মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকারবঞ্চিত পথশিশুদের জন্য আইনি সুরক্ষা অপর্যাপ্ত

অভিভাবকহীন এসব শিশুর পথচলা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো। পথশিশুদের পারিবারিক বন্ধন বলে কিছু নেই। বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা তাদের কপালে কখনো জোটে না। আমাদের দেশের অনেক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হয়। এসব শিশুই তখন জীবন সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। তাদের কুলি, হকার, রিকশাচালক, শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদিসহ বিভিন্ন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা হয়
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কবিতার পঙ্‌ক্তি 'এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।' একটি শিশুর জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত আগামী বংশধরের জন্য একটি ফলপ্রসূ দিক। শিশুদের যদি স্বাভাবিক বৃদ্ধি না ঘটে তাহলে একটি দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

কিন্তু যে সব শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয় বিশেষত অধিকারবঞ্চিত পথশিশু। যাদের মৌলিক ও মানবাধিকার বলে কিছু আছে?

দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। সুবিধাবঞ্চিত এসব পথশিশুর অনেকেই এসেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে, না হয় জন্ম হয়েছে শহরের কোনো এক জায়গায়। কাজের অভাবে খেয়ে না খেয়ে তাদের রাত কাটে রাস্তার ধারে বা সরকারি স্থাপনার খোলা বারান্দা বা রেললাইনের পাশে।

অভিভাবকহীন এসব শিশুর পথচলা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো। পথশিশুদের পারিবারিক বন্ধন বলে কিছু নেই। বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা তাদের কপালে কখনো জোটে না। আমাদের দেশের অনেক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হয়।

এসব শিশুই তখন জীবন সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। তাদের কুলি, হকার, রিকশাচালক, শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদিসহ বিভিন্ন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা হয়।

পথশিশু হওয়ার পেছনে বিভিন্ন নিয়ামক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন দরিদ্রতা, বাবা মায়ের বিচ্ছেদ, বাবা-মা মারা যাওয়া বা বাবা-মায়ের অসচেতনতা অথবা অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারণে এখন কিছু শিশু পথে দিন কাটায়। ফলে নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পথশিশুদের জীবনযাপন অত্যন্ত দুর্বিষহ। শহরের খোলা আকাশের নিচে, ব্রিজের নিচে, মার্কেট, পার্ক, বাস ও রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান তাদের আশ্রয় কেন্দ্র। বাজার ও নৌ বা বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক তাদের বসবাস। নৌ বা বাস টার্মিনালে তারা রাত-দিন কাজ করে সামান্য টাকা আয় করে। এ টাকা দিয়ে তারা রাস্তার ধারের ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনে খায়। আয় না হলে না খেয়েই দিনযাপন করে। এজন্য অধিকাংশ পথশিশু অপুষ্টিতে ভোগে। চর্মরোগ, ডায়রিয়া, ঠান্ডা লাগা, জ্বর, জন্ডিসসহ নানা রোগে তারা আক্রান্ত হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত।

অন্যদিকে বিভিন্নভাবে পথশিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন, ২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতা, জোর জবর-দস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুঘর্টনার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে।

যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যে সব কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে।

বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার : ৭ বছরের নিচে শিশুর কোনো আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নিচে নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহণ খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নিচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বে-আইনি।

শিশুদের প্রতি সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের মতো প্রধান প্রধান যেসব হুমকি আছে সেগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে তাদের কিশোর বয়সেই। এই বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রধানত কিশোরেরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বন্দ্ব সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে অথবা শিশুশ্রমিক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব কারণে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ কমে যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এসব পথশিশু জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অপকর্মে। একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী আছেন, যারা পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করে। অনেক সময় পথশিশুরা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিদেশে পাচারেরও শিকার হচ্ছে পথশিশুরা। দারিদ্র্যের কারণে নিজের ভালো-মন্দ না বুঝেই নানামুখী ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও রয়েছে।

শিশুদের দিয়ে কোনো রকমের অসামাজিক কার্য সম্পাদনের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রথমে পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করা উচিত। পথশিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা ও তাদের পুনর্বাসন বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। পথশিশুদের যেন কোনোভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করতে না পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ শিশুবান্ধব সংস্থার উন্নয়নকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের দেশের অনেক ছিন্নমূল শিশু রয়েছে যারা দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে না। অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের দিন কাটে অনেক কষ্টে। ঠিকমতো খাবার জোগাতে পারে না। তারা কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে? এজন্য এসব শিশুকে শিক্ষাদানের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব শিশুর অভিভাবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

উন্নত দেশে দেখা যায়, শিশুর সব দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। তেমনি আমাদের দেশের অবহেলিত শিশুদের সব দায়িত্ব রাষ্ট্র নিলে সমাজে আর কোনো অরাজকতার সৃষ্টি হবে না। অবশেষে বলব, শিশুরা হচ্ছে সমাজ নামক বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল। এ ধরনের শিশুদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<80160 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1