মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হিন্দু বিবাহ আইনে বৈষম্য ও সম্ভাব্য সমাধান

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ২৪ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

আমাদের পবিত্র সংবিধানে বলা আছে ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং কোনোরকমের বৈষম্য ছাড়াই সবাই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সবর্স্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।’ সেই সঙ্গে ধমর্, বণর্, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ ভেদে অথবা জন্মস্থানের কারণে কারও প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৭ ধারায় উল্লেখ আছে যে, সব নাগরিক সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। তবে সংবিধানে বণির্ত এই সমান অধিকার বা সমান আইনি প্রতিকার পাওয়ার অধিকার শুধু সংবিধানের কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, বাস্তবতায় রয়েছে ভিন্নতা।

কুষ্টিয়ার মেয়ে অচর্না বিশ্বাসের সঙ্গে ঢাকার অনুপ বিশ্বাসের হিন্দু শাস্ত্রমতে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় নিয়ম ও প্রথা মেনে অচর্নার বাবা তন্ময় বিশ্বাস মেয়ের সুখের জন্য নগদ টাকা, ব্যবহাযর্ আসবাবপত্র ও স্বণার্লঙ্কার যৌতুক হিসেবে ছেলেকে প্রদান করেন। কিন্তু বিধিবাম! কয়েক বছর যেতে না যেতেই অনুপ বিশ্বাস প্রথম স্ত্রী অচর্না বিশ্বাসকে কোনো কিছু না জানিয়ে কিংবা তার অনুমতি ব্যতিরেকে আরেকটি বিয়ে করেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী রূপালী বিশ্বাসকে নিয়ে সুখে বসবাস শুরু করেন। এদিকে অচর্না বিশ্বাস দীঘির্দন ধরে স্বামী সংসারবিহীন নিদারুণ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। কিন্তু হিন্দু ধমের্র বিধান মতে সম্পকর্ ছিন্ন করার পরিষ্কার বিধান না থাকায় অচর্নাকে নিয়মকানুন মেনে চলতে হচ্ছে। হিন্দু আইনে তালাক দেয়ার কোনো প্রকার বিধান না থাকায় মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত অচর্না বিশ্বাসকে অনুপ বিশ্বাসের স্ত্রী হয়েই বেঁচে থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অচর্না বিশ্বাসের ভরণপোষণ কে দেবে? কীভাবে কাটবে তার বাকি জীবন। যদি তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে তবে কেন অচর্না বিশ্বাস পারবে না। এটি একটি মানবিক প্রশ্নের দাবিদার।

বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে হিন্দু নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কারণ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী, নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের যেমন অধিকার আছে (কাবিননামার ১৮ নাম্বার ঘরের শতর্ সাপেক্ষে), হিন্দুদের বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো আইন নাই। অথচ হিন্দু আইনে একজন পুরুষ যত ইচ্ছা বিয়ে করতে পারেন কিন্তু স্ত্রী চাইলেও বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন না। ভরণপোষণের ক্ষেত্রে অবশ্য দুই ধমের্ই ভরণপোষণসংক্রান্ত আইন রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্যমূলক আইন। মুসলিম আইনে নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন এবং সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার তাদের রয়েছে। কিন্তু হিন্দু আইনে উত্তরাধিকারী হলেও ক্ষেত্র খুবই সীমিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত দায়ভাগ মতবাদে হিন্দু নারীরা জীবনস্বত্বে এবং স্ত্রীর মালিকানাধীন এ দুভাবে উত্তরাধিকারী হতে পারেন। জীবনস্বত্বের ক্ষেত্রে এ সম্পত্তি কোনো নারী বেঁচে থাকা পযর্ন্ত ভোগদখলের এখতিয়ার লাভ করেন। কিন্তু আইনগত কারণ ছাড়া এ সম্পত্তি তিনি হস্তান্তর করতে পারেন না। তার মৃত্যুর পর ওই সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীর ওপর না বতিের্য় যার কাছ থেকে এটি পেয়েছিলেন তার নিকটবতীর্ উত্তরাধিকারীর কাছে চলে যায়। তবে স্ত্রীর নিজস্ব কোনো সম্পত্তি হলে তা তার উত্তরাধিকারীর মধ্যে বতাের্ত পারে। ভারতে ১৯৫৬ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত আইন পাস হওয়ার পর পিতার মৃত্যুর পর পুত্র ও কন্যা সমান অংশ লাভ করে। মুসলিম আইনে সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে পিতাই সন্তানের আইনানুগ অভিভাবক। তবে মা সন্তানের নিদির্ষ্ট বয়স পযর্ন্ত দেখাশোনা করতে পারেন। হিন্দু আইনে বাবার পর মা সন্তানের অভিভাবক হতে কোনো বঁাধা নেই।

তবে কোনো বিবাহিত হিন্দু নারীর যদি স্বামী মারা যায় তাহলে ওই বিধবা নারী ১৮৬৫ সালের হিন্দু বিধবা পুনবির্বাহ আইন অনুযায়ী আবার বিয়ে করতে পারবেন এবং এ বিয়ের ফলে যদি কোনো সন্তান জন্মলাভ করে তবে সে সন্তান বৈধ সন্তান বলে বিবেচিত হবে। তবে বিধবার আবার বিয়ে হলে সে তার আগের স্বামীর কাছে আইনের দৃষ্টিতে মৃত বলে গণ্য হন এবং সে কারণে পুনবির্বাহের ফলে তার সাবেক স্বামীর সম্পত্তির ওপর থেকে তিনি অধিকার হারান।

মূলত এজাতীয় সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য দরকার সাবর্জনীন পারিবারিক আইন। কারণ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ফৌজদারি কোনো অপরাধ যেমন চুরি, মারামারি কিংবা খুনের জন্য জাতি, ধমর্, বণর্ ও গোত্র ভেদে কোনোরকম বৈষম্য প্রদশর্ন করা না হয় তবে কেন বিয়ের ক্ষেত্রে এজাতীয় বৈষম্য মেয়েদের মেনে নিতে হবে। পাশাপাশি হিন্দু বিয়েতে রেজিস্ট্রেশনে বাধ্যতামূলক বিধান নেই ফলে বিয়ে, তালাক কিংবা একই স্বামীর একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনি সহায়তা পান না হিন্দু নারীরা। এভাবে হিন্দু নারীরা বিয়ের ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অথচ বিয়ের ক্ষেত্রে মুসলিম আইনে রয়েছে বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রির বিধান। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী, এ বিধান না মানা হলে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু নিযার্তনের শিকার হিন্দু নারীরা এ ক্ষেত্রে প্রতিকার পায় না। অথচ ভারতে হিন্দু বিয়েতে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সাবর্জনীন পারিবারিক আইন বা ইউনিফমর্ ফ্যামিলি কোড হচ্ছে নারী-পুরুষের সমান অধিকার রক্ষার জন্য নতুন আইন প্রণয়নের একটি সবার্ত্মক প্রচেষ্টা। আমাদের দেশে পারিবারিক ও দাম্পত্যবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা ও বিরোধের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা হয় এবং উল্লিখিত আইনগুলো মূলত ধমীর্য় বিধান মতে রচিত হওয়ায় এ দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধমার্বলম্বী যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আইন প্রচলিত রয়েছে, যার ফলে ধমের্ভদে নারীদের বৈষম্য পোহাতে হয়। তাই বাংলাদেশের নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য সাবর্জনীন পারিবারিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ বৈষম্য দূর করা যেতে পারে।

অন্যদিকে খ্রিস্টান ধমর্ মতে, বিয়ে সামাজিক বন্ধন। পাশাপাশি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধমর্ মতে বিয়ে একটি ধমীর্য় বিষয়। এ ছাড়া মুসলিম বিয়েতে স্ত্রীরা স্বামীর কাছ থেকে নিদির্ষ্ট পরিমাণ মোহরানা পায় এবং বিবাহবিচ্ছেদ হলে তিন মাসের খোরপোষ (ভরণপোষণ) পায়; কিন্তু অন্য ধমের্ এজাতীয় কোনো বিধান নেই। মুসলিম বিয়ে একটি চুক্তি হিসেবে গণ্য হওয়ায় বিয়ের কাবিননামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হয়। কিন্তু অন্য ধমের্র অনুসারী স্বামী যদি বিয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে তবে স্ত্রীর বিয়ে প্রমাণের কোনো উপায় থাকে না। তাই পারিবারিক বৈষম্য বন্ধে এখনই উপযুুক্ত সময় একটি ‘ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড’ প্রণয়নের।

হিন্দু সম্প্রদায়ের সুবিধাথের্ ১০০ টাকার মাধ্যমে ‘ডিক্লারেশন অব গিফট’ আইন পাস করা হয়েছে। এর ফলে হিন্দুরা তাদের মেয়েদের কোনো ধরনের জিনিস দিতে চাইলে মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে একটি দলিল করতে পারবে। প্রয়োজনে হিন্দু বিবাহবিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার বিষয়ে আইন প্রণয়নে পৃথক কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

বতর্মান সরকার নারীর অধিকারের সবোর্চ্চ সম্মানের কথা বিবেচনায় রেখে একটি ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিলে তা নারী বৈষম্য দূরীকরণে কাযর্কর ভ‚মিকা রাখবে। শুধু নারী নিযার্তন বন্ধ কিংবা নারী-পুরুষের সমান অধিকার বুলি ফোটালে হবে না, পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহণের এ উদ্যোগকে আরও সক্রিয় করতে হবে। তবেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, নারীর অধিকার হবে সমুন্নত।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা। ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<4779 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1