শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির চিরকালের বাতিঘর

সাধন সরকার
  ০৭ আগস্ট ২০২০, ০০:০০

বাংলা ভাষার সর্বকালের সেরা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির চিরকালের বাতিঘর। সাহিত্যের সব শাখায় তিনি সোনা ফলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল জীবন ছিল বিশাল ও বৈচিত্র্যময়। তিনি ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অভিনেতা, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী, দার্শনিক ও প্রকৃতি-পরিবেশপ্রেমী। সাহিত্য জগতের এই মহিরুহ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ধনাঢ্য, জামদারি ও সংস্কৃতিবান পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু বংশের ধারা রক্ষা করে চলাই তার অভিলাষ ছিল না। বাংলাসাহিত্যকে তিনি দু'হাত ভরে দিয়েছেন। তিনি প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন না, ছোটবেলায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তিনি জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ ছেড়ে গ্রামবাংলার পথে পথে, খাল-বিল-নদী পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। শান্তিনিকেতনের মাটি ও খড়ের ঘরেও তিনি বাস করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম বাঙালিই শুধু নন, এশিয়া মহাদেশে তার আগে কেউ এ মর্যাদায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাসাহিত্য ও বাঙালিকে বিশ্ব পরিসরে পরিচিত করে তোলেন। বাঙালি মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবে এ স্বপ্নের বীজ তিনিই প্রথম রোপণ করেছিলেন। তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছিলেন তা পরবর্তী সময়ে বাঙালিদের সমহিমায় নিজেদের তুলে ধরতে জাগ্রত করেছিল। তিনি স্বল্পকালের জন্য হলেও প্রজা শাসন অর্থাৎ জমিদারিও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জমিদারি শাসন সম্পর্কে আমরা ক'জনই বা জানি! ১৮৯১ সাল থেকে তার ওপর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে। অল্প কিছুকাল প্রজাশাসন করলেও এ সময়ের মধ্যে তিনি প্রজাদের মন জয় করতে পেরেছিলেন। প্রজা দরিদ্র রবীন্দ্রনাথ কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে ভাবতেন। তিনি তার নোবেল বিজয়ের অর্থ দিয়ে সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষির সম্ভাবনা এবং কৃষিকে আধুনিকায়নের কথা অনেক আগেই তিনি ভেবেছিলেন। এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কবির জমিদারি প্রথা সম্পর্কে তার রিপোর্টে বলেন, 'জমিদার মাত্রই যে হদয়হীন হন না, তার উজ্বল দৃষ্টান্ত বিশিষ্ট কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।' নদী ভাঙন, ঝড় কিংবা অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের 'জমিদার রবীন্দ্রনাথ' সে সময় অর্থ সহায়তা দিতেন। জমিদারির কাজে বসে রবীন্দ্রনাথ মানুষের নানা সমস্যার সমাধানও করতেন আন্তরিকতার সঙ্গে।

আমরা এখন যা ভাবছি শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একইভাবে বলে গেছেন। তার চিন্তা, কথা ও লেখনীতে তিনি তখন এখনকার সময়কে যেন দেখতে পেয়েছিলেন, ধারণ করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের লেখনী আর কর্মনিষ্ঠার আলোকে বলতে গেলে তিনি ছিলেন একজন পরিবেশবাদী! রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি-পরিবেশ ভাবনা ও সচেতনতার মাধ্যমে শুধু নয়, তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে একনিষ্ঠ প্রকৃতি-পরিবেশকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে, ছোটগল্পে, কবিতায়, নাটকে সর্বোপরি শিল্পচিন্তা ও চেতনায় প্রকৃতি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পরিবেশবাদী প্রবন্ধগুলো হলো : পলস্নী প্রকৃতি, ভূমিলক্ষ্ণী, দেশের কাজ, শ্রীনিকেতন, পলস্নী সেবা, উপেক্ষিতা পলস্নী, শহর ও নগর, বিলাসের ফাঁস, অরণ্য দেবতা, হলকর্ষণ, তপোবন ইত্যাদি। কবিতার মধ্যে রয়েছে : দুই পাখি, বসুন্ধরা, প্রশ্ন, সভ্যতার প্রতি, দুই বিঘা জমি, বৃক্ষ ইত্যাদি। তার গীত নাট্য: রক্তকরবী ও মুক্তধারা। তার চিঠিপত্র 'ছিন্নপত্রাবলী'তে গভীর পরিবেশ ভাবনা ও সচেতনতা স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া বলাই'সহ তার বিভিন্ন ছোটগল্পে ও গানে পরিবেশ-প্রকৃতির বন্দনা উঠে এসেছে। ১৯১৪ সালে জাপান যাওয়ার সময় সমুদ্রপথে তেল নিঃসরণের বিষয়টি দেখে তিনি প্রথম পরিবেশের ওপর মানুষের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত হন। তিনি পরিবেশ সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে মানুষের লোভ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দায়ী করেছেন। ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে পঁচিশে বৈশাখ কবির জন্মোৎসবে বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে সেদিন তার সদ্য রচিত গান গাওয়া হয়। যেখানে তার পরিবেশ সচেতনতা দারুণভাবে ফুটে ওঠে। গানটি হলো: 'মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ।/ ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ। ... ' তিনি জানতেন প্রকৃতির ওপর মানুষের এই অপরিসীম লোভ আর ক্ষুধা কখনো শেষ হবে না! তাই 'প্রশ্ন' কবিতায় কবি সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচারের ভার রেখে যান এইভাবে: 'যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, / তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?' রবীন্দ্রনাথ তার 'বলাই' নামক ছোটগল্পে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি যে অনুরাগ সৃষ্টি করেছেন তা অনন্য। 'সভ্যতার প্রতি' কবিতায় কবি শহুরে জীবনের প্রতি এক প্রকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, 'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, / লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর/ হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, / দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি, ...'।

রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যকর্মে গাছ, পাখি, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় যে অগ্রগণ্য চিন্তার খোরাক রেখে গেছেন তা বর্তমান সময়ের আধুনিক লেখকরা আরও সোচ্চার হয়ে লিখবার তাগিদ অনুভব করছেন। এর ফলশ্রম্নতিতে রোমান্টিক কবিতার আধুনিক রূপ ইকো-কবিতার উদ্ভব হয়েছে। এখন যে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে বিশ্ব, উষ্ণায়ন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা অনেক আগেই টের পাওয়া গিয়েছিল। প্রকৃতির শক্তিকে মানুষ যে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে পৃথিবীকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে, রবীন্দ্রনাথ সে কথাও শতবর্ষ আগে বলে গেছেন। আর এই ভারসাম্যের ব্যাঘাতের জন্যই আজ বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে ভুগছে। তাই কবির মৃতু্যর এতদিন পরও রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা আরও বেড়েছে। মানুষ প্রকৃতি-পরিবেশের ওপর খবরদারি করুক এটা কবি চাননি। কবিগুরু মানুষের সঙ্গে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলে গেছেন। মানুষ এখন সবকিছু অস্বীকার করে পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহটিকে কেবল নিজেদের জন্যই ভাবছে! গাছের ছায়া, ময়ূরের নাচন, কোকিলের ডাক, প্রশান্তিময় সকাল, বিকেলের সোনারোদ ইত্যাদি মানুষ যেন আজ হারিয়ে ফেলতে ব্যস্ত! এমনটি এখন আমাদের মতো বিশ্বকবিও চাননি। বিশ্বকবির বিখ্যাত পঙক্তিমালা- 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, / মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।/ এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে/জীবন্ত হৃদয়- মাঝে যদি স্থান পাই।' সত্যিই সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বকবি তার নশ্বর জীবনকে অবিনশ্বর করে গেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথকে শুধু শিক্ষিত মননশীল শ্রেণিতে আবদ্ধ না রেখে বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে তো বটেই সমগ্র পৃথিবীতে তার কথা, মর্মবাণী, লেখনী ছড়িয়ে দিতে হবে। কেননা, আমাদের সার্বিক জীবনের খোরাক মেটাতে তার কাছে যেতেই হবে। এই মানবতাবাদী সাহিত্যিকের কাছ থেকে মানুষের জানার কখনো শেষ নেই !.

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<107888 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1