শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিয়ে, তালাক, দেনমোহরে নারী-পুরুষের বৈষম্য

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ১১ জুন ২০১৯, ০০:০০

বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনো কখনো তা অভিশাপরূপে দেখা দেয়। বিয়ে থেকে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনেই তালাকের সৃষ্টি। আইনে পুরুষদের বহুবিবাহের অনুমতি দিয়েছে। তালাকেও রয়েছে একচ্ছত্র অধিকার। নারীদের বেলায় বিবাহকালীন ভরণপোষণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা শর্ত। তালাক প্রাপ্তির পর ৯০ দিনের বাইরে ভরণপোষণ না পাওয়া রীতিমতো বৈষম্য।

বিবাহ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার। যেটা মুসলিম পারিবারিক আইনেও স্বীকৃত। কিন্তু বয়স্ক নারী যারা দীর্ঘসময় আগে বিয়ে করেছেন তাদের ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পত্তিতে নিজেদের অবদানের তুলনায় দেনমোহরের পরিমাণ খুব কম বলে প্রতীয়মান হয়। আবার যে সব ক্ষেত্রে অল্প বয়স্ক বিবাহিত নারীদের বেলায় অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে দেনমোহর ধার্য করা হয়েছে সেটি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। তাদের স্বামীরা কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নির্ধারিত দেনমোহর প্রদানের শর্তের বরখেলাপ করেছে। (হিউম্যান রাইট ওয়াচ, ২০১২, নারীর বঞ্চনা ও ক্ষতির উপাখ্যান, পৃষ্ঠা-৩৪)। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ে রেজিস্ট্রি না হওয়ার ছুতো ধরে দেনমোহর দিতে গড়িমসি করে। কারণ অরেজিস্ট্রিকৃত বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি করে। (ডা. আবদুল বনাম রোকেয়া, ২১ ডিএলআর, হাইকোর্ট,

পৃষ্ঠা-২১৩)।

বহুবিবাহ বৈষম্যের একটি মূল ভিত্তি হিসেবেও কাজ করে। যদিও ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ বহুবিবাহ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এই আইন অনুযায়ী একজন স্বামীকে তার সব স্ত্রীর প্রতি সমান ব্যবহার করতে হয়। বহু বিবাহের ক্ষেত্রে আগের স্ত্রী অথবা স্ত্রীগণের থেকে পরবর্তী বিবাহের জন্য সম্মতি নিতে হয়। কিন্তু কতজন নারী পরবর্তী বিবাহের সম্মতি দেন?

বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যত্ব, শারীরিক মারাত্মক দুর্বলতা, দাম্পত্য জীবন সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা, মানসিকভাবে অসুস্থতা ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে পারে। তবে স্ত্রীর অনুমতি বাধ্যতামূলক।

স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলেও প্রথম স্ত্রী সম্পূর্ণ মোহরানার টাকা দাবি করতে পারেন। স্বামী সম্পূর্ণ মোহরানার টাকা পরিশোধ করতে আইনত বাধ্য। আবার দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেললে দ্বিতীয় স্ত্রীকেও তার মোহরানাসহ যাবতীয় আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। উভয়পক্ষের সন্তানসন্ততিকেও প্রাপ্য ভরণপোষণ দিতে হবে। সব সন্তানই ভবিষ্যতে সমানভাবে উত্তরাধিকারীর সব অধিকার লাভ করবে।

তবে মনে রাখতে হবে, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে দ্বিতীয় বিয়েটি অবৈধ হয়ে যাবে না। কিন্তু স্বামীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী এবং বহুবিবাহের শিকার ৪০ জন মুসলিম নারীর কেউই বহুবিবাহে সম্মতি দেননি কিংবা কোনো সালিশি পরিষদের পর্যালোচনার সম্মুখীন হননি বলে জানিয়েছেন। (সূত্র : হিউম্যান রাইট ওয়াচ, ২০১২, নারীর বঞ্চনা ও ক্ষতির উপাখ্যান, পৃষ্ঠা-৭)।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয় সালিশি পরিষদের সদস্যরা খুবই অল্প প্রশিক্ষিত এবং সরকারও বহুবিবাহের বিধান অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করে না। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলেও এ সংক্রান্ত দলিলপত্রের সত্যতা যাচাই করা অনেক ক্ষেত্রে বেশ কঠিন, কারণ বিবাহ নিবন্ধনকারী সে সব দলিলপত্র হাতে লিখে সংরক্ষণ করেন এবং প্রায়ই সে সব দলিলপত্রে কারচুপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সে সব তথ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তথ্য সংরক্ষণের এই অব্যবস্থাপনাও পুরুষকে যথাযথ অনুমতি ছাড়া বহুবিবাহের সুযোগ তৈরি করে দেয়। (সূত্র: হিউম্যান রাইট ওয়াচ, ২০১২, বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন, পৃষ্ঠা-৬)।

তালাকের ক্ষেত্রেও মুসলিম পারিবারিক আইন নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশি সুযোগ তৈরি করে দেয়। সব মুসলিম পুরুষের তালাকের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ অধিকার রয়েছে। কিন্তু নারীদের বেলায় শুধু বিবাহ চুক্তিতে স্বামী কর্তৃক স্বীকৃত 'তালাকের অধিকারপ্রাপ্ত' হলেই তবে তালাক দিতে পারেন। সালিশি পরিষদের দ্বারা পর্যালোচিত হওয়ার পর মুসলমান পুরুষের তালাক কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও, এই প্রক্রিয়ায় বিবাহ তালাক কদাচিৎ ঘটে থাকে।

অন্যদিকে একজন নারী যখন তালাক চান তখন তাকে অবশ্যই তার স্বামীর সম্মতি নিশ্চিত করতে হয়। স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে তালাক ঘটাতে পারেন। যার নাম মোবারাত তালাক। মুসলমান নারী খুলা তালাকও চাইতে পারেন। যে তালাক পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে ঘটাতে হয়। তবে এ তালাকের জন্য স্ত্রীকেই স্বামীর ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। যদি স্ত্রী খুলা তালাক চায় সে ক্ষেত্রে স্ত্রী তালাকের বিনিময় মূল্য প্রদান করে খুলা তালাক পেতে অধিকারিণী। (শিরিন আলম চৌধুরী বনাম ক্যাপ্টেন শামসুল আলম চৌধুরী ৪৮ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা-৭৯)। অন্যথায় ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুসারে নারীকে আদালতের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে তালাক চাইতে হয়। কিন্তু তালাকের এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে।

উলেস্নখ্য, মুসলিম আইনে 'খুলা' এবং 'মুবারাত' ছাড়া সব ক্ষেত্রে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করার ক্ষমতা একচ্ছত্রভাবে পুরুষের ওপর ন্যস্ত। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রী তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে তবে তা একচ্ছত্রভাবে নয় বরং স্বামীর সম্মতি সাপেক্ষে।

দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল থাকা অবস্থায় স্ত্রীদের ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার মুসলিম পারিবারিক আইন দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু তালাকের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক তালাক নোটিশের তারিখ থেকে পরবর্তী ৯০ দিন পর্যন্ত অথবা স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকেন তাহলে সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।

মুসলিম পারিবারিক আইনে স্পষ্টভাবে বিধিবদ্ধ না থাকলেও বাস্তবে এমন মামলাও রয়েছে যেখানে স্ত্রী স্বামীর বাড়ি পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর স্বামী তার বিরুদ্ধে 'অসতী', 'চরিত্রহীন', 'কর্তব্যবিমুখ' ইত্যাদি অভিযোগ আনে এবং সে ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালত স্ত্রীর বিবাহকালীন ভরণপোষণের অধিকার বাতিল করে দেন। যে স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য সে স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য নয়। (মিতা খান বনাম হেমায়েত বিবি, ১৪ ডিএলআর, হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা-৪৫৫)।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা

ঊসধরষ: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<52977 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1