ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে নারী ম্যাজিস্ট্রেট রাখার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সারাদেশের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
প্রধান বিচারপতির আদেশক্রমে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটনে ওয়াকিবহাল ব্যক্তির জবানবন্দি ওই আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়। অপরাধের তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে লিপিবদ্ধকৃত ওই জবানবন্দি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। স্পেশাল কমিটি ফর জুডিশিয়াল রিফর্মসের গোচরীভূত হয়েছে যে, বর্তমানে বেশকিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী বা শিশুদের জবানবন্দি পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। একজন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নারী বা শিশু ভিকটিম ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিতে সংকোচবোধ করে। ফলে এরূপ নির্যাতনের শিকার শিশু বা নারী ঘটনার প্রকৃত বিবরণ দিতে অনেক সময় ইতস্তত বোধ করে।
সার্কুলারে বলা হয়, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা আবশ্যক। এতে নারী ও শিশু ভিকটিমরা সহজে ও নিঃসঙ্কোচে তাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে পারবে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এ আদেশ নিয়ে যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে পত্রিকার কলাম, টেলিভিশন টক-শো পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরও কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতাটা ভিন্ন। বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, 'যে কোনো জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসি দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন, 'আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে।
আইনের ভাষায়, নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে অপরাধ প্রমাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূূর্ণ ও কার্যকর প্রমাণ হিসেবে ডাক্তারি পরীক্ষার সনদপত্রকে বিবেচনা করা হয়। শনাক্তকৃত আলামত অভিযুক্তের কিনা তা প্রমাণ করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। বাস্তবে নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন প্রতিকারে মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক নয়। আইন বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার জন্যই নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে একদিকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে অপরাধীরা উৎসাহিত বোধ করে।
পারিবারিক নির্যাতন, সহিংসতা, ধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানিসহ নারী ভিকটিমদের সহায়তা দিতে নারী পুলিশ কর্মকর্তা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে নারী ভিকটিমরা সব বিষয় খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন না। এ ছাড়া কোনো নারী খুন হলে তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তাকে সমস্যায় পড়তে হয়। ধর্ষণ, হত্যা, দুর্ঘটনার মামলা অথবা ছেলে বা মেয়ের বয়স নির্ধারণে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে সনদ নিতে হয়। আইনের চোখে এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অনেকে মনে করেন, এ দলিল পেতে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হন নারী। অবাক করার বিষয় যে, দেশের কোনো হাসপাতালেই নারীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য পৃথক কক্ষ নেই। চিকিৎসকদের বসার কক্ষে পুরুষ চিকিৎসক ওয়ার্ডবয়ের সহযোগিতায় সেখানেই ভিকটিমের শারীরিক পরীক্ষা করেন।
সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। কারণ এ ধারা প্রয়োগ করলে ধর্ষিতার অতীত যৌনজীবন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় একটি বিষয়। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোর বিচারকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এই দেশে আছে।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো 'নারীর বিচারিক প্রক্রিয়া যেন সকল ক্ষেত্রে নারীই উপজীব্য হয়ে ওঠে।' সেদিন আমাদের সংবিধানের শাশ্বত বাণী চিরন্তন রূপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা।