যে বয়সে মেয়েটির স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা কিংবা রঙিন রঙিন স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতের বীজ বোনার কথা। সেই বয়সে মেয়েটির জীবন এখন আবর্তিত হচ্ছে ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া এক ফুটফুটে সন্তানকে ঘিরে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাকে তেড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সেই বিভীষিকাময় দিনটি। ওই দিনটির কারণেই মেয়েটিকে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। অথচ ধর্ষক দিব্যি স্বাভাবিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে। কারণ এখনো সাজা হয়নি তার। কবে বিচার শেষ হবে তা কেউ জানে না।
ধর্ষিতা মামলা করার দুই বছর পরে তার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। পাঠক! এর থেকে অনুমেয় যে কবে শেষ হবে তার বিচারকাজ।
এদিকে অভিযুক্ত মাত্র ৮ মাস হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তি দিয়েছে হাইকোর্ট। মামলাটি হয় ২০১৬ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে। আসামি দুই বছর পলাতক থাকার পর সে নিজে স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিল। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আদালত ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগ গঠন করেছে আসামির বিরুদ্ধে। তার প্রেক্ষিতে একটি ডিএনএ পরীক্ষা হওয়ার কথা। ভুক্তভোগী সেই মেয়েটি আর তার সন্তানের ডিএনএ নমুনা ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হলেও অভিযুক্ত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা আসেনি। তদন্ত কর্মকর্তারা বারবার তাকে ডাকলেও সাড়া দেয়নি সে। এই মামলার গত শুনানির দিনে নিম্ন আদালত থেকে বলা হয়েছে পরবর্তী শুনানির আগেই যেন সে নমুনা জমা দেয়, এমনটিই আদালত থেকে জানা গেছে।
২০১৫ সালের জুন মাসের ৬ তারিখ। ভয়ঙ্কর সেই দিন। ধর্ষিতার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। ধর্ষকের বয়স ধর্ষিতার বয়সের চারগুণ। ধর্ষিতার ভাইয়ের ভাষায়, হাসপাতালে যখন জানানো হলো যে তার বোন অন্তঃসত্ত্বা তখন তিনি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেননি। বোনকে জিজ্ঞেস করার পরে বেরিয়ে আসে সম্পূর্ণ ঘটনা।
ধর্ষিতার পরিবারের বেশ কিছুটা সময় লেগেছে মামলা করার সাহস জোগাড় করতে। তারা যখন পুলিশের কাছে যান, তখন পুলিশ জানায় দেরি হওয়ার কারণে সরাসরি পুলিশে মামলা না করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইবু্যনালের মাধ্যমে মামলা করতে। মামলার জন্য একটি মেডিকেল রিপোর্ট প্রয়োজন তাই ধর্ষিতাকে নিয়ে যাওয়া হয় মাতৃ শিশু স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানকার আল্ট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট আর অন্যান্য কাগজপত্র আদালতে জমা দিয়ে মামলা করা হয়। দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ, ততদিনে মেয়েটি ৩৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা।
ধর্ষকের পরিবার গ্রামে বেশ প্রভাবশালী। অভিযুক্তের অনেক জমি আছে, তার সন্তানরা বিদেশে চাকরি করে, তাই তাদের টাকা-পয়সার অভাব নেই তেমন। সেকারণে ধর্ষক পরিবারের হুমকি-ধমকিতে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে ধর্ষিতার পরিবারকে। গ্রামে থাকেন শুধু বিধবা মা। অভিযুক্তের পরিবারের সদস্যরা ধর্ষিতার মাকেও নানানভাবে উত্ত্যক্ত করেছেন এবং তাকেও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।
সময় যত গড়াচ্ছে, ভুক্তভোগী পরিবারের উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। আসুন এ পর্বে জেনে নেয়া যাক ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইন কি বলে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ধারা ১৩-তে বলা হয়েছে যে, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া শিশুটির তত্ত্বাবধান করবেন শিশুটির মা অথবা মা-পক্ষের আত্মীয়স্বজন। এ সময় শিশুটি মায়ের অথবা বাবার অথবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হবে। আরও বলা হয়েছে, শিশুটির ভরণপোষণ ব্যয় বহন করবে সরকার। এ ক্ষেত্রে শিশুটি ছেলে হলে ২১ বছর আর মেয়ে হলে বিয়ে না দেয়া পর্যন্ত সরকার তার ভরণপোষণ ব্যয় বহন করবে।
তবে শিশুটি যদি প্রতিবন্ধী হয়, তবে যত দিন পর্যন্ত সে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করতে না পারে, তত দিন পর্যন্ত সরকার ভরণপোষণ দেবে। আদালত এ ক্ষেত্রে নির্ধারণ করে দেবে যে শিশুটিকে প্রতি মাসে ভরণপোষণ বাবদ কত টাকা দেয়া হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ধারা ২০-এ বলা হয়েছে, এ আইনে দায়ের করা প্রতিটি মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। ধারা ১৩(৩)-এ বলা হয়েছে প্রাথমিক অবস্থায় শিশুটির ব্যয়ভার বহন করবে সরকার। কিন্তু পরে আদালতের নির্দেশে ধর্ষণকারীকে শিশুর ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হবে।
ধর্ষক ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে শিশুর ব্যয়ভার বহন করা হবে। ধারা-১৩ ও ১৫-তে বলা হয়েছে, ধর্ষকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহকৃত টাকা পর্যাপ্ত না হলে সে ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারী হবে এমন সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ ব্যয় নির্বাহ হবে।
এ ক্ষেত্রে ওই সম্পত্তির ওপর কোনো ব্যাংক লোন অথবা বন্ধকি থাকলেও শিশুটির অধিকার আগে প্রাধান্য পাবে। ধারা ১৬-তে বলা হয়েছে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলার কালেক্টর প্রথমে ধর্ষণকারীর সব প্রকার সম্পত্তির একটি তালিকা তৈরি করবেন এবং সরাসরি নিলামের মাধ্যমে সেই সম্পত্তি বিক্রি করে শিশুর ভরণপোষণ ব্যয় নির্বাহ করবেন
ধারা ১৪-তে বলা হয়েছে ধর্ষিতা ও সন্তানের ছবি, নাম, বাসা অথবা স্থায়ী ঠিকানা কোনোটাই পত্রিকা অথবা মিডিয়ায় প্রকাশ করা যাবে না। যদি কেউ জানা সত্ত্বেও ভিকটিমের পরিচয় বা ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ করেন, তবে তিনি এক লাখ টাকা অর্থদন্ডসহ জেল ভোগ করবেন। ধারা ২৪-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো পক্ষ আদালতের রায়ের ফলে নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন, তাহলে ওই রায় ঘোষণা হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন।
কবি সুকান্ত লিখেছেন, এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান, এই পৃথিবীকে করে যেতে হবে তার বাসযোগ্য স্থান। কিন্তু ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া শিশুর অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে সভ্য সমাজে এখনো রয়েছে নানা জটিলতা। ফলে ধর্ষণের ঘটনা এবং এর ফলে জন্ম নেয়া শিশুর সামাজিক জীবন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ার ফলে এ রকম অধিকাংশ শিশুই হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অপরাধী।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো 'ধর্ষকের যথা সময় উপযুক্ত বিচার হয়েছে।' সেদিন আমাদের সংবিধানের শাশ্বত বাণী চিরন্তন রূপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা