

দেনমোহরের পরিমাণ সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হয়নি। তাই তা আপেক্ষিক। সাধারণত দেখা যায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। বিষয়গুলো হলো- স্ত্রীর পারিবারিক অবস্থা ও বংশ মর্যাদা, স্ত্রীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা, স্ত্রীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, এবং স্ত্রীর পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের (যেমন- ফুফু, খালা, বোন) দেনমোহরের পরিমাণ।

অন্যদিকে বরের আর্থিক ক্ষমতার দিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়। এসব দিক বিচার-বিবেচনা করেই মূলত দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী দেনমোহর দেয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কাবিনে বিস্তারিত উলেস্নখ না থাকলেও স্ত্রী চাওয়ামাত্র সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। হানাফি মাযহাবে দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারিত করা হয় ১০ দিরহাম বা ২.৭৫ তোলা রুপা। ১ তোলা রুপার মূল্য সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা হিসেবে সর্বনিম্ন দেনমোহরের পরিমাণ দাঁড়ায় (২.৭৫*১৫০০= ৪১২৫/-)। তবে দেনমোহরের কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত নেই।

দেনমোহর বাবদ দেয়া অর্থকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। 'তাৎক্ষণিক' যা চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য এবং অন্যটি 'বিলম্বিত' দেনমোহর-যা মৃতু্য অথবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদে পরিশোধযোগ্য।

দেনমোহর নিয়ে আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর একটি হলো শুধু স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদকালেই দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়। অথচ এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি রীতি যার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। আইন অনুযায়ী স্ত্রী চাওয়ামাত্র সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। সালিশি পরিষদের আদেশ বলে এটি কার্যকর হলে স্ত্রীর তা পাওনা হয়ে যায়। পরিশোধ না করলে ১ মাস কারাদন্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।

\হ

স্ত্রী কর্তৃক তালাক বা স্বামীর মৃতু্যর আগে দেনমোহর দাবি উত্থাপন

তালাক বা স্বামীর মৃতু্যর আগেই স্ত্রী দেনমোহর দাবি করতে পারে এবং স্বামী তখন নির্ধারিত দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ তাই যে কোনো সময় স্ত্রী তা দাবি করতে পারে। স্বামী দাম্পত্য মিলনের আগে স্ত্রীকে তালাক দিলে দেনমোহরের পরিমাণ অর্ধেক হবে। কিন্তু দাম্পত্য মিলনের আগে স্বামীর মৃতু্য হলে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহরে প্রদান করতে হবে।

স্বামীর মৃতু্যর পর বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তির দখলে থাকলে তার স্বামীর অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তিতে নিজ নিজ প্রাপ্য অংশের আনুপাতিক হারে দেনমোহর ঋণ পরিশোধ করার পর পৃথকভাবে স্ব স্ব অংশ উদ্ধার করতে পারবে। যদি স্বামীর উত্তরাধিকারীরা স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।

লেখক : অ্যাসোসিয়েট, বিঅ্যান্ডএম লিগ্যাল :রঁফড়ু@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<40503 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1