মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনার আইনি প্রতিকারের পথ কতদূর?

সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃতু্যর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের আগস্টে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস হয়। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানা ও বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এ মোটরযান চলাচলের নির্দেশাবলি দেয়া হয়েছে
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

পত্রিকা খুললে যে খবরগুলো সব থেকে বেশি শিহরিত করে তোলে তা হচ্ছে বিভিন্ন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃতু্য হচ্ছে দেশের বিভিন্ন সড়কগুলোতে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে মারা গেছে ১ হাজার ১৬৩ জন।

সড়ক বাড়ছে, গাড়ি বাড়ছে, চালক তো বাড়ছে না। বিআরটিএর তথ্য হলো- দেশে বর্তমানে অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা ৩৪ লাখ। লাইসেন্স প্রাপ্ত চালক আছে ১৭ লাখ। একটা গাড়ি দিন-রাত একজনে চালালেও ১৭ লাখ চালকের ঘাটতি আছে। প্রতি বছর চালকের চাহিদা রয়েছে ৩০-৩৫ হাজার। এখন পর্যন্ত বছরে নতুন চালক যুক্ত হচ্ছে ৩-৫ হাজার। আমাদের দেশে চালক সৃষ্টির কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান নেই।

রাস্তায় প্রতিদিন যে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে, তার সবকিছুর জন্য শুধু চালকরাও দায়ী নয়। কেননা, বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ায় যদি ত্রম্নটি থাকে, যদি তারা অদক্ষ লোককে লাইসেন্স দেয় এবং সেই ড্রাইভার যদি দুর্ঘটনার কারণ হন, তাহলে তার দায় বিআরটিএর ওপরেও বর্তায়।

সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃতু্যর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের আগস্টে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস হয়। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানা ও বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এ মোটরযান চলাচলের নির্দেশাবলি দেয়া হয়েছে। আইনের ৪৯ ধারায় প্রথম অংশে বলা হয়েছে- মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো চালক মোটরযান চালাতে পারবে না। মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবে না। মোটরযান চালক কোনো অবস্থাতে কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিককে মোটরযান চালনার দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে না।

সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত অভিমুখ ছাড়া বিপরীত দিক থেকে মোটরযান চালানো যাবে না। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্যকোনো স্থানে বা উল্টো পার্শ্বে বা ভুল দিকে (ডৎড়হম ঝরফব) মোটরযান থামিয়ে যানজট বা অন্যকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। চালক ছাড়া মোটরসাইকেলে একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবে না এবং চালক ও সহযাত্রী উভয়কে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। চলন্ত অবস্থায় চালক, কন্ডাক্টর বা অন্যকোনো ব্যক্তি কোনো যাত্রীকে মোটরযানে ওঠাতে বা নামাতে পারবে না। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য গণপরিবহনে অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে।

কোনো ব্যক্তি কোনো মোটরযানের মালিক বা কোনো আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না। আইনানুগ কর্তৃপক্ষ বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মোটরযানে প্রবেশ বা আরোহণ করতে পারবে না। মোটরযানচালক মোটরযান চালনারত অবস্থায় মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবে না। মোটরযানচালক সিটবেল্ট বাঁধা ছাড়া মোটরযান চালাতে পারবে না।

দূরপালস্নার মোটরযানে নির্ধারিত সংখ্যক যাত্রী বা আরোহীর অতিরিক্ত কোনো যাত্রী আরোহী বহন করা যাবে না। কোনো চালক, কমান্ডার বা মোটরযান পরিচালনার সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি পরিবহনযানে যাত্রী সাধারণের সঙ্গে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ বা হয়রানি করতে পারবে না। রাত্রি বেলায় বিপরীত দিক থেকে আসা মোটরযান চালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এরূপ হাইবিম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাবে না।

উপরোক্ত নির্দেশাবলিগুলো অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। আইনের প্রথম অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৩ (তিন) মাসের কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। দ্বিতীয় অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ১ (এক) মাসের কারাদন্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে।

সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য হত্যার উদ্দেশ্যে প্রমাণিত হলে তা দন্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি মৃতু্যদন্ড। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হবে। সড়কে দুটি গাড়ি পালস্না দিয়ে (রেসিং) চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদন্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।

এই আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। ফলে আইনটি কার্যকর হলে বেপরোয়া চালানো, অবৈধ লাইসেন্সধারী চালকদের দৌরাত্ম্য কমতো। কিন্তু আইন পাশের দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না করে সড়কে শৃঙ্খলা এনে দুর্ঘটনা রোধে কমিটি প্রণীত সুপারিশযুক্ত প্রতিবেদনে আশু করণীয় ৫০টি, স্বল্পমেয়াদি ৩২টি এবং দীর্ঘমেয়াদি ২৯টি প্রস্তাব সর্বমোট ১১১টি প্রস্তাব আনা হয়েছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে আর কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়ে গেছে।

প্রতিবার দুর্ঘটনার পর পরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন সহজে আলোর মুখ দেখে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কত প্রাণ গেলে, মৃতু্যর মিছিল কত দীর্ঘ হলে তবে থামবে?

সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। যানবাহনের উচ্চগতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসেও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিরোধসংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রবন্ধ, গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্তৃক প্রচলিত পদ্ধতিতে উপযুক্ত দক্ষ ব্যক্তিকে লাইসেন্স প্রদানে প্রতিবন্ধকতা ও লাইসেন্সের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা সংক্রান্ত বিষয়ে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে সচেতন হওয়া জরুরি। লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশের সঠিক ও আন্তরিক ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিআরটিএর উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ট্রাকে ওভারলোড বন্ধে প্রয়োজনীয় সংখ্যক (ওয়েয়িং) মেশিন চালু করা এবং ওভারলোডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিভিন্ন সড়কের সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনাবিরোধী অভিযান চালাতে হবে। সড়ক মেরামত, সংস্কারের মতো জরুরি কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন গাড়ি ভাংচুর করে আগুন জ্বালিয়ে সাধারণ জনতা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারা ভুলে যাচ্ছে এটা কোনো সঠিক পন্থা নয়। বরং নিজের দেশের সম্পত্তিই বিনষ্ট করা হচ্ছে কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ কিংবা সচেতনতা কিছুই হচ্ছে না।

এভাবে চলতে থাকলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার এবং জনগণ উভয় ক্ষেত্রেই সহযোগিতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। প্রয়োজন ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। দেশে উন্নত ট্রাফিক মনিটরিং ব্যবস্থা, উন্নত সড়ক তৈরি, কঠোরভাবে ফিটনেসবিহীন যানবাহন প্রতিরোধ এবং প্রশিক্ষণবিহীন চালকদের অপসারণসহ অজস্র জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন।

সবার আগে প্রয়োজন সড়কে যানবাহন চলাচল এবং দুর্ঘটনাসংক্রান্ত ব্যাপারগুলোতে আইনের সঠিক প্রয়োগ। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু, সমন্বিত পদক্ষেপ এবং জনগণের সচেতনতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<68057 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1